insert-headers-and-footers
domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init
action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121জীবনের অনেক মর্মস্পর্শী ঘটনা গল্প বলে মনে হয়। রিয়ার গল্পটি তেমনি এক উপাখ্যান। রিয়া মা নাহিদা দুই এক মাস ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় পাগল থাকে। কোন চিকিৎসায়ও ভালো হয়না। সকালে বাড়িতে তোলপাড় চলছিল পাগলের পাগলামি নিয়ে। নাহিদার শাশুড়ি সেতারা চেঁচামেচি করছে। পাগল বউ সামলানো আমার কাজ নয়, সব উল্টোপাল্টা করে দিচ্ছে। এভাবে সংসার চলে না। নাহিদার স্বামী জামিল এগিয়ে আসে।
কি হয়েছে মা?
চোখে দেখতে পারিস না কি হয়েছে। পাগল বউয়ের কান্ড দেখ কি করেছে। কলস ভর্তি পানি বিছানায় ফেলে দিয়েছি।
সেতারা জামিলকে উদ্দেশ্য করে বলে, বাবা সংসার ঠিক রাখতে হলে তুই আবার বিয়ে কর।
নাহিদার বড় মেয়ে আফরিন বলে ওঠে, দাদি তুমি এ কি বললে? বাবাকে তুমি বিয়ে করতে বলছ?
তোর মায়ের যে অবস্থা তাতে সংসার তো আর নিপাত হতে দেওয়া যায় না।
দাদি সংসার তো আমি সামাল দিচ্ছি।
তা দিচ্ছিস। তোরও তো বিয়ে-শাদী হবে।
না, আমার বিয়ে-শাদির দরকার নেই। ছোট ভাই বোনদের রেখে আমি কোথায়ও যাব না।
নাতির কথায় সেতারা হাসি পায়, হ্যাঁ নাতিকে বিয়ে না দিয়ে ঘরের খুঁটি করে রাখবো। তোর মায়ের যে অবস্থা ভাল হওয়ার কোন লক্ষনই দেখিনা। ডাক্তার তো আর তারে কম দেখানো হলো না।
জামিল বলে, মা আমি বিয়ে করবো না। আমার সন্তানদের উপর সৎ মা অত্যাচার করুক তা আমি চাইনা। জামিল অফিসে যায়।
স্ত্রী নাহিদা অফিসে গিয়ে হাজির হয়। জামিল তুমি অফিস করেছো, ওদিকে বাচ্চাদের সামাল দিবে কে? জামিল ভাষাহারা। পাগল স্ত্রী না জানি অফিসে কি কাণ্ড করে বসে। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। জামিল এদিক ওদিক তাকায়। অফিস কলিগ ফরহাদ বলে, ভাই ভাবিকে নিয়ে বাসায় যান। কি আর করা স্ত্রী যেমন করছে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। জামিল স্ত্রীকে বলে, এরকম পাগলামির মানে হয় নাকি?
আমার তোমাকে ছাড়া ভালোলাগে না। আমি চাই তুমি সবসময় আমার দু’চোখের সামনে থাকো।
জামিল বলে, ওরে আমার ভালোবাসারে।
কি বললে তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি না!
হ্যাঁ ভালো তো বাসো। জামিল কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকে।
আফরিনের বিয়ে হয়। মা পাগল। বাবা যায় অফিসে। দাদি এখন শয্যাশায়ী। সে চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে। ভাই-বোনদের কে দেখবে। আফরিন সিদ্ধান্ত নেয় ভাই- বোনদের সে নিজের কাছে রাখবে। এরপর তাদের নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখে। হঠাৎ একদিন আফরিনের কাছে ফোন আসে। তার মা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। এ কথা শুনে অস্থির আফরিন দ্রুত ছুটে আসে। অশ্রুসজল চোখে খরস্রোতা নদীর পাড়ে যায়। মাকে খুঁজে ফেরে নদীর বিশাল জলরাশির মাঝে। জামিল ডুবুরি দিয়ে স্ত্রী নাহিদার অনেক খোঁজ করে কিন্তু তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। স্ত্রী হারানোর হাহাকার বুকে চেপে রাখে জামিল। আবার তার বিয়ের কথা বললে সে এড়িয়ে যায়। বাকি জীবন একাই কাটাতে চায়।
ছোট মেয়ে রিয়া লেখাপড়ায় ভালো। ভার্সিটিতে পড়ে। রিয়ার ক্লাসমেট অপর্ণ, তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। প্রতিজ্ঞা করে চিরদিন অটুট থাকবে তাদের ভালোবাসা। দু’জন দু’জনকে ছাড়া অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী করবে না। রিয়া তার প্রতিজ্ঞায় অটল থাকলেও অপর্ণ হঠাৎ এক অজ্ঞাত কারণে পারিবারিক পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। ভালোবাসায় নিষ্ঠাবতী রিয়ার জীবনে এই ঘটনা দারুন মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনে। অপর্ণের ওয়াদা ভঙ্গ কিছুতেই সে মেনে নিতে পারে না। বারবার ভাবতে থাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেন তা ভঙ্গ করা হলো। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে সীমাহীন এক ব্যথার ভুবনে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে। খুঁজে পায়না সে নিজেকে নিজের মাঝে। চুপচাপ হয়ে যায়। মানসিক আঘাতে রিয়ার মধ্যে নিস্পৃহ অন্যমনস্কতা দেখা দেয়।
আফরিন বোনের পরিবর্তন লক্ষ্য করে চিন্তিত হয়। সিদ্ধান্ত নেয় বোনের বিয়ে দিবে। তাতে হয়তো মানসিক পরিবর্তন ঘটবে। বিয়ের জন্য ঘটক বশির উদ্দিনকে উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করতে বলে। বশির উদ্দিন একদিন পাত্রের সন্ধান নিয়ে আসে কিন্তু পাত্র বয়স্ক। পাত্র দেখে আফরিনের মেজাজ খারাপ হয়। ঘটককে বলে, আপনার মাথ ঠিক আছে। বশির উদ্দিন অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ঠিক আছে এ পাত্র যদি আপনাদের পছন্দ না হয় আরো পাত্র আছে। আমি আবার আপনাদের পছন্দসই পাত্র নিয়ে আসবো।
রিয়া হঠাৎ বলে উঠে, না আর কোন পাত্র আনতে হবে না। আমার এই পাত্রই পছন্দ হয়েছে। রিয়ার মনের ভাবনা বয়স্ক পাত্র হলে সে হয়ত তাকে ভালবাসবে। কম বয়সির দায়িত্বহীনতায় তার জীবন আজ তছনছ হয়ে গেছে। রিয়ার সিদ্ধান্ত বাবা জামিল আহমেদ আর বোন আফরিন মেনে নিতে চায় না। রিয়ার তার সিদ্ধান্তে অটল। বিয়ে যদি করতে হয় এই পাত্রকেই বিয়ে করবো। পরিবারকে একসময় রিয়ার জেদ মেনে নিতে হয়। বয়স্ক পাত্র মিলন সাহেবের সঙ্গে রিয়ার বিয়ে হয়। এত কিছুর পরেও রিয়ার মন যেন বারবার অপর্ণকে খুঁজে ফিরে।
মিলন বিয়েতে আনন্দ উৎসবের যথাসাধ্য আয়োজন করেছেন। বরের বাড়ির রঙিন আলোর ঝলকানি হট্টগোলের মধ্যে রিয়ার মনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সে ভারসাম্যহীন আচরণ শুরু করে। যাকে রীতিমতো পাগলামি বলা চলে। এতে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ঘাবড়ে যায়। সবাই অবাক। রিয়াকে বিয়ের আগে যেমন দেখেছে এখন দেখছে তার বিপরীত। মিলন তার শ্বশুরকে জানায় এমনকি তাকে সে দোষারোপ করে। আপনার মেয়ের এই অবস্থা আপনি আগে বলেননি কেন? জামিল আহমেদ এমন কথা শুনে অবাক হয়ে যায়! বাবা তুমি উত্তেজিত না হয়ে আমাকে সবকিছু খুলে বলো। মিলন শ্বশুরকে রিয়ার পরিবর্তনের সবকিছু জানায়। জামিল আহমেদ মেয়েকে দেখতে আসে। মেয়েকে দেখে তাঁর স্ত্রী নাহিদার রোগের কথা মনে পড়ে যায়। রিয়ার মা যেমন আচরণ করতো জামিল আহমেদ লক্ষ করে দেখে মেয়েও ঠিক সেই আচরণ করছে।
নিয়তির নির্মম পরিহাস। পাগল মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় পরিবারের যুদ্ধ। সম্ভাব্য সব উপায়ে মেয়ের চিকিৎসা চলে। কিন্তু চিকিৎসায় কোন কাজ হয় না। রিয়ার পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলে। মাঝে মাঝে সহ্যের সীমা অতিক্রম করতে থাকে। তাকে হাসপাতালে এমনকি পাগলা গারদেও রাখতে হয়। এই অবস্থায় একদিন মিলন শ্বশুর জামিল আহমেদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চায়!
আমি তোমাকে টাকা দিব কেন? বিয়ের সময় যা যা দেওয়া উচিত তার সবই আমি দিয়েছি। তারপর মেয়ে চিকিৎসা যাবতীয় খরচ বহন করছি। তুমি তো কোনো টাকা-পয়সা খরচ করছো না। উল্টা এসেছো আমার কাছে টাকা চাইতে!
আপনার পাগল মেয়েকে আমার কাছে বিয়ে দিয়েছেন। তার খেসারত আপনাকে টাকা দিয়ে গুনতে হবে। আপনার পাগল মেয়ের বিয়ে সংসার বজায় রাখতে চাইলে আমাকে টাকা দিতে হবে। জামাইয়ের কুটিল আচরণে জামিল আহমেদ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। একদিকে মেয়ের এই অবস্থা অন্যদিকে জামাই অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। দুদিন পর মিলন টাকার জন্য আবার শ্বশুরের কাছে হাজির হয়।
শ্বশুরকে বলে, আপনার কাছে আমার যে দেনা পাওনা আছে সেটা আমাকে বুঝিয়ে দেন।
তোমার আবার আমার সঙ্গে কিসের দেনা পাওনা?
সেদিন আপনাকে টাকার কথা বলেছি ওটা দিয়ে দেন। আমার সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হলে আমি যা বলি তা শোনেন। তাতে আপনাদের মঙ্গল হবে।
তোমার কথা বুঝতে হলে আমাকে আবার নতুন করে পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে। উপায়ন্তর না দেখে জামিল আহমেদ জামাইকে এক লক্ষ টাকা দেয়।
সামান্য টাকা! ঠিক আছে আপাতত এটাতেই চলবে বলে প্রস্থান করে মিলন। জামিল আহমেদের বুক ফেটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার মর্মযাতনা বাবাদের বোধহয় এভাবেই ভোগ করতে হয়। শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নিলেও মিলন স্ত্রীর প্রতি সামান্য দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে না।
রিয়া কিছুটা সুস্থ হয়ে বাবার বাড়ি আসে। এসেই স্বামীর বাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়ে। জামিল আহমেদ মেয়েকে স্বামীর বাড়ী নিয়ে যায়। মিলন স্ত্রীকে দেখে শ্বশুরকে বলে, আব্বা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন ভালো, সঙ্গে টাকা নিয়ে এসেছেন?
তোমার কি টাকা ছাড়া মুখে আর কোন কথা নেই।
আপনার মেয়ের স্বামী পরিচয় কি চান?
রিয়া স্বামীর কথায় আশ্চর্য হয়ে বলে, কি বললে তুমি! স্বামী পরিচয় চায় মানে কি?
তুমি এসব কথায় কান দিওনা। যা বলেছি তোমার বাবা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। আব্বা আমি যা বলেছি সে কথা মনে রেখেন।
কয়েকদিন পর রিয়া বাবাকে ফোন করে। বাবা তোমার জামাই যে টাকা চেয়েছে সেই টাকা তুমি তাকে দাও। জামিল আহমেদ বুঝতে পারে কি পরিমান মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে মেয়েটার উপর। মেয়ের কান্নাকাটি শুনে টাকা দিতে রাজি হয়। ঠিক আছে মা, টাকা ব্যবস্থা করেছি।
বড় মেয়ে আফরিন বলে, আব্বা আপনি মিলনকে আর টাকা দিবেন না। মেয়ের সুখ সুখ করে অনেক টাকা তাকে দিয়েছেন। রিয়ার চিকিৎসা সেবা-যত্ন আমরা করি । স্বামী হিসেবে সে তো কোন কর্তব্য করে না। দিনের পর দিন সে আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে।
মারে কি আর করা। মেয়েটা আমার পাগল ওর কোথাও তো চিন্তা করতে হবে! তবু ওর একটা সংসার আছে। সেই কথা ভেবেই মিলনকে টাকা দিয়ে যাচ্ছি। বিয়ে দেওয়া মেয়েকে বাপের ঘাড়ে রাখার কি যে যাতনা তা কি করে বোঝাই তোকে। লোকলজ্জা সমাজ এগুলো আমাকে শান্তি দেবেনা। আফরিন বাবার মনের অবস্থা দেখে চুপ হয়ে যায়। ঠিক আছে আব্বা আপনি যা ভালো মনে করেন। জামিল আহমেদ মেয়ের সুখের কথা ভেবে জামাইকে টাকা দেয়।
টাকার গুণেই হয়তো বেশ কিছুদিন রিয়া আর মিলনের সংসার ভালোভাবে চলে। তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। মেয়ের হওয়ার পর রিয়ার মধ্যে আগের অসুস্থতা আবার দেখা দেয়। পাগলামি বেশি বেড়ে গেলে আবার হসপিটালে রাখতে হয়। যথারীতি রিয়ার চিকিৎসার সমস্ত খরচ বাবা জামিল আহমেদকে বহন করে। মিলন স্ত্রীকে দেখতেও আসেনা। রিয়া বছরখানেক অসুস্থ থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়। সুস্থ হলে বরাবরের মত সে স্বামী বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল মর্মান্তিক ঘটনা। স্বামীর বাড়ি এসে দেখে তার স্বামী আবার বিয়ে করেছে।
মিলন স্ত্রী রিয়াকে দেখে বলে, তুমি এসেছ কেন?
এটা আমার স্বামীর বাড়ি আমিতো এখানে আসবই।
এখন আর আমি তোমার স্বামী নই। আমি বিয়ে করেছি।
তুমি বিয়ে করেছ?
তোমার মত পাগল নিয়ে সংসার করা যায় নাকি! আমার দরজা তোমার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ।
তুমি একবারও ভেবে দেখলে না আমাদের একটা মেয়ে আছে!
যা ভাবার ভেবেছি।
মিলনের নতুন বউ লাইজা শুনছিল তাদের কথা। সে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, আমি সতিনের ভাত খাব না। মিলন লাইজার মুখে এ কথা শুনে রিয়াকে বলে, তুমি এখান থেকে চলে যাও।
আমি এখান থেকে কোথায় যাব?
যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাও।
স্বামীর কথা শুনে চাপা কান্নায় বুক ভেঙে যায়। ছোট্ট মেয়েটি হাটি হাটি পা পা করে মায়ের কাছে এগিয়ে আসে। মাকে জড়িয়ে ধরে। রিয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাঁধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙে পড়ে। হঠাৎ মনে হয় কেউ যেন তাকে ডাকছে। মেয়েকে রেখে বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়। দৌড়ে নদীর ঘাটে যায়। মায়ের ডাক শুনতে পায় সে। রিয়া নদীর পাড়ে মা মা বলে কাঁদতে থাকে। মা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও বলে অকস্মাৎ নদীতে ঝাঁপ দেয় রিয়া। নদী থেকে রিয়া আর জেগে ওঠে না। খরস্রোতা নদীর বুকে ঘটে যায় আরেকটি সলিল সমাধি।
লেখক- সুলেখা আক্তার শান্তা