মাওয়া ঘাটের বিরামহীন জনসমাগম আর কোলাহলের মাঝে তখন সামান্য একটু বিরতি। রফিক মিয়া উদাস নয়নে নদীর দিকে তাকায়। কদিন হলো কি যেন হয়েছে তাঁর। দীর্ঘশ্বাসে সারা জীবনের কষ্ট একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়। চোখের সামনে দিয়ে কত মানুষ এলো গেল কত কিছুর পরিবর্তন হলো। তাঁর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হলো না। এই নদী আর এই ঘাটে আটকে আছে তাঁর জীবন। অথচ এখানেই অনেক জীবনের উত্থান দেখেছে সে। দেখেছে অনেককে আয়-রোজগারে স্বাবলম্বী হতে। হায়রে নদী তোর ঢেউ বোঝা বড় মুশকিল! একেই বলে ভাগ্য। মাওয়া ঘাটের পাশে একটা ভাঙ্গা টুলে বসে বিড়বিড় করছিলো রফিক মিয়া।
ঘাটে একটা দোকান ছিল তাঁর। অভাবে পড়ে বেঁচে দিতে হয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে এখন ঘাটে কুলিগিরি করছে। মাওয়া ঘাটের লোকজন কম বেশি থাকে সবাই তাঁকে চেনে। মনসুর আহমেদ বললেন, কি রফিক মিয়া কি চিন্তা করো এখানে বইসা? এই মালগুলি লঞ্চে উঠিয়ে দাও।
জ্বি ভাই, জ্বি। দৌড়ে মালগুলি লঞ্চে তুলে দেয়। মাল টানা শেষে টাকা দেয়। রফিক মিয়া বেশি টাকা দেখে বলেন, আমার কাছেতো ভাংতি নাই!
মনসুর আহমেদ বলেন, তোমার বাদবাকি টাকা ফেরত দিতে হবেনা। রফিক মিয়া খুব আপত্তি জানায়। কেন আমি বেশি টাকা নিব কেন? যা পাওনা হয় তাই দেন। রফিক মিয়া টাকা ভাংতি করে নিজের টাকা রেখে বাদবাকি টাকা ফেরত দেয়। মনসুর আহমেদ বললেন, এইভাবে আর কত কাল কষ্ট করবা? তুমি তো কারো কাছ থেকে জোর করে কিছু নিচ্ছ না, মানুষ খুশি হইয়া যা দেয় তাই নিবা। রফিক বললেন, তাতে বদঅভ্যাসে পাইবো। গতর খাইটা কাজ করি। হক হালালি যেটুকু পাই তাতেই খুশি। আমার বাড়তি টাকার দরকার নাই।
এত নীতি দেখাও কেন? এই ঘাটে কম মানুষের হারানো জিনিসপত্র তুমি পাও নাই। সব মালিক খুঁজে ফেরত দিয়া দিছো। সেই সব জিনিস থাকলে আজ তুমি থাকতা রাজার হালে।
ওপরে আঙুল নির্দেশ করে রফিক মিয়া বলেন, আল্লাহ উপরে আছেন। তিনি দেখেন তাঁর চোখ দিয়ে। আমি তার বান্দা তাঁর কাছে হাত পাততে চাই। এছাড়া অন্য কারো কাছে না। মনসুর আহমেদকে ব্যবসার কাজে প্রায়ই ঢাকা যাতায়াত করতে হয়। মাল টানার জন্য রফিক মিয়াকেই ডাকেন। বখশিশ হিসাবে কখনো দুই টাকা বেশি তাঁকে ধরিয়ে দিতে পারেননি।
রফিক মিয়ার তিন ছেলে দুই মেয়ে। এক ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে রাসেল ও মেয়ে টুম্পা পড়াশোনা করে। রাসেল বাপের কষ্ট করা দেখে বলে, বাবা আমার পড়ালেখা শেষ হলে চাকরি করব তখন তোমার দুঃখ মুছে দেব। রফিক মিয়া ছেলের কথায় সান্তনা পেয়ে বলেন, বাবা আমার দুঃখ মুছতে হবে না তোরা শান্তিতে থাক তাই আমি চাই। যদি পারিস তোর মাকে একজোড়া বালা বানিয়ে দিস। রফিক মিয়া দোকান করার সময় স্ত্রী শাহানার বালা জোড়া বন্ধক রেখে ছিল। কখনো তা ফেরত আনাতে পারেনি। সে দুঃখ জমাট বেঁধে আছে মনে। শাহানা বলেন, আমার কিছু লাগবেনা দোয়া করি তোরা ভালো থাক। যদি পারিস তোর বাবার জন্য ভালো দেখে একটা পাঞ্জাবি কিনে দিস। শাহানার মনে লালিত ইচ্ছা স্বামী একটা দামি পাঞ্জাবি পড়াবেন। বড় সাধ তাঁর এমন দৃশ্য দেখার। রফিক মিয়া বললেন, না রে বাবা তোর মার কথা শুনিস না। টুম্পা বলে, বাবা তুমি থামো তো। বাবা-মা যেমন ছেলে-মেয়েকে সুখে রাখে তেমনি ছেলে-মেয়ের উচিত বাবা-মাকে সুখে রাখা। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা। শাহানা মেয়েকে বলেন হয়েছে। সবাই একসঙ্গে হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে। মা-বাবার একে অপরের প্রতি ঠান এবং ভালোবাসা দেখে সন্তানদের বুক ভরে ওঠে। রফিক মিয়ার অবান্তর কোনো চাওয়া-পাওয়া না থাকায় অল্পতেই সে সন্তুষ্ট। তাই কোন দুঃখ তাঁর উপর ভর করতে পারে না।
রাসেলের পড়াশোনা শেষে চাকুরি ঠিক হয়। তবে এক শর্তে। তাকে অনেক কিছু ছেড়ে কোনো কিছু পেতে হবে। হবু শ্বশুর মনতাজ উদ্দিনের তেমনই কথা। তোমার যে পরিবেশ, তোমার বাবা করে কুলিগিরি! সমাজে তোমার পরিবার নিয়ে মুখ দেখাবো কি করে! রাসেল হবু শশুরের শর্ত মেনে নেয়। সে ভাবে বাবা-মা তার জন্য কিছু করতে পারেনি। তাঁদের তেমন সামর্থ্য নাই। সম্পদের মধ্যে ওই এক বসতভিটা সেটা বিক্রি করলে বাবা মা থাকবে কোথায়! নিজের একটা গতি হলে তখন বাবা মাকে দেখা যাবে। রাসেল সিদ্ধান্ত বাবা-মাকে জানায়। রফিক মিয়া ছেলেকে বাধা দেয়। বলেন, বাবা তুই কি তাহলে বিক্রি হয়ে যাবি? আমি তো আমার ছেলে বিক্রি করব না! অনেক কষ্ট করে তোদের মানুষ করেছি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবি বলে। যতদিন বেঁচে আছি তোর এমন সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেব না! আমার মৃত্যুর পর এমন সিদ্ধান্ত নিস। রাসেল বাবার কোন কথাই শোনে না সে। সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। রফিক মিয়ার পিছু-ডাক অনুনয়-বিনয় ছেলের কানে পৌঁছায় না। রাসেলের বিয়ে হয় মনতাজ উদ্দিনের মেয়ে রিপার সঙ্গে। রাসেলের স্ত্রী রিপাও আসা হয় না শ্বশুর বাড়িতে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানেনা তার পুত্রবধু দেখতে কেমন। বাবা-মার মন তো কাঁদে তাদের সন্তানকে দেখার জন্য। কি করবে সন্তানকে না দেখার কষ্ট বুকেই চেপে রাখেন।
টুম্পার বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু পাত্রপক্ষের দাবিদাবা পূরণ না হলে বিয়ে হবে না। রফিক মিয়ার কুলিগিরির উপার্জনে টানাটানি সংসার। দাবি মেটাতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা পাবে কোথায়! বউয়ের সঙ্গে আলাপ করে, কি করা যায়? মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। একমাত্র সম্বল বসতভিটা। রফিক বলেন, বসতভিটা বিক্রি করে মেয়েকে বিয়ে দেবো। চমকে ওঠে শাহানা, বসতভিটা বিক্রি করলে থাকবো কোথায়? শেষ আশ্রয়টুকুও হারাবো! শোনো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কখনো আশ্রয়হীন করেন না। তিনি ব্যবস্থা করে দিবেন। টুম্পা বাবা মাকে বলে, তোমরা এই বিয়ে বন্ধ করো। আমি বিয়ে করব না। দরকার হয় আইবুড়ো হয়ে থাকবো। রফিক মিয়া চেঁচিয়ে ওঠেন, বাবা-মার উপর দিয়ে কথা বলে। কি করতে হবে না করতে হবে সেটা আমরা বুঝি। সম্পদ তো সন্তানদের জন্যই, এগুলো কি আমাদের সঙ্গে কবরে যাবে! তারপর নরম কন্ঠে বলেন, মারে আমাদের নিয়ে ভাবিস না। আমাদের এক ব্যবস্থা হবেই। রফিক মিয়া শেষ সম্বল বিক্রি করে বড় ছেলে আনিসের কাছে। বিচিত্র পৃথিবী তারও চেয়ে বিচিত্র স্বার্থের চেতনা। আনিস টাকা থাকতেও বড় ভাই হিসেবে দায়িত্ব পালন করে না বোনের। টুম্পা বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। এখন পড়ে থাকে বুড়োবুড়ি রফিক মিয়া ও তাঁর স্ত্রী শাহানা। আনিসের স্ত্রী কথায় কথায় খোঁটা দেয়, জায়গা কিনে শান্তি পাইলাম না! তোমার বাপ মা যে ঘরে থাকে ওইখানে ঘর না থাকলে আমি দুই পাঁচটা গাছ লাগাতে পারি! তরিতরকারি করলেও তো আমার সংসারে আয় বরকত হয়। ছেলেকে তো এমনি জায়গা দেয়নি টাকার বিনিময়ে জায়গা দিয়েছে। তাঁরা এখন এখানে কি করে থাকেন। রফিক মিয়া ও তার স্ত্রী শাহানা এই কথা শুনে কিন্তু কোনো প্রতি উত্তর করে না। ভাবে একটু জায়গা কিনে অন্য কোথাও চলে যাবে সেই সামর্থ্য নাই! বয়স হয়েছে। আগের মতো কাজ পাওয়া যায় না। বুড়ো মানুষ হিসাবে কেউ বোঝা বহনের কাজও দেয় না। ভাবে ফেলে দিবে। কেউ মায়া করে ভাবে বুড়ো মানুষ কি করে একে কাজ দেই!
রফিক মিয়া মাওয়া ঘাটে এসে ঘোরাফেরা করে। তাঁর অসহায় অবস্থা দেখে কেউ কিছু টাকা ধরিয়ে দিলে চিৎকার করে ওঠে। টাকা নেব না, আমি কি ভিক্ষুক? কাজ ছাড়া টাকা দিবা কেন? লোকজন বলেন, চাচামিঞা এত চেতেন কেন? টাকা তো আপনাকে খুশি হয়ে দিচ্ছে। রফিক মিয়ার এককথা, না আমার টাকা লাগবে না। যদি পারেন আমাকে কাজ দেন। আর না হয় থাক, এমন টাকার দরকার নেই।
ঘাট থেকে বাড়ি ফিরে রফিক। প্রচন্ড গরম। শাহানা স্বামীকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করেন। রফিক মিয়া স্ত্রীকে বললেন, কি বাতাস করো জোরে বাতাস করো আমার শরীরে মনে হয় আগুন জ্বালাই দিচ্ছে! শাহানা স্বামীকে বলেন, দই খাবেন?
দই পাবো কই?
আনিস দই আনছে। দেখি ছেলের কাছে চাইয়া। রফিক মিয়া চুপ করে থাকেন। শাহানা বড় ছেলের দোরগোড়ায় এগিয়ে যায়। বাহির থেকে ছেলেকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে। বউ রাহেলাকে বলেন, বৌমা, তোমার শ্বশুর গরমে ছটফট করে তাঁরে একটু দই দাও। ছেলে আনিস বলে, তোমরা কি পোলাপাইন হইছো? বাচ্চা দু’টার জন্য একটু দই আনছি, সেটাও তোমরা চাও! তা খাইয়া বাচ্চারা কখন শেষ করছে! রাহেলা শাশুড়িকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। দেখো তোমার মার জ্ঞান! নাতি নাতনির হাতে কিছু দিতে পারেনা! বাচ্চাদের জন্য ওদের বাবা একটু দই আনছে তা আবার ভাগ চাইতে আইছে। শাহানার দই চেয়ে বেকুব বনে যায়। কৃত্রিম হেসে বলেন, থাক বাবা লাগবেনা। আমার নাতিরা খেতে পারেলেই হলো। শাহানা স্বামীর কাছে এসে বললেন, গরমের মধ্যে দই খেতে হবে না! তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রফিক মিয়া বলেন, যাও ভাত বাড়ো। দু’জনে একত্রে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। রফিক আক্ষেপ করে বলেন, মারা গেলে মাটি দেওয়ার জায়গাতে থাকল না। রফিক মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে। হ্যাঁ যদি একটু জায়গা কিনতে পারতাম! তাহলে মনে আফসোস থাকতো না! বুড়া মানুষ দেইখা কেউ বোঝা দিতে চায়না। লোকজন ভাবে বোঝার ভারে না জানি আমার কি হয়! ঘাটের উদ্দেশ্যে বের হয় রফিক মিয়া। পথে তাঁর ভাবনা হয় শাহানার কি দই খেতে ইচ্ছা করেছিল। আজকে কাজে যা পাবে তাই দিয়ে বউয়ের জন্য দই কিনে নিয়ে যাবে। ভাগ্য প্রসন্ন ঘাটে এসে কয়েকটা কাজ পেল রফিক মিয়া। মহাআনন্দে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ঘাট থেকে লঞ্চে উঠার সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায় পানিতে। এমন বেকায়দায় পড়ে যে তাকে ধরাধরি করে টেনে তুলতে হয়। বেকায়দায় পড়ে যাওয়ায় তার পা ভেঙে যায়। এরপর থেকে রফিক মিয়াকে পড়ে থাকতে হয় বিছানায়। আগে তাও কমবেশি কাজ করতে পারেছে এখন তো শয্যাশায়ী। অবস্থা খুবই করুন দু’জনের ভাত জোটে না। রাহেলা এদিক সেদিক থেকে শাকপাতা যা তুলে আনেন তাই কোন রকম সেদ্ধ করে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে খায়। রাহেলা বলেন, আগেতো আবাদি জমি খালি ছিল অভাবী মানুষ শাকপাতার কচুঘেচু খুঁজে পাইত। মানুষ বাড়ায় এখন আর কোনো জমি খালি পড়ে থাকে না। এখন বন জঙ্গলে শাকপাতা খুঁজে পাওয়া যায় না। রফিক মিয়া বউকে বলেন, আমি যদি মারা যাই মাটি দেওয়ার তো জায়গা থাকলো না! আর আমার লাশ ছেলে-মেয়ের জন্য না রাইখা যত তাড়াতাড়ি পারো মাটি দিয়ে দেবা। মাটি দেওয়ার জায়গা যখন নাই। কলাগাছের ভেলায় আমার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিবা! শাহানা স্বামীর কথা শুনে দুই চোখের অশ্রু ছেড়ে দেয়। রফিক মিয়া মারা যান। শাহানা স্বামীর কথা মনে করে কাঁদে আর বলেন, মারা যাবেন তিনি মনে হয় বুঝতে পেরেছেন! তাই তিনি এমন কথা বলেছেন। স্বামীর লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিবে, এমন সময় ছেলে আনিস চিৎকার করে বলে, মা আমি ভুল করেছি আমাকে মাফ করে দাও। ছেলে হিসেবে পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন করিনি! বাবার লাশ নদী থেকে এনে মাটি দেয়। আনিস মাকে বলে, মা এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে খাবা। শাহানা কেঁদে বলেন, না বাবা, আমার স্বামী যখন বেঁচে থেকে তাঁর সন্তানেরটা খেইতে পারেনি স্ত্রী হইয়া আমি সেই সন্তানের খাবার খাইতে চাইনা! শাহানা ক্ষুধা লাগলে কোনরকম কোথাও থেকে কিছু জোগাড় করতে পারলে খায়, না পারলে না খায়। সে নিজের মৃত্যু কামনা করে। পৃথিবীর হৃদয়হীনতায় জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন।