Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
প্রত্যাবর্তন-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

প্রত্যাবর্তন-সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক:

অকালে স্বামী মারা গেলো হঠাৎ করে। দুদিনের জ্বর একটু বুকে ব্যথা তারপরই সব শেষ। অকাল বৈধব্যের কালো ছায়ায় ঢেকে গেল তার জীবন। শুরু হলো দুই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম। দিন রাত কিভাবে যায় তা একমাত্র আল্লাহই জানে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেয় নাহিদা। আপন মনে কাজ করতে থাকে হঠাৎ পিছন থেকে আজগর এসে নাহিদাকে জড়িয়ে ধরে। স্বামীর মৃত্যুর পর অজগরের সঙ্গে পারিবারিক পূর্ব পরিচয়টি আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। নাহিদার গালমন্দ এবং ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় আজগরের তেমন কিছু আসে যায় না।
এমন করো কেন? আমি কি তোমার পর? তোমারে আমার ভালো লাগে।
নাহিদা উদ্ধত ঝাড়ু হাতে এগিয়ে যায়। এখান থেকে ভালোয় ভালোয় দূর হ। না হলে একদম ঝড়ু পেটা করে দূর করব।
আরে কত মেয়ের এরকম তেজ দেখলাম। পরে যায় পানির মত হইয়া। আর তোমারে তো আমি আদর সোহাগ করতে চাই।
আমি বুঝিছি তোর গায় ঝাড়ুর বাড়ি না পড়লে তুই যাবি না। এমন সময় কি হইছে, কি হইছে, বলে মায়া বাড়ির মধ্যে ঢুকে। অবস্থা বেগতিক দেখে আজগর সটকে পড়ে। নাহিদা ভেঙে পড়ে, আপা আর বলেন না এই আজগর আমাকে খুব জ্বালাতান করে! ব্যাপারটা বুঝতে পারে মায়া। হায়রে পুরুষ, শুধু যেন নারীর একতরফা ইজ্জতের ভয়। মেয়ে মানুষ দেখলেই যেন তাদের মাথা ঠিক থাকে না। আমি একটা কথা বলি তোকে? এই বিধবা ভাবে কেমনে থাকবি? সাথে আছে দু’টা মেয়ে। আজগর অজাগর হইয়া জানিনা কি করে বসে। এই জীবন থেকে মুক্তির একটা উপায় আছে। তুই আবার বিয়ে কর। আমার এক ভাই আছে জীবনে বিয়া শাদি করে নাই। বয়স কালে এক মেয়েকে ভালোবাসছিল। তারে জীবন সঙ্গী করতে পারে নাই। মেয়েটার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। সেই দুঃখে আমার ভাই আর বিয়ে-শাদী করে নাই। ভাইয়ের এখন বয়স হইছে শরীরটাও তেমন একটা ভালো না। ভাইকে রাজি করাইতে পারলে তোরে তার সঙ্গে বিয়া দিব। তাতে দুজনারই ভালো হবে।
না আপা আমি আর বিয়া শাদি করবো না।


মায়া নাহিদার মৃদু আপত্তি উপেক্ষা করে। আর না না বলিস না। দেখি ভাইকে যদি রাজি করাইতে পারি। আর দুনিয়ার হাভ ভাব তো জানিস একা সংগ্রাম করে টিকে থাকা খুব কষ্টকর! নাহিদার অসহায় অভিব্যক্তি, আপা আমার মাথায় কিছু খেলে না। সেই জন্যেই তো তোর কথা ভাইবা আমার মাথায় এই বুদ্ধি আসলো।
আপা আমার দুই মেয়ের চোখের সামনে অন্য পুরুষকে বিয়া করুম!
এই বিয়াতে তোর দুই মেয়ের ভবিষ্যতেও উজ্জ্বল হবে। নাহিদা ভাবে আসলে কথাটা ঠিক। অন্য পুরুষ চোখে পড়ার চেয়ে বিয়ে করে মান সম্মান নিয়া থাকা ভালো। নাহিদার বিয়ে হয়। স্বামী রফিকের আথিক অবস্থা ভালো কিন্তু শারীরিক অবস্থা ভাল না থাকায় মাঝেমধ্যে শয্যাশায়ী হতে হয়। রফিক এনি আর সেতুকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসে। দুই মেয়ের প্রতি তার দায়িত্ব কর্তব্যে কোন অবহেলা হয় না। অসুস্থ শরীরে সীমিত চলাফেরার মধ্যেও সে সেতুকে নিয়ে দোকানে নিয়ে এটা ওটা কিনে দেয়। খাওয়া-দাওয়ার সময় হলে নিজের কাছে ডেকে বসায়। স্নেহময় পিতার সমস্ত দায়িত্ব পালন করে। পিতৃ ছায়া বঞ্চিত কন্যাদের পূর্ণতা দেখে নাহিদা শান্তি পায়। মনে মনে ভাবে, আমার কপালে এত সুখ ছিল তা কখনও কল্পনা করিনি। নাহিদাকে বিস্মিত করে হঠৎ একদিন রফিক বলে, আমার বিষয় সম্পওি যা আছে তা আমি এনি আর সেতুর নামে করে দিতে চাই।
এ আপনি কি বলেন? আপনের বিষয় সম্পওি ওদের নামে দিবেন কেন? আর লোকজন শুনলেই বা কি বলবে।
লোকজোন কি বলবে? আমার সন্তানদের আমি সম্পওি দিবো তাতে কার কি আসে যায়?
আপনে ওদের অনেক ভালোবাসেন। বাবার ছায়া হয়ে পাশে আছেন এডাই কম কিসে?
বাবা যখন হয়েছি বাবার কাজটা আমি করে যেতে চাই! সন্তানে জন্য বাবার যা করে আমিও তাই করেতে চাই। আমার শরীরটা বেশি ভালো না কখন কি হয় তাও জানি না।
এতো ভাইবেন না। আপনে অনেকদিন বেঁচে থাকেন তাই আমি চাই।
মরতে কেউ চায় না সবাই বাঁচতে চায়। রফিক তার বিষয় সম্পওি মেয়ে এনি আর সেতুুর নামে লিখে দেয়। সন্তানদের সম্পওি দিয়ে সে মনে করে এখন তার পৈত্রিক দায়িত্ব পালন সার্থক হয়েছে। রফিকের ঘরে নাহিদার গর্ভে সন্তান আসে। তাতে রফিক খুব খুশি। রফিক খুশি হলেও সে বুঝতে পারে পৃথিবীতে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। সে এনি আর সেতুকে বলে মা আমার আর সময় নেই। তোরা তোর মা আর আমার এই সন্তানকে দেখে রাখিস। রফিক পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। নাহিদার গগনবিদারী আর্তনাদ, উপরওয়ালা এ কেমন বিচার! কেন এমন হলো। একই লেখা কতবার লিখেছো আমার ভাগ্যে। স্বামীর সুখ কেন আমার কপালে লেখ নাই। সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই তার বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো।
নাহিদার সন্তান পৃথিবীতে এলো। এনি আর সেতু প্রথম থেকেই নাহিদার সন্তানের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন। তারা মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে। এনি মাকে বলে, মা তোমার এই সন্তান আমাদের কেউ না! আমরা দু’বোন দুবোনের আপন। এছাড়া আমাদের আর কোন বোন নাই। নাহিদা আশ্চর্য হয়ে মেয়েকে বলে, এ তুই কি বলিস? এতো তোদেরই বোন!
আমাদের বোন হবে কেন? ওকি আমার বাবার ঘরে জন্ম নিয়েছে? আমরা দুই বোন দুই বোন আপন।
মেয়ের এমন কান্ডহীন কথা শুনে নাহিদা স্তব্ধ হয়ে যায়।
এনি দিন দিন বেপরয়া হয়ে যাচ্ছে। উদ্যত তার চলনবলন। এনির বেপরয়া চলন বলনের সঙ্গী বানায় ছোট বোন সেতুকে। মায়ের কোনো কাজে সহায়তা করেনা উপরন্ত অশান্তির সৃষ্টি করে। এমন কি ছোট বোন রিয়াকে কখনোই কোলে নেয় না। দিনে দিনে তাদের উদ্ধত এবং উশৃংখল আচরণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এনি যখন তখন বিভিন্ন ছেলে বন্ধু নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায় আর ছেলেদের পিছনে টাকা খরচ করে। মা কিছু বললে চেঁচিয়ে চরম অশান্তি সৃষ্টি করে। ছেলেদের সঙ্গে এনির বেপরোয়া ঘোরাফেরায় গার্জিয়ানরা মা নাহিদার কাছে অভিযোগ করে। এনির কারণে লোকজনের কাছে তার মান-সম্মান বিলিন হতে থাকে। এনি মায়ে শাসন বারন কিছুই মানে না। নাহিদা মায়ের অধিকার নিয়ে কিছু বললে এনি বলে, তুমি আমাকে শাসন করতে আসো না! তোমার শাসনের কোন অধিকার আছে? তুমি অন্য পুরুষকে বিয়ে করেছো!
এনি আমি তোর মা! তুই এসব কি বলছিস? আমি বিয়া করেছি তোদের ভালো রাখার জন্য। তোর বাবা কোন অর্থ সম্পদ রেখে যায় নাই। তাছাড়া মানুষের দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছিলাম না! আর তুই আমার মেয়ে হয়ে এ কথা বলছিস? নাহিদা ভাবে কেন এমন হচ্ছে তার জীবন! কেন তার নিজের মেয়ে তাকে বুঝে না। বিষনতায় আর হতাশায় তার মন ভরে উঠে।
এনির ছেলেদের পিছনে খরচের টাকা পরিমান বেড়ে যায়। বাড়তে থাকে বেপরয়া জীবন যাপনের মাত্রা। কোন নিষেধ উপদেশের ধার ধারে না। সেতুও ক্রমান্বয়ে এনির মত চলাফেরা শুরু করে।
নাহিদা বলে এনিকে, তুই আর বাড়ি থেকে বের হবি না। আর টাকাও পাবিনা।
টাকা পাবো না।
না, টাকা পাবি না।
কেন পাব না?
পাবি না বলেছি ব্যস। পাবি না।
আমার টাকা আমি নিব তাতে কার কি আসে যায়!
তোর টাকা মানে?
সম্পওি আমাদের দু’বোনের নামে। তার মানে টাকার মালিক আমরা। খরচ আমরা দু’বোনেই করবো।
সম্পওি যদি খরচ করতে হয় খরচ করবে রিয়া কারণ এই সম্পত্তি রিয়ার বাবার। রিয়ার বাবা তোদের সন্তান ভাবছিল। ভাবে নেই সে তোরা এমন অমানুষ হবি!
সম্পওি আমাদের নামে যখন এর মালিক শুধু আমরা। আর তুমি যদি বেশি বাড়াবাড়ি করো তাহলে তুমি এখানে থাকতে পারবা না। তোমাকে এখান থেকে বের করে দিবো!
আমাকে বের করে দিবি আমার স্বামীর বাড়ি থেকে? এই কথা বলে, নাহিদা চুপ করে থাকে। ভাবে মেয়েটা অমানুষে পরিণত হয়েছে। অমানুষের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। নাহিদা মানসিক আঘাত সইতে না পেরে অস্থুত হয়ে পড়ে। তখন এনি মাকে সরাসরি বলেই ফেলে, তুমি এখানে থেকো না। তুমি তোমার মেয়ে রিয়াকে নিয়ে বের হয়ে যাও। তুমি এখানে থাকলে আমাদের দু’বোনের অশান্তি বাড়বে। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। আমাদের শান্তিতে থাকতে দাও। তুমি এখানে থাকাতে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষোভে অপমানে নাহিদা মেয়ে রিয়াকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

ভাগ্য হয়তো কিছুটা প্রসন্ন। একটি সিরামিক কোম্পানিতে চাকরি পায় নাহিদা। মেয়ে রিয়ার পড়া লেখা সংসারের খরচ চালাতে খুব কষ্ট হয়। সংসার খরচ চালিয়ে নিজের ঔষুধের টাকা আর অবশিষ্ট থাকে না। কষ্ট হলে তারপরও আমি ভালো আছি। অস্বস্তিকর পরিবেশ নাই। অপরের গঞ্জন চেয়ে আপনের গঞ্জনা বেশি মর্মান্তিক হয়। নাহিদা কয়েকদিন কাজে যেতে পারে না। অসুস্থ কারণে বিছানায় পড়ে আছে। ওষুধ না খাওয়ায় শরীরের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়। অবস্থা দেখে রিয়া ভাবে সে বোনদের কাছে যাবে। বোনদের কাছ থেকে কিছু টাকা এনে মায়ের চিকিৎসা করাবে। পরে ভাবে এমন অকৃতজ্ঞ বোনদের কাছে সে যাবেনা! পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে সে সংসারের হাল ধরতে চেষ্টা করে। কোনভাবে দিন পার হয় মা আর মেয়ের।
বিয়ার পড়ালেখা শেষ হয়। ব্যাংকে একটা চাকরি পায় সে। মেয়ের সাফল্যে নাহিদা খুশি হয়। ভাল পাত্র দেখে রিয়ার বিয়ে দেয়। সুখে-শান্তিতে কাটে তাদের দিন। একদিন নাহিদা মার্কেটে যায়। মার্কেট শেষে গাড়িতে উঠবে। এমন সময় মা মা বলে পেছন থেকে কেউ চিৎকার করে উঠে। একটি মেয়ে কাছে এসে নাহিদাকে জড়িয়ে ধরে। নাহিদা চমকে যায়। সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখে পরনের কাপড়ে অনেক ময়লা হাত মুখে অনেক কাটা দাগ। মুখ দেখে চেনার কোন উপায় নেই! মেয়েটি বলে ওঠে, মা আমি তোমার মেয়ে এনি আর ও সেতু। নাহিদার হৃদয় কেঁপে ওঠে। শত হলেও নিজের মেয়ে। এনি আর সেতু মায়ে পা জড়িয়ে ধরে। মা আমাদের মাফ করে দাও। আমরা তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছি। তাই আমাদের আজ এই অবস্থা। মা তোমাকে যেরকম আমরা ঠোকিয়ে ছিলাম! আমাদেরও সেভাবে ঠোকতে হয়েছে অন্যের কাছ। আমাদের দু’বোনকেই প্রতারণার শিকার হতে হয়েছে। ভালোবাসার অভিনয় করে আমাদের বিষয়-সম্পত্তি সব ওদের নামে লিখে নিয়েছি। বিয়ে করবে করবে বলে বিয়েও করেনি। সম্পত্তি করায়ত্ত হলে আমাদের মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমরা রাস্তায় মানুষের মাল টানি। তা দিয়ে যে টাকা হয়, তাতে দু’জনের খাওয়া-দাওয়া হয়। আর আমরা রাস্তায় ঘুমাই। আমাদের রক্ষা করো মা। মায়ের মন সন্তানের দুর্দশায় কেঁদে ওঠে। মা তো পারেনা সন্তানকে ফেলে দিতে। নাহিদা এনি আর সেতুকে বাসায় নিয়ে আসে। এনি আর সেতু মা ও বোন বিয়ার সুখ আর বাসার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যায়। রিয়া দুই বোনকে সাদরে বরণ করে। নাহিদা ভাবে মানুষ সময় থাকতে বুঝে না। সময় অতিক্রম করলে বুঝে। তবে সবার বেলায় নয়। কিছু মানুষের বেলায় এমনটি ঘটে।