Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
নেশার জাল-সুলেখা আক্তার শান্তা

আজ ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নেশার জাল-সুলেখা আক্তার শান্তা

জীবনটা যেন বোঝা হয়ে উঠেছে রহিমার। রোজ
রোজ একই যন্ত্রনা আর ভাল লাগেনা। কোন উপায়ও
দেখেনা। জগত সংসারে কোথাও যেন তার ঠাঁই
নেই। ছেলে আর বউয়ের কাছে বড়ই বোঝা সে।
একা একাই বলছিল রহিমা। ছেলের বউ রিনা শুনতে
পেয় বলে, সংসারে এত কাজ করেও এসব শুনতে হয়।
মুখ ঝামটা দিয়ে থাকবো না আর এ সংসারে,
চলে যাব বাপের বাড়ি।
রহিমা বলে, তোমার আবার কি হলো তুমি আবার
এত চেঁচামেচি করো কেন?
আমিতো শুধু চেঁচামেচি করি? দিনরাত খেটে
মরছি তা কি কারো চোখে পড়ে?
বাবুল সারাদিন কাজ করে এসে দেখে মা আর বউ
ঝগড়া করছে। তোমাদের এই ঝগড়াঝাঁটি আমি
আর পারছিনা সামাল দিতে। শান্তিতে থাকতে
দিলে না তোমরা। যেদিকে আমার দু’চোখ যায়
আমি সেই দিকেই চলে যাব। তারপর যত পারো
তোমরা বউ শাশুড়ি মিলে ঝগড়া করো।
রহিমা ছেলেকে বলে, বাবা এসব কি বলিস তুই
বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি?
রিনা তাই করো, তোমার মায়ের বুকটা ঠান্ডা
হোক। সংসার খরচ আছে তাতো উনি বোঝেন
না? বৌমা খরচ তো সবার জন্যই হয়, আমার খরচই
তোমাদের কাছে বড় মনে হলো? আমি আর
নাইবা থাকলাম এই সংসারে। এরপর রহিমা ঘর
থেকে কাপড়-চোপড় নিয়ে বের হয়। ছেলে বাবুলকে
বলে, বাবা খরচ করা আলা মানুষ চলে যাচ্ছি।

তোমরা তোমাদের সংসারে আয় উন্নতি করো।
বাবুল বলে, মা তুমি কোথাও যাবে না।
রিনা স্বামীর দিকে আগুন চোখে তাকায়। রহিমা
সেটা লক্ষ্য করে ছেলেকে বলে, বাবা আল্লাহ
আমাকে সৃষ্টি করেছে আমার রিজিকও তিনি
রেখেছেন দুনিয়াতে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে
বের হয় অজানার পথে। রহিমা মাদারীপুর থেকে
ঢাকায় আসে। অপরিচিত ঢাকা শহর কি করবে
ভেবে পায়না। রহিমা অনেক কষ্টে দেশের মানুষ
ভানুকে খুঁজে বের করে। ভানু তার পরিচিত
একটি বাসায় কাজে জুটিয়ে দেয় রহিমাকে।
বাসার কর্ত্রী আনিকা বলে, এই বুড়ো বয়সে
উনি কি কাজ করতে পারবে!
রহিমা বলে, বয়সে আমার কোনো সমস্যা হবে
না, গায়ে আমার শক্তি আছে। আমি সময়ের কাজ
সময়মতো করব। রহিমার কাজ করা চলতে থাকে,
বয়সের ভারে ঠিকমতো কাজ করতে পারে না সে।
আনিকা বলে, তোমার এই ধীরেসুস্থে কাজ দিয়ে
চলবেনা আমার সংসার। তুমি অন্য কোথাও কাজ
দেখো।

রহিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, যেখানেই যাই
আমাকে কাজ করেই খেতে হবে। আমার যে
কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আনিকা কাজ
থেকে রহিমাকে কোনভাবেই বিদায় করতে পারে
না। আনিকা হঠাৎ ফন্দি করে বলে, তুমি আমার
ড্রয়ার থেকে টাকা চুরি করেছো?
রহিমা বলে, শক্তি খরচ করে কাজ করি, কাজ করার
উপার্জনে যে সুখ পাবো চুরি করা জিনিস
কি সেই সুখ পাবো? তাই মেহনত করে খাই।
আনিকা বলে, তোমার কাছে উপদেশ বাক্য শুনতে
চাই না। তুমি আমার বাসা থেকে চলে যাও।
তোমাকে আমার এখানে রাখা সম্ভব নয়।
আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু চোরের অপবাদ নিয়ে!
রহিমা অভিমানে বেতন-ভাতা না নিয়ে এক
কাপড়ে বের হয়। রাস্তাঘাট তার তেমন চেনা জানা
নেই। সে রাস্তায় বসে কান্নাকাটি করে। কেউ
তার দিকে সহায়ক হয় না। পথ হারা পথিক আমি
কোথায় হবে আমার ঠিকানা। দেশের বাড়িও
আমি ফিরে যাব না। জীবন মরণ আমি এই
ঢাকাতেই কাটাব। জানিনা কি আছে কপালে
লেখা।

চা বিক্রেতা সিদ্দিক বলে, তুমি এখানে বসে
কাঁদছো কেন বুড়িমা?
রহিম একটু চুপ থেকে বলে, আমার কথা শুনে কি
হবে? তবুও বলোনা?
এই দুনিয়াতে আমার যাওয়ার কোন জায়গা
নাই। আমি যে নিরুপায় । কি করব, কি খাব,
কোথায় থাকবো তা আমার জানা নেই!
বুুড়িমা যাবে তুমি আমার সঙ্গে আমি
যেখানে থাকি? তোমাকে আমি একটা কাজও
দেবো। আমি যে চা বিক্রি করি, এমন তুমিও
বিক্রি করবে। তা থেকে তোমাকে রোজ পঞ্চাশ
টাকা দেবো।

রহিমা অন্ধকারে আলো দেখে ভাবে, পঞ্চাশ টাকা
আমার হবে না তাও তো থাকার কাজের ব্যবস্থা হল।
হ্যাঁ আমি রাজি। এরপর সিদ্দিকের সঙ্গে যায়।
কুল হারা রহিমা ব্যবস্থা পেয়ে খুবই প্রফুল্ল।
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নিরাশ করে না তিনি
একভাবে না একভাবে ব্যবস্থা করে দেন।
সিদ্দিক সকাল হলে রহিমার হাতে চায়ের ফ্লাস্ক
দিয়ে, এই চা তুমি রাস্তায় বিক্রি করবে। রহিমা
সারাদিন ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করে লাভের পুরো
টাকা এনে সিদ্দিকের হাতে দেয়। তা থেকে পঞ্চাশ
টাকা রহিমার হাতে দেয়, তা দিয়ে রহিমা নিজের
খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা চলে। রহিমার লাভের টাকা ভালো না পাওয়ায় মনটা তার
ক্ষুন্ন হয়। সারাদিন পরিশ্রম করে যে টাকা পাই
তাতে চলতে খুবই কষ্ট হয়, সে উপায় খুঁজে কি
করা যায় একটি গাছের নিচে বসে ভাবে। এমন
সময় আজগর বলে, কি বুড়িমা এখানে বসে
আছ?নিরুপায় মানুষের ভাবা ছাড়া কিবা আছে।
এইতো তাদের সম্বল। আজগর বলে, তোমার মুখ ফুটে কিছু বলতে হবেনা। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি একজন দুঃখী মানুষ। তুমি চা বিক্রি করে যে টাকা পাও
তার চেয়ে দ্বিগুণ, দ্বিগুণ টাকা পাবে। আরাম
আয়েশ করে থাকতে পারবে!রহিম ঝিম ধরে বলে, এমন কাজ পেলে তো ভালোই
হয়।আজগর বলে, তুমি আজ থেকে আমার কাজে লেগে যাও। আমি তোমাকে কাজ যেখানে যেখানে
দিতে বলব তুমি সেখানেই পৌঁছে দিবে। নাও
তোমাকে অগ্রিম কিছু টাকাও দিলাম, কাজের শেষে আরও পাবে।

রহিমা তো মহা খুশি কাজ না করেই টাকা।
কাজ শেষ হলে আরো টাকা পাব, যাক সুখের
সন্ধান খুঁজে পেলাম। আজগর বলে, কোথায় দিবে
বলছি, অভিজাত স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট,
টার্মিনাল, বাসা, বস্তি এইসব জায়গায় যখন
তোমাকে যেখানে যেতে বলবো তখন সেখানে
যেয়ে তুমি লোকদের হাতে পৌঁছে দেবে।
টিফিনের সময় ছাত্রদের বেশ সমাগম হয়। আজগর
কিছু কাগজে মোরা পুরিয়া দিয়েছে। এগুলোতে
কি আছে তা তোমার জানার দরকার নেই। এগুলোর
আবার বিভিন্ন নাম আছে। বাবা,ডাইল।
ঠিক আছে দেব। রহিমা হাতে নগদ টাকা পেয়ে
আনন্দে পথে ছুটল। সহজ-সরল রহিমা তার ধারণা
নেই জগতে কি ঘটে বা কি ঘটতে পারে। অভাবী
মানুষ অভাবের কারণে নিয়েই থাকে তার ভাবনা।
শুরু করে তার কাজের পথযাত্রা আজগরের কথামতো পৌঁছে দেয় প্যাকেটগুলো। আস্তে আস্তে চলতে
থাকে তার কাজের সঙ্গম। রহিমা লোকজনের
ভাবভঙ্গিতে বুঝতে পারে যে এটা একটা নেশা
সেই লোকজনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
অনেকেই তার নিয়মিত খরিদ্দার, কলেজের একটি
ছেলে সুমন তার সাথে রহিমা খুবই সুসম্পর্ক
হয়। রহিমা অন্যদের কাছে নেশা বিক্রি করেছে যে
টাকা পায় সুমন তার চেয়ে বেশি টাকা দেয়।
রহিমা বৃদ্ধ বলে।

যে বাচ্চা ছেলেদের রহিমা নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে
তারা ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে, তা
দেখে রহিমার মনের মধ্যে অনুশোচনা জাগে। এই
বাচ্চা ছেলেদের আমি ধ্বংসের পথে ফেলে দিচ্ছি

সুমনকে বলে, তোমাকে আর আমি নেশা দেবো
না।তুমি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ। যদি তুমি আমার
ছেলে হতে পারতাম আমি তার হাতে এই ধ্বংসের
নেশা তুলে দিতে।
সুমন বলে, তুমি আমাকে বারণ করছ, করো,
কিন্তু নেশা আমাকে ছাড়লেও আমি যে নেশা কে
ছাড়তে পারবো না সে যে আমার রক্তে মিশে
আছে। সুমনের বাপ-মা কোনোভাবেই, সুমনকে নেশা
থেকে ফেরাতে পারছেনা। নেশার তারণায় সুমন
বাবা-মার কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা নিয়ে
আসে। এক সময় সুমনের বাবা আলিম জানতে
পারে তার ছেলে কোথা থেকে নেশা সংগ্রহ করে।
সে রহিমাকে অনুনয়-বিনয় করে নিষেধ করে তার
ছেলেকে নেশা না দেওয়ার জন্য।
ঠিক আছে আমি সুমনকে নিশা না দেওয়ার
চেষ্টা করব।সে আজগরকে না বলে, আমি আর মরণব্যাধি নেশা বিক্রির কাজ করবো না।
আজগর উচ্চস্বরে হেসে বললে? তুমি নেশা বিক্রি
করবে না! এই পথে ঢোকা সহজ এখান থেকে বের
হওয়া বড় কঠিন, তুমি চাইলে এখান থেকে বের
হতে পারবে না। “এখানে বিস্তীর্ণ নেশার জাল
বিছানো”।

রহিমা জোরের সঙ্গে বলে, আমি এ কাজ করবোনা।
তাহলে তো তুমি ফান্দে পড়ে যাবে, তোমাকে
পুলিশ ধরবে।
আমি নেশা বিক্রি না করলে কেন পুলিশ আমাকে
ধরবে?
তুমিতো এ ব্যবসা করেছ, আর এখন যে তুমি
করো না তার কি প্রমাণ আছে। তোমাকে ধরতে
নেশা লাগবেনা আমি তোমাকে পুলিশের হাতে
ধরিয়ে দেবো। যে কদিন বাঁচবে জেলের ঘানি
টানতে হবে। আজগর নানাভাবে রহিমাকে ভয়-
ভীতি দেখিয়ে নেশার কাজে লিপ্ত রাখে।
তোমার এর থেকে কোনো নিস্তার নেই। তোমার
যে বয়স, এই বয়সে কেউ ভাববেনা ভুমি নেশা
বিক্রি করো। তাই তোমাকে কাজে রেখেছি।
রহিমা শুরু করে দেয় আগের মতো নেশা বিক্রি
করা। ছুটছেতো ছুটছেই দ্রুত গতিতে
ছুটছে। রহিমা অন্যদের নেশা দিলেও সুমনকে
নেশা দেয় না।
রহিমাকে জিজ্ঞেস করে সুমন কি গো খালা
তুমি যে এখন আমার কাছে নেশা বিক্রি করো
না?
আমি চাই তুমি এই নেশার আসক্ত থেকে বের হও।
খালা এক মরণ পারে আমাকে নেশা থেকে ফেরাতে।
আমি যে জগতে ডুবে আছি এ থেকে মুক্তির
আর কোনো উপায় নাই। সুমন আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। রহিমা বলে সুমনকে,
মায়া বড় খারাপ, তুমি আমার ছেলে না হলে কি
হবে? তোমাকে আমি সন্তানের মতোই দেখি,
তোমার মুখখানা দেখে আমার ছেলে বাবুলকে
ভুলে আছি। একমাএ মা জানে সন্তানের কাছ
থেকে দূরে থাকা তার বুকের ভিতর কেমন আগুন
দাউদাউ করে জ্বলে। বেদনার মানুষ ব্যথা যন্ত্রণা
বোঝে সুখের মানুষ তা বুঝেনা।
খালা তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।
আমার যা হবার হবে। কিন্তু এই নেশা থেকে
আমাকে বের হতে বলোনা। কারণ “নেশার জাল”
আমাকে ঘিরে রেখেছে। এর থেকে বের হওয়া আমার
কখনোই যে সম্ভব না আর ভেবেও দেখেনি। আর
নেশা আমাকে ধ্বংস চুরা বাড়িতে নিয়ে
গেছে। পারিনি বাবা-মার স্বপ্ন পূরণ করতে।
আমার কোন বোধ শক্তির অনুভূতি নেই, কারো
কান্না আমার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না।
রহিমা বলে, বুঝতে পেরেছি, আমার বুঝ তোমার
ভালো লাগেনা। তারপরও আমি বারবার তোমাকে
নিষেধ করব।
নেশা সুমনকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়। সুমন
বুঝতে পারে দুনিয়া থেকে বিদায় হওয়ার দিন তার
ঘনিয়ে আসছে। খালা আজ আমাকে দেখছো
কাল মাকে নাও দেখতে পারো।
এমন কথা বলছ কেন? খালা তুমি ঘাবড়ে যেও না।
কদিন হয় সুমনকে দেখেনা রহিমা। ভাবে হয়তো
সুমন অন্য কারণে ব্যস্ত তাই কলেজ আসেনা। এরই
মাঝে লক্ষ করে দেখে একটি মুর্দার খাটে লাশ বহন
করে নিয়ে যাচ্ছে কবরস্থান। রহিমা জিজ্ঞেস করে
এটা কার লাশ? লোকজন বলে, এটা সুমনের লাশ।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত রহিমা ওইখানেই ঢলে পড়ে,
সবাই তাকে ধরে দেখে হৃদস্পন্দন আর নেই।
নিশার কাছে পরাজিত হয়ে সুমন চলে গেল
পরকালে। নেশার সুখ আর বাস্তব সুখ একনয়
সুমন তা বুঝতে পারিনি। কিছু মানুষ আছে
জেনেও নেশার কাছে জিম্মি হয়ে যায়। তা থেকে
ফেরার উপায় খুঁজে না। যেমন খুজেনি সুমন।

লেখক-সুলেখা আক্তার শান্তা

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ