Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
অন্তরাত্মা-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

অন্তরাত্মা-সুলেখা আক্তার শান্তা

অন্তরাত্মা-সুলেখা আক্তার শান্তা

“””””””””””””””””””””””””””””””’

কথায় বলে, ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন। যেমন দুই ভাই জাবেদার আর দবির। হরিহর আত্মা। ভাইয়ে ভাইয়ে
খুবই মিল। এক ভাই কোন জিনিস খেলে অর্ধাংশ অপরজনের জন্য রেখে দেবে। তা সে যতই লোভনীয় হোক।
দুষ্টুমি দুরন্তপনার সবকিছুতেই দুজন সমভাগীদার। গাছে উঠে পাখির বাসায় দেখে দুটি পাখির ছানা। তখনো
উড়া শেখেনি। একটু নড়াচড়া করতে গিয়ে বাসা থেকে নিচে পড়ে যায়। দেখে দুই ভাইয়ের মন ভীষণ খারাপ
হয়। ছানাটি পাখির বাসায় তুলে রেখে আসে। দুই ভাইয়ের কৈশোর জীবনের দিন গুলি অনেক আনন্দে কাটে।
দুভাই বাড়ি ফিরলে মা জাহানারা আদর করে বলেন, আমার বাবাদের বাড়ির সব সময় হলো। আর কিছুক্ষণ
হলেই তো দিনটা শেষ হয়ে যেত। খাওয়া-দাওয়া নাই শুধু ঘুরে বেড়ালেই হবে?
দুভাই একসঙ্গে বলে ওঠে, মা জানো?
জাহানারা ছেলেদের থামিয়ে দেয়। আর জানতে হবে না দুজনে মিলে অনেক কাজ করেছ। মাছধরা দেখেছো,
পাখি দেখেছো, খেলেছো, আরো কত কি!
মা তুমি কি করে জানো?
এতো আমার ছেলেদের নিত্যদিনের কাজ। আমি সব জানি। কাল তোমাদের বাবা আসবে। তোমাদের জন্য
অনেক কিছু নিয়ে আসবে। তোমাদের অনেক ভালবাসবে।
মা বাবা খবর পাঠিয়েছে?
না। তোমাদের বাবা যে মাস বলে যায় আমি তার দিন-তারিখ গুনে রাখি। সেই হিসাবে তোমার বাবা কালা
আসবে। নাহিদা এতক্ষণ শুনছিল। গম্ভীর হয়ে বলে, মা বাবা কি জাবেদ আর দবিরকে ভালোবাসবে আমাকে
ভালোবাসবে না?
কে বললো তোমাকে ভালবাসে না! তোমার বাবা তোমারও অনেক ভালোবাসবে।

সাদিক আহমেদ বাড়িতে ঢুকেই বলে, আমার ছেলে মেয়ে কোথায়? ছেলে-মেয়েকে দেখে পরানটা জুড়িয়ে নেই।
ছেলে মেয়েও বাবাকে দেখে হইচই করে বাবা বাবা বলে উঠে। সাদিক আহমেদ বউকে বলেন, আসার পথে
বাজার সদাই নিয়ে এসেছি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ভালো-মন্দ খাব।
জাহানারা স্বামীকে বলেন, তুমি ছেলে-মেয়ের সাথে গল্পগুজব করো আমি রান্নাটা সেরে ফেলি। রান্না শেষে সবাই
মিলে তৃপ্তি সহকারে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে। শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর কাছে। আলহামদুলিল্লাহ।
সাদিক আহমেদ মুন্সি মানুষ লজিং মাস্টার থেকে বাচ্চাদের পড়ায়। থাকা-খাওয়া আর মাসিক একটা বেতন
পায়। রাতে ছেলে-মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে। জাহানারাকে বলেন, সারাদিন তোমার কত কাজ
করতে হয়।
আপনি কি যে বলেন, কি আর এমন কাজ করতে হয়!
ছেলে মেয়েকে সামলাতে হয়। বাজার ঘাট করতে হয়। আমি বাড়ি না থাকায় সবই তো তোমার করতে হয়।
এ আমার কাছে তেমন কিছু না। আপনিও তো অনেক কষ্ট করেন! ছেলে-মেয়ের মুখ দেখতে পান না। মানুষের
বাড়ি থাকেন কি খান না খান।
না বউ খাওয়া-দাওয়ায় আমার কোন কষ্ট হয়না। কষ্ট শুধু ছেলে-মেয়ে আর আমার লক্ষী বউয়ের মুখ খানা
দেখতে পাই না। এ ছাড়া আমার কোন কষ্ট নাই।

ছেলে-মেয়ে জন্য কষ্ট হয় তারা তো আপনার সন্তান। জাহানারা লাজুক ভাবে বলেন, আমার জন্য আপনের কষ্ট
হয়? সাদিক আহমেদ বউয়ের থুতনি ধরে বলেন, আমার সোনা বউয়ের জন্য মন আমার কেমন করে, তা বলে
বুঝাতে পারব না। জাহানারা মৃদু হেসে বলেন, আর বলতে হবে না। এখন ঘুমিয়ে পড়েন।

জাহানারা আর সাদিকের ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। মেয়ে নাহিদার বিয়ে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি থাকে। বড় ছেলে
জাবেদও বিয়ে করেছে। পুত্রবধূ লিমা খুব সাদামাটা মনের মানুষ। সংসার তেমন বোঝেনা। শাশুড়ি জাহানারা
বউকে সংসারের সব কাজ শিখিয়ে দেয়। লিমার মন চায় শুধু এঘরে ওঘরে ঘুরে বেড়াতে, গল্পগুজব করতে।
স্বামী জাবেদের সঙ্গে তেমন একটা কথা হয় না।
সাদিক আহমেদের বয়স হয়েছে। চোখে তেমন একটা দেখে না। ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জাবেদ আর দবির দুই
ভাইয়ের ছোটবেলার মিল সময়ের বিবর্তনে ফিকে হতে থাকে। দবির বড় হওয়ার পর আস্তে আস্তে নিজের বুঝেটা
একটু বেশি বুঝতে থাকে। খাওয়া পরা বেশভূষা সবক্ষেত্রে সে বেশির ভাগই নিজেকে এগিয়ে রাখে। আর
জাবেদের এসব বিষয়ে আগ্রহ নেই। জাবেদ বাবার জমি ক্ষেত আগলে রাখতে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। দবির কোন
কাজ করে না। এমন অবস্থায় সুন্দরী একটি মেয়েকে তার ঘরের বউ করে আনা হয়।
দবিরের স্ত্রী রাহেলা খুব চটপটে বুদ্ধিমতী। সংসার নিজ হাতে নিয়ে নেয়। জাবেদ আর দবির বিয়ে করলেও
তাদের একান্নবর্তী যৌথ সংসার। দবির একদিন বাবা-মাকে বলে একসঙ্গে সংসার করবে না, আলাদা হতে চায়।
জমিজমা যা আছে তা সব তার থাকবে। ভাই জাবেদ কাজ করতে পারে। ছোটবেলা থেকেই তার কাজ করার
অভ্যাস নাই।
জাহানারা ছেলেকে বলে, তুই এটা বলিস কি? বাবার সম্পত্তিতে সব সন্তানের সমান অধিকার। ভাই হয়ে ভাইয়ের
হক দিতে চাসনা। ভাইয়ে ভাইয়ে একসঙ্গে থাক সংসার ভাগ করবি কেন? সাদিক আহমেদ ছেলে দবিরের এমন
কথা শুনে চিন্তিত হয়। সংসারের অশান্তি থামাতে সে বিকল্প কিছু বলতে চায়। জাবেদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
বাবা দবির যখন আলাদা খাইতে চায়। দিন ওকে আলাদা হইতে, আমার বিষয়সম্পত্তি লাগবেনা। বাবা-মা
হিসেবে দোয়া করবেন। আপনারা সঙ্গে থাকলে তাতেই আমার চলবে।
দবির উত্তপ্ত সুরে বলে, বাবা-মা আমার সঙ্গে থাকবে।
রাহেলা স্বামীকে ফিসফিস করে বলে, এই তুমি বলো কি? বাবা-মা তার সঙ্গে নিতে চায়, নিতে দাও।
দবির স্ত্রীকে বলে, আরে তুমি বুঝবানা। বাবা-মা সঙ্গে থাকলে সম্পত্তি ভাইকে বঞ্চিত করে ভোগ করছি এনিয়ে
কেউ কানাঘুষা করবে না। রাহেলা খুশিমনে একটা হাসি দেয়।
জাবেদ ইট ভাটায় কাজ করে। কাজের মধ্যেই তার ভীষণ পেটে ব্যথা হয়। কাজের সঙ্গীরা জাবেদকে ধরাধরি
করে বাড়ি নিয়ে আসে। জাহানারা এই অবস্থা দেখে ছুটে আসে। কি হয়েছে আমার বাবার। ছেলেকে নিয়ে
ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার ঔষধ পত্র দেয়। তাতে কোন জাবেদের ব্যথার কোন উপশম হয় না। স্ত্রী লিমা
স্বামীর এই অবস্থায় নিরুদ্বিগ্ন। রান্না করা সন্তানদের সাথে সময় কাটানো এভাবে দিন পার করে সে। স্বামীকে
কখনো জিজ্ঞেস করে, ভাত খাবেন?
যদি না বলে। লিমাও জোর গলায় বলে না ভাত খান।

সাদিক আহমেদ চিন্তা করে, নিজের রুজি করার বয়স নাই। ছেলেটা চোখের সামনে রোগে ভোগে। কি করা
যায়। জমি যা ছিল তাতো ছোট ছেলে দবির বিক্রি করেছে। আছে এখন একখণ্ড জমি। সেটা বিক্রি করে বড়
ছেলের চিকিৎসা করাবে। তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দবির। সে জমি বিক্রি করতে দিবে না।
জাবেদ বলে, বাবা জমি বিক্রি করতে হবে না। এ জমিটুক শেষ সম্বল। এটা বিক্রি করলে আমার ভাই সংসার
চালাবে কি করে!

দবির ভাবে আমার ভাই আমার কথা এতো ভাবে। সে ভাই পেটে যন্ত্রণা এতো কাতরাচ্ছে। না, না। জমি তার
কাছে বড় না। দবির জমি বিক্রি করে মায়ের হাতে টাকা এনে দেয়।
রাহেলা স্বামীকে বলে, তুই এটা কি করলে? জমি বিক্রি করে দিলে। এখন সংসার কি করে চালাবা!
দবির বউকে ধমক দিয়ে বলে, আগে আমার ভাই। তারপর আমার অন্য কিছু। দবিরও ভাইয়ের চিকিৎসার
জন্য মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যায়। অনেক জায়গায় চিকিৎসা করানো পর ও জাবেদের পেটে ব্যথা ভালো
হয় না। চিকিৎসা করিয়ে হাতে যে টাকা ছিল সব শেষ হয়ে যায়। জাবেদ যখন ব্যথার যন্ত্রণায় চিৎকার করে
অনেকে আফসোস করে বলে, আহারে ছেলেটা ব্যথার যন্ত্রণায় কেমন ছটফট করছে! অনেকেই জাবেদকে দেখতে
আসে। জাবেদের পাশে বসে সান্ত্বনা দেয়। কেউ জাবেদের কষ্ট দেখে জাবেদের জন্য চোখের পানি ফেলে।
ব্যতিক্রমও আছে। পাশের বাড়ির এক চাচি জলি। সবার দোষ ধরতে সে দারুণ পটু। জাবেদকেও সে বাদ দেয়
না। ব্যঙ্গ করে বলে, জাবেদ কাউকে দেখলে ব্যথা যতটুকু না তার চেয়ে বেশি ঢং করে। অনেকে এর প্রতিবাদ
করে। এটা তুমি কি বললা? ছেলেটা অনেক বছর ধরে ব্যথার যন্ত্রণায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
মানুষকে নিয়ে মুখে যা আসে তাই বানিয়ে বলোনা!
অভাবে জর্জরিত সংসার। জাবেদ অসুস্থ হওয়ার পর কিছু খেতে চায় না। মাকে বলে, বাঁচব কিনা জানিনা।
মনটা চায় সবাইকে নিয়ে মাছ মাংস দিয়ে একসঙ্গে ভালো-মন্দ খাই। মায়ের মন সন্তানের কথায় আবেগি হয়ে।
চেষ্টা করে সন্তানের কথা কিভাবে পালন করা যায়। এ সময় গ্রামে মুরগির মড়ক শুরু হয়। একটু ঝিমিয়ে মুরগি
মারা যেতে থাকে। জাহানারা এক বাড়ি থেকে সেই ঝিমানো মুরগি সংগ্রহ করে। ব্যাপারটা দবিরের চোখে পড়ে।
মা তুমি এটা রাখো, দেখছি কি করা যায়।
জাহানারা জাবেদের বউকে নিয়ে মনে বড় ব্যথা। এমন অবস্থায় তার স্বামীর জন্য কোন উদ্বেগ নাই। কেউ কিছু
বললে বলে, চিন্তা করে কি হবে! যা হবার তাই হবে। চিন্তা করলে কি কপাল থেকে দুঃখ সরবে। দবির কাজের
সন্ধানে যায়। ভাইয়ের মতো নিজেও ইটের ভাটায় কাজ করে। কয়েকদিনের কাজের টাকা জমিয়ে সেই টাকায়
বাজার সদাই করে বাড়ি নিয়ে আসে। জাহানারা ছেলের বাজার-সদাই দেখে, খুশি মনে নিজেই রান্না করতে যায়।
রান্না শেষ করে সবাইকে খেতে দেয়। সবাই খেতে পারলেও জাবেদ খেতে পারেনা। তাদের কথা না খেতে খেতে
খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে। সে শুধু মিছরি পানি খায়। অনেকদিন বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না হয় নাই। সবাইকে
খেতে দেখে জাবেদের মনে শান্তি পেল। জাবেদ বলে দবিরকে, ভাই আমার কাছে আয়। এদিকে জাবেদের পেটে খুব
ব্যথা। দবিরের হাত দুটো ধরল জাবেদ দেখে দবিরের হাতে ফোসকা পড়ে আছে। ভাইয়ের হাতে চুমু দিলো,
জাবেদের দু’চোখের পানি দবিরের হাতে পড়লো। দবির ভাইকে বলে, এ কিছু না। তুমি সুস্থ হও এটাই আমার
বড় চাওয়া।
ভাই মানুষের অনেক আশা থাকে, সব আশাই কি পূর্ণ হয়। ভাই তোর কাছে আমার একটা চাওয়া। তুই আমার
সন্তানদের দেখিস। আমি তোর কাছে আমার সন্তান রেখে গেলাম।
তুমি একথা বলোনা! আমার ভাই বেঁচে থাকুক এ আমি চাই। আমরা দুভাই একসঙ্গে হাসবো আনন্দ করবো।
জাবেদ নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। ভোররাতের দিকে জাবেদ মাকে ডাকে। ঘুমের তন্দ্রা কেটে
জাহানারা বলে, এইতো বাবা আমি। দেখে ছেলের কোন সাড়াশব্দ নেই। জাহানারা বুঝতে পারে তাঁর নাড়ি ছেঁড়া
ধন আর নাই। উচ্চস্বরে বলে, তোমরা সবাই আসো আমার জাবেদকে দেখে যাও। সবাই চলে আসে জাবেদের
কাছে। কান্নার রোল পড়ে যায়। সাদিক আহমেদ আর জাহানারা বলেন, বাবা-মা জীবিত থাকতে ছেলের মৃত্যু
দেখা মর্মান্তিক। এ আঘাত আমরা কি করে সহ্য করবো। দবির ভাইয়ের জন্য পাগলের মতো হয়ে যায়। লিমা
একধ্যানে তাকিয়ে থাকে আর দু'চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। স্বামী জীবিত থাকাকালে মায়া না লাগলেও মৃত্যুর পর
স্বামীর জন্য তার হৃদয়টা ভেঙ্গে যায়।

দবির এখন নিয়মিত কাজ করে। ভাইয়ের বউ বাচ্চা, বাবা-মা, নিজের বউ সন্তান। অনেকগুলো মুখ তাকিয়ে
আছে তার দিকে। সকলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। নিজের সাধ্য অনুযায়ী চালাতে চেষ্টা করে সংসার।
দবিরের ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। ভাইয়ের সন্তানের মাঝেই ভাইকে খুঁজে পায়। এখানেই তার পরম শান্তি।
বিচিত্র মানুষের মন কখন কি রূপ ধারণ করে তার অন্তরাত্মাও সে হদিস পায় না।