insert-headers-and-footers
domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init
action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121রমজান পাঁচ বছর পর জেল থেকে বের হয়ে কমলাপুরের দিকে রওনা হলো। তার জেল হয়েছিল সাত বছর। জেলখানায় ভালো আচরণ করার কারণে তার দুই বছরের সাজা মওকুফ হয়েছে। তাই পাঁচ বছরে মুক্তি। জেলে ঢোকার সময় যে কাপড়-চোপড় আর টাকা পয়সা ছিল সেগুলো ফেরত পেল। বিনা অপরাধে জেল খাটার কথা সে শুনেছে কিন্তু নিজের জীবনেই এমন ঘটনা ঘটবে তা সে ভাবিনি। তবে কি থেকে কি হয়ে গেল তার জীবনে। যাক এই ছিল কপালের লিখন। কিন্তু বরাবরই সে একজন ভালো মানুষ। জেলখানা পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে সে। উত্তরপাড়ার রোজিনাকে তার ভালো লাগতো। কথাটা মুখ ফুটে রোজিনাকে বলা হয়নি। কিছু না হলেও পড়ার মানুষের মুখে এ নিয়ে ছিল গুঞ্জন। রমজানের রাগ সিরাজ মেম্বার ও তার ক্যাডার নাসিমের উপর। নাসিম প্রায়ই রোজিনাকে উত্ত্যক্ত করতো। এ নিয়ে নাসিমের সঙ্গে রমজানের দ্বন্দ্ব হয়। নাসিম বলে রমজানকে, তুই আমার গায়ে হাত তুললি! তোকে আমি দেখে নেব।
যা তুই যা পারিস তাই করিস। আমি ভয় পাই না!
হঠাৎ একদিন রমজান শুনে রোজিনা খুন হয়েছে। রমজান সঙ্গে সঙ্গে রোজিনার বাড়ি যায়। রোজিনাকে খুনের দায় পুলিশ গ্রেফতার করে রমজানকে। রমজান পুলিশকে বলে, আপনি আমাকে গ্রেফতার করছেন কেন? আমি তো এই খুন করিনি!
পুলিশ বলে, খুন তুই করেছিস কিংবা করস নাই সেটা আদালতে প্রমাণ হবে। এরপর পুলিশ ধরে নিয়ে যায় রমজানকে। আদালতে সিরাজ ও নাসিমের মিথ্যা স্বাক্ষীতে রমজানের জেল হয়। নাসিম চোখ রাঙ্গিয়ে বলে, আমার গায়ে হাত তুলেছিল এবার জেলের ভিতরে থাক! বড্ড বেড়েছিলি!
চারদিকের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে রমজান আশ্চর্য হয়। লোক চলাচল বা সমাগম নাই। বিরান এক শহরের মধ্যে দিয়ে চলছে সে। করোনা মহামারীর কথা জেলখানায় শুনলেও এতটা খারাপ পরিস্থিতির কথা ভাবেনি। জনমানবহীন রাস্তা হঠাৎ দুই একটা রিকশায় এদিক-ওদিক চলছে। অনেক চেষ্টায় সে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে পৌঁছায়। দেশে যেতে চায় সে, প্রতিশোধ নেওয়ার আগুন জ্বলছে তার গায়ে। সিরাজ ও নাসিম দু’জনকে এবার শায়েস্তা করতে হবে। বিনা অপরাধে ওদের মিথ্যা সাক্ষীর জন্য আমার সাজা ভোগ করতে হলো। ঢিলেঢালা প্রহরার মধ্যে স্টেশনে ঢুকে পড়ে। ট্রেন চলাচল বন্ধ। বিরাট স্টেশনে মানুষের নিরব উপস্থিতিতে কুকুরের সরব উপস্থিতি দৃশ্যমান। রাতে প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে শোয়ার ব্যবস্থা করে। এরপর ওইখানে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ মানুষের কথায় ঘুম ভেঙে যায়। রমজান খেয়াল করিনি এক মেয়ে তার পাশে এসে শুয়েছিল। সন্ডামার্কা লোকজন মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যেতে চায়। রমজানের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলে, আমাকে বাঁচাও। রমজান মেয়েটিকে লোকগুলোর কাছ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। লোকগুলো চেঁচিয়ে বলে, আরে তুই আবার কে? সরে যা এখান থেকে। নয় তোর জান নিয়ে বাঁচতে পারবি না!
মেয়ে তারস্বরে রমজানকে দেখিয়ে বলে, উনি আমার স্বামী। মোটা গলায় একজন রমজানকে জিজ্ঞেস করে, কিরে এটা তোর বউ? ততক্ষণে পরিস্থিতি বুঝে গেছে রমজান। সে দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে বলে ফেললো, যে আমার পরিবার। লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলে, ধীরে ধীরে চলে যায়। মেয়েটির নাম রোকেয়া। তার সমস্ত অস্তিত্বে নিরাপদ আশ্রয়ের এক প্রশান্তি যেন খোঁজে। সে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। এরপর রমজান ঘুমিয়ে পরে। ঘুম ভাঙলে রমজান দেখে মেয়েটি একটু দূরত্ব রেখে কাছেই বসে আছে। পরে রমজান মনে মনে ভাবে মেয়েটির কথা। মেয়েটির মনে হয় আপন আশ্রয় নেই। মেয়েটি গায়ের রঙ শ্যামলা। নাম তার রোকেয়া। রমজান প্রতিদিন খবর নেয়। ট্রেন চলাচলের খবর কেউ বলতে পারেনা। রমজানের হাঁপানির ভাব আছে। জেলখানার ডাক্তার সাহেবে কিছু ওষুধ দিয়েছিল তাও প্রায় শেষ। হাতে যা টাকা-পয়সা ছিল তাও শেষ। করোনার কারণে কাজকর্ম প্রায় নাই। ট্রেন গাড়ি ঘোড়া কবে চলবে তার কোন ঠিক নেই। একদিন রমজানের হাঁপানি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেল। মুখের মধ্যে শ্বাস কষ্টের স্প্রে মেশিন ইনহেলার ঢুকিয়ে বৃথা চাপাচাপি করে। ওতে ওষুধ শেষ হয়ে যাওয়ায় কোন কাজ হয়না। রোকেয়া এগিয়ে এলো। ওইটা তো শেষ আরেকটা কিনে আনো। রমজান বলে, কেনার টাকা নাই। আঁচলে সযত্নে রাখা টাকার অস্তিত্ব হাত দিয়ে অনুভব করে রোকেয়া। এরপর ইনহেলারটা দেখিয়ে ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনে সেটা। গলায় স্প্রে করায় রমজানের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে।
এভাবে দু’জন চলতে থাকে, মাঝেমধ্যে দু'একটি কথা হয়। সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। রোকেয়া ইটের চুলায় রান্না করে দু’জনের জন্য। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে যা পায় তা দিয়ে খাবার চলে।
রমজান বলে রোকেয়াকে, তুমি আমার জন্য যা করছো এর প্রতিদান কিভাবে দিবো!
প্রতিদান যদি দিতে চাও? তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করো।
আমি করবো বিয়ে? যার চালচুলো কিছুই নেই!
তোমার তো কেউ নেই আমারও কেউ নেই। এই পৃথিবীতে আমাদের দু’জনের আপন কেউ নেই। আজ থেকে আমরা দু’জন দু’জনের আপন হয়ে এক পথে চলবো। এরপর দুজনে বিয়ে করে। কদিন পর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে রমজানের। রোকেয়া ওষুধের দোকানীকে বলে, ওষুধ নিয়ে আসে। তার প্রাণান্ত শুশ্রূষায় অবস্থার কোন উন্নতি হয় না। রোকেয়া বুঝতে পারে খোলা আকাশের নিচে এই রোগীকে রাখা সম্ভব নয়। উপায়ন্তর না পেয়ে সে দিশেহারা হয়ে পরে। এই রোগীকে নিয়ে সে কোথায় দাঁড়াবে। অনেক চেষ্টায় এক বিল্ডিংয়ে পাশে আশ্রয় নেয়। দারোয়ান মজিদ তাতে থাকতে দিতে রাজি হয়না। এরই মাঝে বাড়িওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখে হইচই। বাড়ির মালিক সাজেদ বলে, কি হইছে এখানে? এত হইচই কিসের?
রোকেয় বলে, ভাই দেখেন না। এই লোকটি আমাদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার স্বামীর অসুস্থ। তার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। নিরুপায় হয়ে আমি এখানে আশ্রয় নিয়েছি।
সাজেদের উওর, চাইলে তো আর আশ্রয় পাওয়া যায় না। দিনকাল যা পড়েছে।
রোকেয় বলে সাজেদকে, ভাই আজ যদি আপনার বোন আশ্রয় চাই তো। আপনি কি পারতেন আপনার বোনকে ফিরিয়ে দিতে? এই কথায় সাজেদের মন একটু নরম হয়। এখন চারিদিকে যে মহামারী করোনা এখন চাইলেও কেউ কারো আপন হতে পারে না!
ভাই আপনার বাড়িতে রুম তো খালি পড়ে আছে আমাকে একটা রুম ভাড়া দেন না। সাজেদ ভাবে এই করোনায় অনেক মানুষ বাসা ছেড়ে চলে গেছে একে যদি একটা রুম ভাড়া দিই তাও তো মাসে কিছু টাকা আসবে। সাজেদ দারোয়ান বলে মসজিদকে, তোমার পাশে রুম খালি পড়ে আছে, এদের কে একটি রুম ভাড়া দাও। মজিদ বাড়ির মালিকের আদেশ পেয়ে পাশের তালাবদ্ধ রুমটি খুলে দেয়। রোকেয়া খুশি হয় ভাবে যাক অবশেষে থাকার তো একটি স্থান পেলাম।
মজিদের স্ত্রী লায়লা রোকেয়াকে বাসা ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে না রাজ। মজিদ স্ত্রীকে বলে, বাড়ির মালিক যেখানে তার বাসা ভাড়া দিতে রাজি সেখানে আমি না বলি কিভাবে?
উনার স্বামী কি অসুখ হয়েছে তাতো বোঝা যাচ্ছে না। যদি করোনা হয়ে থাকে এতে তো আমরাও আক্রান্ত হব! তুমি এদেরকে এখানে কিছুতেই রাখতে পারবে না। চারিদিকে যে অবস্থা করোনার। এখন কেউ কারো আপন হতে পারে না! আমি যা বলি তা তুমি শোনো? আমাদের একমাত্র সন্তান আরিফের কথা ভেবে দেখে।
দেখো আমি তোমার কথা বুঝি। কিন্তু তারপরও আমরা যদি একে অপরের বিপদে সহযোগিতার হাত না বাড়াই। মজিদের মুখের পুরো কথা শেষ না হতেই।
লায়লা তার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে, তোমারি নীতিবাক্য কথা বন্ধ করো। বাড়িওয়ালা কে বলো তুমি এদের করোনা হয়েছে!
তুমি যাই বলো এই দুটো মানুষকে আমি বিপদের মুখে ফেলতে পারব না। আর বাড়িওয়ালা তাদের এই অবস্থা দেখেই ভাড়া দিয়েছে।
ঠিক আছে, তোমার তাদের রাখতে ইচ্ছে করে রাখ। এদের কারণে আমার আর আমার সন্তানের যাতে কিছু না হয়!
মজিদ বউয়ের কথায় বলে, এ কি কথা বললে তুমি? বিপদ-আপদ, রোগ এতো কাউকে বলে কয়ে আসেনা !
রমজানের অসুস্থতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। মজিদ ক্রমাবনতি দেখে ঘাবড়ে যায়। ভাবে, করোনার মধ্যে ওই লোকের মৃত্যুর কি ভয়ংকর ব্যাপার হবে! রমজানের মাঝরাতে অবস্থা খুব খারাপ হলে মজিদ বলে, ওকে বাঁচাতে হলে এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার। এখন করোনা টেস্ট করা না থাকলে কোন হাসপাতালে ভর্তি নেয় না। আর এখন মরলে দাফনের লোকও খুঁজে পাওয়া যায় না। রমজানকে বাঁচাতেই হবে। রোকেয়া স্বামীকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠে। রমজানকে হাসপাতলে নিতে হবে। রোকেয়া স্বামীর জন্য ক্ষোভে দুঃখের চিৎকার করে ওঠে।
লায়লা বলে রোকেয়াকে, সর্বনাশ করতে এখানে এসেছিস? এখন না জানি আমাদের কি হয়!
লায়লা কথায় রোকেয়া ভয়ে আতঙ্কিত হয়, স্বামীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গাড়ির খোঁজ করে। কিন্তু কোন গাড়ি যেতে রাজি হয় না। অসুস্থ রোগী দেখে ড্রাইভার ভাবে কোরোনা ভাইরাসে যে ছড়াছড়ি। অনেক অনুরোধে করার পর ড্রাইভার রাজি হয়। কোনরকমে রমজানকে গাড়িতে তুলে জনমানবহীন রাস্তায় চলতে থাকে। হাসপাতালে গেটে তাদের থামিয়ে করোনা টেস্টর কাগজ চায়। বাদানুবাদের মধ্যেই রমজানকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে সমস্ত প্রচেষ্টা করে। একপর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে সক্ষম হয়। সিট না পেলেও হাসপাতালের ফ্লোরে এক কোণে জায়গা হয়। রমজানের শারীরিক পরীক্ষায় জানতে পারে তার করোনা হয়েছে।
এদিকে মজিদের ছেলে আরিফের ভীষণ জ্বর। লায়লা কান্নাকাটি করে বলে, আজ আমার ছেলের এই দশা হয়েছে রোকেয়ার জন্য। ও যদি এখানে না আসতো, তাহলে আমার ছেলে এই অবস্থা হতো না। আরিফকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার সমস্ত কিছু পরীক্ষা করে জানতে পারে আরিফের করোনা হয়েছে। চিকিৎসায় আরিফের কোন অগ্রগতি হয় না। শেষ পর্যায়ে আলিফের মৃত্যু হয়। ছেলের মৃত্যুতে লায়লা বুকফাটা চিৎকার করে। এই সর্বনাশী রোকেয়াকে জায়গা না দিলে আজ আমার ছেলের মৃত্যু হতো না। অপায়া অলক্ষীর জন্য আজ আমার সব শেষ হয়ে গেছে!
রমজান মারা যায়। মৃত রমজানকে হাসপাতাল থেকে বের করে। রোকেয়া লাশের জন্য কোন গাড়ি পাচ্ছিল না। পাশে দেখে একটি লোক ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাই আমার এই মৃত্যু লাশ কবরস্থান নিয়ে যাবেন?
ভ্যানের মালিক বলে, তুমি যদি আমার ভ্যানে মৃত্যু লাশ তুলে নিয়ে যেতে পারো কবরস্থানে তাহলে যাও। আমার ভ্যানের জন্য কোন আপত্তি নেই।
রোকেয়া তাই করে। ভ্যান চালিয়ে নিজেই ঠেলে ঠেলে গোরস্তানের পথ ধরে। নদীর ধার দিয়ে চলতে চলতে দেখে একটা দরজা নদীর পাড়ে ভাসছে। রমজানের লাশটা দরজার কপাট এর উপর তুলে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। পৃথিবীর প্রতি অনেক অভিমান আর অভিযোগ পানিতে ভেসে যা। রোকেয়া অশ্রুসজল চোখে ভাসমান লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবতে থাকে কখন পৃথিবী করোনার বিষমুক্ত হবে। অন্ধকার ভেদ করে পূর্ব আকাশে তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
কবি- সুলেখা আক্তার শান্তা