জীবন পথে-সুলেখা আক্তার শান্তা
”””””””””””””””””””””””””””””””””
এলাকার কোন লোক বাড়ির কাজ নির্মাণ করুক বা জমি বিক্রি করুক অনিক কে
মাস্তানির টেক্স দিয়ে তারপর তারা তাদের কাজ করতে হয়। যদি কেউ টেক্স না দেয় তাহলে
তার হাত-পা ভেঙ্গে পঙ্গু করে দেয় আর যদি অনিক কারো প্রতি বেশি ক্ষিপ্ত হয়
তাহলে তার হয় মৃত্যু। তবে অনিক কারো মৃত্যুর চেয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দিতে বেশি
পছন্দ করে। অনিক নিজের চিন্তা-চেতনায় রাজ্যে মশগুল থাকে। দেখতে অনেক সুদর্শন
সে। তাই চট করে মেয়েদের চোখের দৃষ্টি কাড়তে পারে। অনিকের স্বভাব যেমনই
হোক মেয়েদের প্রতি তার আচরণ অন্যরকম। মেয়েরা আকর্ষিত হলেও সে তাদের প্রতি
আকর্ষিত হয় না। মেয়েদের মোটেই পাত্তা দেয় না। কোন মেয়ে ভালোবাসার কথা
বললে অনিকের এক কথা আমার কাছ থেকে দূরে থাকো। অধিকাংশ সময়ই অনিকের
মুখে সিগারেট থাকে। সিগারেট মুখ দিয়ে বলে আমার কাছে ভেড়ার চেষ্টা
করোনা। পাত্তা না পেয়ে মেয়েরা উৎসাহ হারিয়ে চলে যায়।
অনিকের আপনজন বলতে আছে ভাই-ভাবি। ইনকামের পুরো টাকাটা ভাই-ভাবীর
হাতে তুলে দেয়। অনিকের সঙ্গী শাকিল ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে। একদিন বলে, আয়ের
সব টাকাই ভাই-ভাবীর হাতে তুলে দিচ্ছো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবো।
ভবিষ্যৎ আর কি! বেশ ভালোই তো চলছে। আমার হুকুমে সব চলে আর কি দরকার?
যখন দেখবা তোমার হুকুমে কিছুই চলে না তখন কি করবা?
তোর কি মনে হয় ক্ষমতার দাপট আমি কখনো ছাড়বো?
দিন সবসময় সমান যায় না। বয়স হলে তখন তো তোমার হুকুম কেউ মানবে না।
তখন তোমার জায়গায় আরেকজন দাঁড়াবে?
শোন বাঘ বাঘেই আর বিড়াল বিড়ালেই।
ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলে ভালো, তোমার উপর ভরসা করেই ক্ষমতার দাপট নিয়ে চলি।
কোথায় কত টাকা পাওয়া গেল শাকিলের কাছ থেকে তার হিসাব নেয়। অনিক সব
টাকা তুলে দেয় ভাই-ভাবীর হাতে। শাকিল বিষয়টা নিয়ে আবার কথা বলে। আমার
ভালো লাগছে না। বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা এনে দেও ভাবির কাছে।
ভাবি সেই টাকা দিয়ে তার বাবার বাড়ির লোকজন নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে, তার
নিজের নামে বাড়ি গাড়ি করেছে।
ভাবি তার বাবার বাড়ির লোকজনদের নিয়ে কত টাকা আর খরচ করবে। দৈনিক আমার
অফুরন্ত ইনকামের সামান্য অংশ মাত্র সেটা। শাকিল হাল ছেড়ে দেয়, তোমাকে বলে লাভ
নেই।
হঠাৎ একটি মেয়েকে ভালো লেগে যায় অনিকের। মেয়েটির কলেজে আসা যাওয়ার
পথে লক্ষ করে অনিক। অনিক মেয়েটিকে বলে, দেখো আমি ভঙ্গিতা করতে পছন্দ করি
না। আমি সরাসরি তোমাকে বলতে চাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
নাইজা স্তব্ধ হয়ে যায়। আপনার কারণে এলাকার মানুষ ভয়ে ভীত হয়ে থাকে। তাকে
আমি ভালোবাসব?
দেখো আমার কখনো কোন মেয়েকে ভালো লাগে নেই। এই প্রথম তোমাকে ভালো
লেগেছে। নাইজা স্বল্পভাষী স্বভাবের। কথা বলে খুব ধীরে ধীরে। সহজে মুখ থেকে কথা
বের হয় না। দশটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়। অনিকের এনিয়ে সমস্যা নাই। সে
বুঝে নেয় নাইজা অন্যসব মেয়ের মতো না। অনিক কোনভাবে তার প্রেমের
প্রস্তাবে নাইজাকে রাজী করাতে পারে না। অনিক ভাবে সব বিষয়ে জোর খাটালেও
নাইজার বিষয়ে জোর খাটাবো না। আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে নাইজার মন জয়
করব। অনিক নাইজার জন্মদিনের কথা জানতে পারে। বিরাট আয়োজন করে সে
কমিটিসেন্টার ভাড়া করে সেখানে বহু লোককে আমন্ত্রণ করে। কিন্তু নাইজা
সেখানে উপস্থিত হয় না। এতে অনিকের সঙ্গীরা ক্ষিপ্ত হয়। সবাই বলে বড়ভাই হুকুম
দেন আমরা ওকে তুলে নিয়ে আসি। অনিক সব ব্যাপারে হুট করে রাগ করলেও নাইজার
কোন ব্যাপারে রাগ করে না। নাইজার সব ব্যাপারে অনিকের মন থাকে শান্ত। অনিক
তারপরও নাইজার জন্মদিনের উপলক্ষে অনেক কিছু নিয়ে নাইজার সামনে হাজির।
নাইজা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে, আপনি কেন আমার সামনে এসেছে?
নাইজা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
একটা মাস্তান কে ভালোবাসবো আমি?
নাইজা কি করে আমার ভালোবাসার পরীক্ষা দেবো? নাইজা তুমি যদি বলো
নির্দ্বিধায় তোমার জন্য আমার একটা হাত কেটে দিতে পারব। তুমি যদি বলো,
তোমার জন্য দুটি পা কেটে দিতে আমিতা নিঃসংকোচে দিতে পারব। তুমি যদি
বলো, তোমার জন্য আমার দুটি চোখ উপড়ে ফেলতে পারবো সাগ্রহে, সারা জীবন
অন্ধ হয়ে থাকতে পারবো তোমার জন্য। তুমি যে পরীক্ষাই করো না কেন আমাকে
সেই পরীক্ষায় দিতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু তার বিনিময় আমি তোমার ভালোবাসা
চাই।
আমি কি ভালোবাসার বিক্রির দোকান নিয়ে বসেছিস? আপনি আসবেন
কিনতে আর আমি বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবো। নাইজা আর যাই হোক
পৃথিবীতে ভালোবাসায় বিক্রির দোকান নাই। তাহলে যারা ভালোবাসার কাঙ্গাল
তাদের অপূর্ণ স্বাধ পূর্ণ করার সুযোগ পেত। নাইজা তোমার ভালোবাসা দিয়ে
আমার নতুন ভুবন সাজাতে চাই।
শাকিল অনিকের পরিবর্তন দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। বলে, বড়ভাই আপনি কেন এমন
হয়ে গেলেন। কাজকর্মে মন নাই। শুধু ছুটে বেড়াচ্ছে ওই মেয়েটার পিছনে। কত
মেয়ে আপনার জন্য পাগল।
অনিক আনমনা হয়ে বলে, আমার এখন আর ওসব কাজ করতে ভালো লাগেনা।
বড়ভাই আপনি এটা বলেন কি? আপনি এমন করলে আপনার জায়গায় অন্য কেউ
দাঁড়িয়ে যাবে।
শাকিলকে থামিয়ে দেয়। ছুপ কর এসব প্যাঁচাল আমার ভালো লাগছে না।
নাইজার অনিকের জন্য একটু একটু মায়া হচ্ছে। জাগ্রত হয় নারী হৃদয়ের সহজাত
প্রবৃত্তি। নাইজা বলে, আমার ভালোবাসা পেতে হলে মাস্তানি ছেড়ে দিতে হবে।
তোমার একটা কেন হাজারটা শর্ত মানতে আমি প্রস্তুত। ছেড়ে দেবো মাস্তানি।
তবুও আমি তোমাকে পেতে চাই।
আপনি বিয়ের প্রস্তাব দেন আমার বাবা-মায়ের কাছে। নাইজার মুখ থেকে একথা
শোনার পর অনিক আনন্দে আত্মহারা। আমি আজকেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো
তোমাদের বাড়ি।
এত উতলা হওয়ার দরকার নেই, যা করার ধীরে সুস্থে করেন। নাইজা শান্ত গলায় বলে।
না, না আমি এই ব্যাপারে দেরি করতে চাইনা। অনিক ভাই-ভাবি দিয়ে বিয়ের
প্রস্তাব পাঠায় নাইজাদের বাড়িতে। যথারীতি নাইজার বাবা-মা অনিকের বিয়ের
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। নাইজার পিতা মহিউদ্দিন বলে, একজন মাস্তানের সঙ্গে
আমার মেয়ের বিয়ে দেবো। সমাজের যার নাম শুনলে মানুষ ভয়ে কাঁপে।
অনিকের বড়ভাই দিদার বলে, এবিয়ে না করার কি পরণিতি হতে পারে আপনি
জানেন?
নাইজার মা নাহিদা ভুরু কুঁচকে বলে, শোনো শোনো মাস্তান ভাইয়ের কথা,
পুরো গুষ্টিটাই মাস্তান।
মহিউদ্দিনের এক কথা আমরা আপনাদের সঙ্গে আত্মীয় করতে চাচ্ছিনা আপনারা
চলে যান। দিদার আর রুবি বাসায় এসে অপমানের কথা অনিককে জানায়। অনিক
মাথা নীচু করে বলে, তারা তাদের মেয়ের ব্যাপারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। একজন
মাস্তানের সঙ্গে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয়। রুবি পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করে।
বলে, অনিকের কোন অংশে কম আছে নাক? এর চেয়েও কত ভালো মেয়ে পাওয়া যাবে!
অনিক নাইজার কাছে যায়। নাইজা তুমি অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী করলে আমি
পাগল হয়ে যাব। আমি তোমার জন্য মাস্তানি ছেড়ে দিয়েছি।
সত্যি বলছো।
হ্যাঁ।
তাহলে আমরা একাই বিয়ে করবো। দু’জনে মিলে বিয়ের তারিখ ঠিক করে। সেই
তারিখে তারা দু’জনে বিয়ে করবে। নাইজাকে ছুঁয়ে অনিক আবার শপথ করে আর
কখনো মাস্তানি করবে না। নাইজা অনিকের বুকে মাথা রেখে বলে, বিশাল আকাশের
এক ভালোবাসা পেলাম। অনিক বিয়ের জন্য কেনাকাটা করে। অনিক আনন্দে ভাসতে
থাকে। আগামীর রঙিন স্বপ্ন বিভোর হয়। সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেতে
যাচ্ছে।
অকষ্মাৎ ঘাটে ভিন্ন ঘটনা। অনিক হঠাৎ শুনতে পায় তার ভালোবাসার মানুষ
নাইজার বিয়ে হচ্ছে অন্য কারো সাথে। তাদের বিয়ের জন্য যে তারিখ নির্দিষ্ট
করেছিল তার আগের দিন নাইজার অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। খবরটা শুনে
অনিকের হৃদপিÐ যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। সঙ্গীরা বলে বড়ভাই আপনার কি হইছে? আপনি
কিছু বলেন। অনিকের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। অনিক দৌড়ে নাইজাদের
বাড়ি সামনে যায়। দেখে সত্যি বাড়ির চারিদিকে অনেক লাইটিং আর বাড়ি
ভর্তি লোকজন নাইজার বিয়ে হয়ে গেছে। কনকে হাত ধরে গাড়িতে তুলছে।
চিৎকার করে অনিক বলে, এ কি দৃশ্য দেখলাম আমি!
শাকিল বলে, ভাই আপনি শান্ত হন। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে শাকিলের পথ
রুদ্ধ করে দাঁড়ায় অনিক। কঠিন স্বরে বলে, না। মানুষ শক্তি দিয়ে বাঁধা যায় কারো
মন শক্তি দিয়ে বাঁধা যায় না। আমি মাস্তানি করেছি কিন্তু কারো মন নিয়ে খেলি
নাই। ও আমার মন নিয়ে কেন খেললো। মাস্তান স¤্রাট কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
অনুশোচনা জাগে মনে। জীবনে অনেক পাপ করেছি এজন্য হয়তো আজ আমার
কাছ থেকে আমার ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেল। কি করে এর প্রায়শ্চিত্ত হবে।
অনিক সিদ্ধান্ত নেয় সে আর দেশে থাকবে না। অনিক সবকিছু গোছগাছ করে
বিদেশ চলে যায়। বিদেশে অনেক মেহনত করে টাকা রুজি করে। নিজের প্রয়োজনে
কিছু টাকা রেখে বাদবাকি টাকা ভাই-ভাবিকে পাঠিয়ে দেয়।
বিদেশে অনিকের সাথে দিনার পরিচয় হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ দিনা বিদেশ থাকে। সে
অনাথ। দেখতে শ্যামলা খুব সুন্দরী বলা যাবে না। দিনা খুব ধার্মিক মেয়ে। অনেক
ভালো মনের অধিকারী।
আলাপে পরিচয়ে দু’জন দ্#ু৩৯;জনার কাছে চলে আসে। একে অপরের সুখ দুঃখের কথা
বলে। দিনা অনিকের হৃদয়ের ক্ষত মুছে দিতে চেষ্টা করে। অনিক দিনার মাঝে আশ্রয়
খুঁজে পায়। দিনার সংস্পর্শে সে যেন নতুন মানুষের পরিণত হয়। অনিক সরাসরি
বিয়ের প্রস্তাব দেয় দিনাকে। দিনাও বিয়েতে মত দেয়। দু’জন বিয়ে করে দেশে
আসে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় অনিককের ভাই-ভাবী।
তার এ বিয়ে মেনে নিতে চায় না। তাদের চোখে দিনা দেখতে অসুন্দর কালো।
অনিকের মতো সুদর্শন ছেলের সঙ্গে এ মেয়েকে কিছুতেই মানায় না। তাছাড়া
মেয়ে আবার অনাথ। মূল কথা হচ্ছে অনিকের সঙ্গে সংসার হলে তারা আর টাকা-
পয়সা পাবে না। অনিক ক্রমান্বয়ে বাস্তবতা বুঝতে পারে। সে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়
তার জীবন সঙ্গী হয়ে দিনা আছে ভবিষ্যৎও থাকবে। দিনা কালো, ওকে আমি
দেখেশুনেই বিয়ে করেছি।
রুবি ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, কোন কূলে যার কেউ নেই এমন মেয়েকে নিয়ে সংসার করবা?
হ্যাঁ, অনিক বাইরে গেলে রুবি দিনাকে বলে, তুই এবাড়ির চাকরানি হয়ে
থাকবি। কাজের লোক যেরকম কাজ করে ভাত খায় তুইও এ সংসারের কাজ করে ভাত
খাবি। সংসার রক্ষার স্বার্থে দিনা সবকিছু মাথা পেতে নেয়। ভাবে অনিকের মতো
স্বামী পেয়েছে এতো তার সৌভাগ্য। অনিক ধীরে ধীরে গোপনে পারিবারিক
নির্যাতনের কথা বুঝতে পারে। ভাই ভাবীকে বলে আমি যে টাকা উপার্জন করি
তার সবই তো তোমাদের কাছে দিয়েছি। এখন আবার সংসার হয়েছে আমার
টাকা আমাকে দাও। টাকা চাওয়ার কথা শুনে রুবির গায়ে আগুন ধরে। সে টাকা এখন
আছে নাকি! তাতো শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই।
আমি দু’হাত ভরে টাকা কামিয়েছি তার সবটাই তোমাদের হাতে দিয়েছি। সব
করে নিয়েছো তোমরা তোমাদের নামে। যাক আমি আমার ভাগ্যকে বরণ করে নিলাম।
আমি মেহনত করে যে টাকা উপার্জন করবো তা দিয়েই আমি আমার বউকে
চালাবো। ভাগ্যবঞ্চিত একদা ত্রাস একটি মানুষ প্রায় শূন্য হাতে শুরু করে জীবন
সংগ্রাম। অনিক বাবার পৈত্রিক বাড়ির একটা ফ্লাট পায়। পাশাপাশি বাড়ি
নির্মাণের কন্ট্রাক্টরী শুরু করে। অনিক আর দিনা এক ছেলে এক মেয়ে। সুখে-
শান্তিতে তাদের দিন পার হয়। দুই নারীর প্রভাবে বদলে যায় এক দুর্ধর্ষ জীবন। তবে
ফেলে আসা অভিশপ্ত জীবনের স্মৃতি মাঝে মাঝে তাকে দহন করে হয়তো করবে
আমৃত্যু।
লেখক কবি সুলেখা আক্তার শান্তা