Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
ত্রয়ী বিগ্রহ-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

ত্রয়ী বিগ্রহ-সুলেখা আক্তার শান্তা

মেয়েকে রেখে এসে রেহেনা হৃদয় বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাত আসমান থেকে সাত জমিন পর্যন্ত যেন এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় সেই দীর্ঘশ্বাসের বায়ু তরঙ্গে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন কেঁপে ওঠে আহাজারির মর্মান্তিক প্রলাপে। হায়রে কপাল আমার। রেহেনারা ভাগ্যকে বলে কপাল। মানুষের এককাল দুঃখ করে আরেক কাল সুখ হয়। রেহেনা কোনোকালেই সুখ হলো না। বাড়ি বাড়ি ঝি-এর কাজ করে সে। বাড়ির লোকজন কাজের লোকদের বুয়া বলে। অসম্মানটাকে ঢেকে রাখার জন্য বোধ হয় এমন পদবী সৃষ্টি করা হয়েছে। রেহেনার তাই মনে হয়। কাজের দীর্ঘ জীবনে সে হারে হারে টের পেয়েছে সেটা। রেগে গেলে এ কাজকে বান্দিগিরি বলে সে। আগে দুই এক বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানো যেত। এখন চারটা বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এক বাড়ির কাজ শেষ হলে দৌড়াতে হয় আরেক বাড়ি। কোথায় দু’ঘণ্টা কোথায় তিন ঘন্টা সময় ভাগ করা আছে। কাজের লোকের বড় অভাব। বাসাবাড়িতে এখন আর কেউ কাজ করতে চায়না। কাকডাকা ভোরে শুরু হয় তার কাজ। শেষ হয় সন্ধ্যা নামার পর। প্রতিদিন সপ্তাহ মাস বছর বিরামহীন।
রেহেনার মেয়ে সোনিয়া। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তারপর আর এগোয়নি। সাংসারিক অভাব অনটনের মাঝেও রেহেনা মেয়ের পড়ার খরচ চালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। সোনিয়ার অনাগ্রহের কারণে পড়ালেখায় ছেদ পড়ে। সোনিয়া পছন্দ করে রতনকে। মেয়ের এ বিষয়টি রেহেনার চোখে ধরা পড়ে। ছেলেটি পড়ালেখা তেমন করেনি, বেকার। কিন্তু দেখতে-শুনতে ভালো। যে মেয়েরা পুরুষের রূপ দেখে ভুলে যায় রেহেনা দু’চোখে তাদের দেখতে পারেনা। কিন্তু তার ভাগ্যেই ঘটলো এমন ঘটনা। রেহেনা আকার ইঙ্গিতে মেয়েকে বুঝিয়ে দেয় এভাবে চলবে না। সোনিয়া রতনকে বিয়ের কথা বলে। রতন বলে, আমি তো কিছু করিনা। কিছু না করে বিয়ে করি কি করে? সোনিয়া বলে, কিছু করার চেষ্টা করো। বিয়ে না করলে মা অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেবে। মেয়ের জীবনে ভালোবাসার সংকটকাল দেখে রেহেনার মনে আঘাত লাগে। সমাধানের একটা উপায় খুঁজতে থাকে সে। গরিবের দুঃখ কষ্ট বোঝে এমন এক বাসায় সাহেবকে ধরে রতনের একটা চাকরির জন্য। চাকুরী তো মুখের কথা নয়। তবে তিনি একটা উপায় বলে দিয়েন। জামাইকে ড্রাইভিং শিখতে বলো, ড্রাইভিং শিখলে চাকুরী দিয়ে দেওয়া যাবে। রেহেনা ভাবে পরামর্শটা মন্দ নয়। সে অনেক ড্রাইভারকে ভরপুর সংসারে স্ত্রী সন্তান নিয়ে মর্যাদার জীবন যাপন করতে দেখেছে। রেহেনা মেয়ের জন্য একটা মর্যাদার জীবন চায়। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে বলা সহজ হলেও কাজটা করা খুব সহজ নয়। ড্রাইভিং শেখা, লাইসেন্স করা বেশ সময় সাপেক্ষ লম্বা প্রক্রিয়া। টাকা পয়সা এবং সময় দুটোই যথেষ্ট প্রয়োজন।
সোনিয়া বিষয়টা নিয়ে খুব আশাবাদী হয়। সে রতনকে জানায়। রতন ড্রাইভিং শিখতে রাজি হয়। তার জীবিকার স্বপ্ন একটা ঠাঁই খুঁজে পায়। সোনিয়া আর রতনের বিয়ে হয়। মেয়ের সুখের জন্য রেহেনা সঞ্চয় এবং সামর্থের পুরোটা ব্যয় করে রতনের পেছনে। মেয়ে জামাইকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে স্বপ্ন সফল হয় রেহেনার। ড্রাইভিং শিখি একটা চাকরি পায় জামাই। ভালোই চলতে থাকে রতনের সংসার। কিছুদিন পর রতন সোনিয়াকে বলে পরের গাড়ি চালাতে আর ভালো লাগছে না। একটা গাড়ি কিনতে চাই। গাড়ি থাকলে ইনকাম আরো বেশি হতো। সোনিয়া আশ্চর্য হয়ে বলে, তা হতো হয়তো কিন্তু গাড়ি কিনাবা কি দিয়া, টাকা কই! রতন বলে তোমার মাকে বলে দেখনা। মা কাছে যে টাকা ছিল সবই তো তোমাকে দিয়েছে। মার কাছে এখন কোন টাকা নাই। রতনের মাথায় তখন গাড়ি কেনার চিন্তা। সে একটু ভেবে বলে, আমরা সমিতির কাছ থেকে ঋণ লোন নিতে পারি।
সোনিয়া স্বামীর কথায় মাকে রাজি করায়। রেহেনা আর সোনিয়া নামে ঋণ সমিতি থেকে লোন নেওয়া হয়। সঙ্গে আরো কিছু টাকা ধার দেনা করে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনা হয়। রতন কিছুদিন ভালোই গাড়ি চালায়। এরপর রতনের মধ্যে ঘটতে থাকে পরিবর্তন। অনেক বন্ধু জোটে যায় তার। তাদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকে সারাদিন। একদিন গাড়ি চালালে দুদিন শুয়ে বসে কাটায়। কাজকর্মে অনীহা। গাড়ি চালাতে ভালো লাগে না। সে সর্বনাশা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। সোনিয়া কোন কিছু জানতে চাইলে ক্ষেপে ওঠে।
তুই আমার কাছে কৈফত চাও?
আমি তাই চাই। সোনিয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।
সংসার খরচ দাও না। তার ওপর গাড়ির লোনের টাকা জমে আছে। যে পুরুষ স্ত্রী ভরণপোষণের টাকা জোগাড় করতে পারে না তার বিয়ে করা উচিত না।
রতন ক্ষিপ্ত হয়ে সোনিয়ার গায়ে হাত তোলে। সোনিয়ার কাধে সব দায়ভার চাপে। সোনিয়া অস্থির হয়ে পড়ে। লোনের টাকা সে কি করে পরিশোধ করবে। মায়ের কাছে সব কথা বলে। মা ভেবে পাইনা কি করব। একদিকে গাড়ির লোন আরেকদিকে বাসা ভাড়া জমে আছে। কি করে এই টাকা আমি পরিশোধ করব। স্বামী আমার নেশায় আসক্ত। ওর এখন বোধশক্তি কিছুই নাই।
এমন নেশাখোর স্বামীর সাথে তোর সংসার করার দরকার কি?
সোনিয়া আহত কন্ঠে বলে, মা বাবাও তো তোমার প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। তার জন্য কি তুমি সংসার ছেড়ে দিয়েছো।
রেহেনা মেয়ের এমন কথায় চুপ হয়ে থাকে।
ভাবলাম মেয়েটার বিয়ে দিলে সুখে-শান্তিতে কাটবে দিন। টাকা-পয়সা জমানো যা ছিল সবই খরচ করলাম মেয়ের জামাইয়ের পিছনে। টাকার চাহিদা তার দিন দিন বাড়ছেই। এবার সে শেষ অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। টাকা দেন না হয় আপনার মেয়েকে নিয়ে সংসার করবো না। মেয়ের সংসার হারানোর ভয়ে টাকা-পয়সা যা হয় তা সবই তুলে দেই জামাই হাতে। এখন এই বুড়া বয়সে পারিনা আর কাজ কাম করতে। আরাম-আয়াশের বালাই নাই কপালে। সারাটা জীবন থাকলাম দৌড়ের উপর। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই মানুষের বাসায় কাজের জন্য ছুটি আর আমার কাজ শেষ হয় সূর্য ডোবার পর। কাজ করতে গিয়ে হাত-পা সঙ্গে আছে কিনা তার দিকে খেয়াল করি না। সারাদিন কাজ করে পার করি দিন। নির্বোধ স্বামী কপালে জুটেছে। একটা সান্তনাও তার কাছ থেকে পাইনা। তার যত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আছে। সব মিটাতে চায় আমাকে দিয়ে। কাজ করি সুখ শান্তির জন্য। বাসায় কাজ করতে করতে এভাবেই জীবন যাবে আমার।
রেহেনার মা নুরুন্নাহার। বয়স হয়েছে। ভিটেমাটি নদীর করাল গ্রাসে বিলীন হলে অল্প বয়সের শহরে আসে। রিকশাচালক স্বামী একদিন ফেলে রেখে যেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে। রেহেনা তখন ছোট এক বছরের। বাচ্চা কোলে করেই শুরু করতে হয় জীবন সংগ্রাম। বাঁচার তাগিদে শুরু করে সহজ পেশা বাসা বাড়ির কাজ। সেই থেকে অবিরাম কাজ করে চলেছে নুরুন্নাহার। লোকে তাকে ডাকে রেহেনার মা বলে। নিজের আর মেয়ের জীবনের সমপরিণতি তার মনে দুঃখের বোঝা হয়ে আছে। জীবনে আশার আলো দেখা দিয়েও অন্ধকার নেমে আসায় আরও গভীর হয় সেই দুঃখ। রেহেনা মাকে বলে, মা তোমার জন্য দুঃখে আমার বুকটা ফাইটা যায়। তোমার বয়স হইছে পারিনা তোমারে বসাইয়া খাওয়াইতে। কি করি, স্বামী থাইকাও নাই। হাত-পা গুটাইয়া বইসা থাকে। সংসারের কোন দায়িত্ব কোনো কালেই নিলোনা। বউয়ের কামাই খাইয়াই তার জীবন কাটল। নুরুন্নাহার মেয়েকে বলে, তোর আর আমার কপাল একই কলমে কেমনে লেখা হইলো। প্রলাপ বকতে থাকে প্রলম্বিত দুর্ভাগ্যের ফিরিস্তি নিয়ে। দিন যায় রাত যায় গাধার খাটুনি খেটেও ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। যতই বলি এই পেশায় থাকবো না। নিয়তির লেখা। এই কাজ থেকে নিজেকে তো সরাতে পারলাম না গুষ্টিসুদ্ধ জড়িয়ে ফেললাম। পৃথিবীতে আমাদের জন্মই হয়েছে যেন এই কাজের জন্য। ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। সেই কোন কাল থেকে শুরু করেছি মানুষের দ্বারে দ্বারে কাজ করা এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মানুষের বাসায় কাজ করছি। ভাবছিলাম মেয়েকে দিয়ে কাজ করাবো না। তা আর পারলাম কই। আমার তো ওইটুক ক্ষমতা। মেয়ের অসহায় অবস্থা দেখে তাকে মানুষের বাসায় কাজে লাগাইয়া দিলাম। নিজের জীবন গেল মানুষের বাসায় দাসী বান্দি কাজ করে। মেয়েটার জীবনও গেল সেই কাজ করে। রেহেনা শুনছিল মায়ের আফসোসের কথাগুলো। একসময় কাতর কন্ঠে বলে, মা দুঃখ করোনা যা আছে কপালে লেখা তাইতো হবে।
টাকার জন্য রতনের অত্যাচার দিন দিন বাড়তে থাকে। সোনিয়া ঘরে টাকা রাখলে রতন তা খুঁজে বের করে নিয়ে যায়। নেশায় উন্মাদ হয়ে বউয়ের কাছে শুধু টাকা টাকা করে। টাকা না পেলে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে। চিৎকার চেঁচামেচি করে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি করে। চেঁচিয়ে সোনিয়ার চরিত্র নিয়ে কথা বলে। পুরুষ নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে আবহমানকাল যা করে এসেছে। আমাকে আর ভালো লাগে না পরপুরুষ নিয়ে ফস্টি-নস্টি করিস। টাকা দিস না কেন?
বাজে লোকরাই বাজে কথা বলে। ভালো মানুষ ভালো চিন্তা করে। বাসা ভাড়া বাঁকি দোকানে বাঁকি। গাড়ি কিনার জন্য যে লোন নিয়েছো সে কথা ভুলে গেছ। রোজ সমিতির লোক তাগিদায় আসছে। আমি এত কথা শুনতে চাই না। প্রতিদিন আমার টাকার দরকার যেখান থেকে পারিস ব্যবস্থা করে রাখবি।
নেশার কারণে রতনকে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। সোনিয়া ধারদেনা করে টাকা পয়সা জোগাড় করে। স্বামীকে ছাড়িয়ে আনে। রতন সোনিয়াকে বলে, তুমি ছিলে বলে জেল খাটা থেকে নিস্তার পেলাম। নয়তো দীর্ঘদিন জেলের ভাত খেতে হতো।
থাক আর প্রশংসা করতে হবে না। নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করোনা। এখন সবকিছু বাদ দিয়ে কাজ কর্ম করো। শত অনুনয় বিনয়ের পরও নেশা থেকে রতন বের হতে পারে না। নেশার টাকার জন্য সোনিয়াকে অত্যাচারের ওপর অত্যাচার করতে থাকে। অন্যদিকে আর্থিক সংকট দুর্গতি চরম সীমায় পৌছে যায়। তার উপর গর্ভে সন্তান এসেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় সোনিয়ার।
একদিন সোনিয়া কাতর কন্ঠে মাকে বলে, আর তো পারি না মা। এখন কি করি। মেয়ের কথা মর্মান্তিক আর্তনাদের মতো রেহেনার কানে বাজে। হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। নিজেকে সামলে প্রশ্ন করে, কি করতে চাস। সোনিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বলে, একটা কাজ চাই। কোনদিন কোন কাজ করতে দাও নাই তুমি। কোন কাজ জানা থাকলে করতাম। বাসা বাড়ির কাজ করতে চাই। রেহেনার মাথায় হঠাৎ বজ্রাঘাত হয়। ঢলে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। একেই বলে বিধিলিপি। ভাগ্যকে ঠিক মোহনায় নিয়ে এসে মিলিত করে।
মেয়ের জন্য এক বাসা বাড়িতে কাজের জোগাড় করে। মেয়েকে কাজে দিয়ে আসে। অন্তর ফেটে পড়ে নিরব আর্তনাদে। কে শুনবে তার ফরিয়াদ। এভাবে তিন প্রজন্মের তিন নারীর জীবন সংগ্রাম গাঁথা নিরব অলক্ষে হারিয়ে যাবে মহাকালের গর্ভে।
লেখক-সুলেখা আক্তার শান্তা