Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
প্রলম্বিত ছায়া-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

প্রলম্বিত ছায়া-সুলেখা আক্তার শান্তা

বিশ বছর ধরে অসুস্থ স্বামী নিয়ে সংসার করছে রহিমা। রহিমার দরিদ্র পিতা-মাতা মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র জোটাতে পারেনি। আনিস বিয়েতে রাজি হওয়ায় তড়িঘড়ি করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জরাজীর্ণ আনিসের ছিল হাঁপানির পুরনো রোগ। সাংসারিক অবহেলায় তার ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি। অসুস্থ জামাই হয়েছে তাতে কি। মেয়েদের সংসার করতে হয় তাই তারা দিয়েছে সংসার করতে। জমিজমার যা ছিল স্বামীর সবই গেছে তাঁর চিকিৎসায়। এখন স্বামী-স্ত্রীর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। মেয়েরা বড় হচ্ছে। ছোট দেবর ইমরানের ভালো অবস্থা। নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের দিকে একটু ফিরেও তাকায় না। অসুস্থ ভাই তার পরিবার কেমন আছে কি খাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নাই! দুই মেয়েকে নিয়ে আবার দাসী বান্দির মতো খাটাচ্ছে। নেওয়ার সময় বলছিল মেয়েদের পড়ালেখা করাবে, তাও করাচ্ছে না। আরও বলেছিল ভাই অসুস্থ তাঁর জন্য মাসে মাসে কিছু টাকা দেবো তা দিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা করাবেন। তারও কোন হদিস নাই। মেয়ে দুইটার জন্য পরান ছিড়ে যায় রহিমার। মেয়েদের এ বাড়িতে আসার অনুমতি নাই। আনিস স্ত্রীকে বলেন, থাক তুমি দুশ্চিন্তা করোনা আমার মেয়েরা তার চাচার বাসা ভালই আছে।
রহিমা স্বামীকে বলেন, তুমি বিছানায় শুয়ে কেমনে জানো মেয়েরা আমার ভালো আছে! মেয়েদের নেওয়ার সময় তোমার ভাই ভাইবউ যেসব কথা বলছিল সেভাবে কাজ করছে? আমি মা আমার মন কী চায়না মেয়েদের দেখতে? রহিমা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন। আনিস ভেবে দেখে কথাটা সত্যি। আনিস তাঁর বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর কোনো সাধ আহ্লাদ পূরণ করতে পারেনি। পারেনি নিজের সন্তানকে কাছে রাখতে। তাঁর রোগাক্রান্ত বুক হতাশায় জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যায়। স্বামী হিসেবে, পিতা হিসাবে কারো জন্য কিছুই করতে পারল না সে!
শিলা আর রিতা ঢাকায় চাচার বাসাতে থাকে। সারাদিন চাচীর হুকুম পালন করতেই যায় তাদের দিন যায়। দুই বোনকে ভালোবাসে বড়লোকের ছেলে রবিউল ও ফাহিম। তারা আবার একে অপরকে বন্ধু। শিলা রিতার চাচার বাসার পাশেই তাদের বাড়ি। কখনো বারান্দায় কখনো জানলায় দুই বন্ধু রবিউল আর ফাহিম অপেক্ষা করে কখন শিলার রিতাকে দেখতে পাবে। তারা বিভিন্ন ধরনের গিফটও করে শিলা, রিতাকে। একবার ফাহিম ফুল আর চকলেট রেখে দেয় জানালার পাশে টেবিলে। বিষয়টা তাদের চাচী রুপা দৃষ্টিতে পড়ে যায়। চাচী চায়না তাদের সময় মতো বিয়ে হোক, কিংবা বড়লোক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হোক। রুপা বিষয়টি বুঝতে পেরে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে রাগারাগি করে শিলা আর রিতার সঙ্গে।
দুই বোনের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তারা প্রতিবাদ করে।
শিলা বলে, আপনি আমাদের কোন ভালো হোক চান না! বাবা মাকে বলেছিলেন আমাদের পড়ালেখা করাবেন। মাসে মাসে কিছু টাকা দিবেন। বিয়ে-শাদী দিয়ে দেবেন। তার কোনটাই করেন নাই। আপনি চান সারা জীবন আপনার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি।
আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস কী করে হলো? এসব চলবে না আমার বাসায় থেকে। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা, উঁকিঝুঁকি মারা। নিজের দিকে তাকাও। তোমরা হয়েছ গরিবের মেয়ে। ওই ছেলেরা বড় লোকের সন্তান। তারা তোমাদের বিয়ে করবে? তাদের বাবা মা কখনো মেনে নিবে ব্যাপারটা? তোমাদের কারণে বদনামের ভাগি হতে হবে আমাদের। ছেলে মেয়েদের দেখা-সাক্ষাতের সব উপায় বন্ধ করে দেয় রুপা। রবিউল ও ফাহিম অনেক চেষ্টা করেও দেখা করার সুযোগ পায় না। অনেক চেষ্টার পর দেখা হলে রিতা বলে, তোমরা বড়লোকের ছেলে আর আমরা গরিবের মেয়ে। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক তোমার বাবা-মা কখনোই মেনে নিবেন না। তোমাদের ভালোবাসায় আগুনে আমরা জ্বলে পুড়ে মরবো তা কী তোমরা চাও?
ফাহিম বলে, তা হবে কেন? ভালবাসি কি তোমাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য। ঠিক আছে আমাদের বাবা মাকে তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাবো। রবিউল বলে, ঠিক আছে বিয়ে করেই এ সমস্যার সমাধান হবে। শিলা বলে, এমন হলে তো সমস্যা নেই। রবিউল আর ফাহিম তাদের বাবা-মাকে পাঠায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। রুপা চাচী চমকে যায়। না এই বিয়ে কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না! রবিউল ও ফাহিমের বাবা-মা বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলতেই রুপা বলে, আমি কী বলবো ভেবে পাইনা। আপনারা এত অর্থ বিত্তবান মানুষ ছেলের জন্য কাজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন?
তাঁরা অবাক হয়ে বললো, কাজের মেয়ে!
হ্যাঁ, ওরা আমার বাসায় কাজ করে। ওদের স্বভাব চরিত্রও ভালনা। আমি মানুষের ভাল চাই। কথাগুলো না বললেও পারতাম। আপনাদের মঙ্গলের জন্যই আমার বলা। রবিউল ও ফাহিমের বাবা মা মেয়েদের সম্পর্কে এমন কথা শুনে চলে যান। রুপা ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে। চিৎকার করে বলতে থাকে, আজ তোমাদের জন্য আমাকে অপমান হতে হয়েছে! ছেলেদের বাবা-মারা যা ইচ্ছা তাই বলে গেলেন। তারা তোমাদের কাজের মেয়ে বলে সম্মোধন করে কথা বলেছে। চাচী হয়ে এতো আমি সহ্য করতে পারিনা। কাজের মেয়ে হয়ে কী করে সাহস পাও তাদের ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক করতে? তোমাদের চাচাতো নির্বোধ তোমাদের কোনো ব্যাপারে কোন কিছু বলেন না। ইমরান বাসায় আসতেই রুপা বলতে শুরু করল। তোমার ভাতিজিরা বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ছেলেদের বাবা মা এসে যা ইচ্ছা তাই বলে গেলে। দুই বোন একসঙ্গে দুই ছেলের গলায় ঝুলে পড়তে চাচ্ছে। ইমরান বলে, থাক ওরা বোঝে না, বুঝিয়ে বলো।
রবিউল আর ফাহিম দেখা করে শিল আর রিতার সঙ্গে। তারা দুজনেই বলে, এক উপায় আছে চলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। শিলা রিতা বলে, যেখানে তোমার বাবা-মা বিয়েতে রাজি না উপরন্ত অপমানজনক কথা বলে গেছে সেখানে আমরা তোমাদের বিয়ে করতে চাই না!
ফাহিম বলে, অপমানজনক কথা তোমার চাচী বলেছে, যা বলার মতো ভাষা নেই। শিলা বলে, চাচী তো আমাদের উল্টোটা বুঝিয়েছে।
রবিউল বলে, তোমাদের চাচীকে তোমরা নতুন করে চেন? সে কেমন তোমরা জানো না? শিলা রবিউলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু রিতা ভয় পায় যদি ফাহিমের বাবা-মা এ বিয়ে মেনে না নেয়। শিলা রবিউলকে পালিয়ে বিয়ে করে। আর রিতা চলে যায় বাবা-মার কাছে। মা রহিমা মেয়েকে পেয়ে খুব খুশি। রিতা বলে, আমি আর চাচীর কাছে যাবনা।
ঠিক আছে মা তোকে আর যেতে হবে না। আমি তোকে বিয়ে দেবো। রিতার বিয়ে নিয়ে কথা উঠে। শেষ পর্যন্ত রিতার বিয়ে ঠিক হয় এক রং মিস্ত্রির সঙ্গে। হাবিব রংমিস্ত্রি হলেও কামাই রোজগার মন্দ না দেখতে শুনতেও ভাল। রহিমা যোগাযোগ করে দেবর ইমরানের সঙ্গে। রহিমা বলেন, ইমরান ভাইয়ের দিকে তো খেয়াল করলেই না। ভাতিজি দু’জনকে নিয়ে যে কথা বলেছিলা তা কিছুই করনি! এখন আমি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। বিয়েতে কিছু খরচ পাতি আছে মেয়েকেও কিছু অলংকার দিতে হবে। তোমার ভাইয়ের যা অবস্থা তা তো জানোই। দু মেয়েকে তোমার বাসা থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হলো!
ইমরান বলে, ভাবি আর কিছু বলতে হবেনা আমি ভীষণ লজ্জিত কী করবো স্ত্রীর সঙ্গে পারিনা। বিয়েতে যা লাগে আমি সব দেবো আপনি এনিয়ে চিন্তা করেন না। রুপর খরচ দেওয়ার কথা শুনে স্বামীর সঙ্গে ভীষণ ঝরগা ঝাটি শুরু করে। তার কথার বাইরে যাওয়ার উপায় নাই। দশ হাজার টাকা আর ছোট্ট একটি চেন পাঠিয়ে দেয় সে। গরিব বলে নিজেরা বিয়েতে অংশগ্রহণও করেনা। কথায় বলে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। রহিমা ভাবছিল ভাতিজির জন্য চাচার এ তুচ্ছ দান ফিরিয়ে দেবে। এত বছর তার বাসায় থাকলো, কাজের মেয়ে বলে সম্বোধন করল। কাজের মেয়ের সেই বেতনটাও কী দিয়েছে! আমাদের কপালে আছে কষ্ট এ কষ্ট থেকে মুক্তি নাই।
রিতার বিয়ে হয়। স্বামী রং মিস্ত্রির কাজ করে। হতভাগ্যদের জীবন বোধহয় দুর্ভাগ্য দিয়ে রচিত হয়। ঘটে যায় এক দুটনা। রংয়ের কাজ করতে গিয়ে বিল্ডিং থেকে পড়ে যায় রিতার স্বামী হাবিব। দুর্ঘটনা মারাত্মক। রিতা বলে, একি হলো আমার কপালে। বিয়ে হতে না হতেই স্বামীর এই অবস্থা। হাতেও মেহেদির রং এখনও যায়নি। রহিমা কাঁদে, কি করে এখন চিকিৎসা হবে! অসুস্থ স্বামী বিছানায় পড়া। নিজের আর্থিক সামর্থ্য নাই যে মেয়েকে সাহায্য করবে চিকিৎসার জন্য। রিতা চোখে অন্ধকার দেখে, সমাধানের কোন পথ দেখতে পায়না। সে নিরুপায় হয়ে চাচী রুপার সঙ্গে যোগাযোগ করে। রুপা সংকটের মধ্যেও কথা বলতে ছাড়ে না। বলে, ও, উপায় না পেলে তখন চাচী। আমিও জানি এই চাচীর কাছেই আসতে হবে! রিতা বলে, আপনার যত কথা আছে আপনি বলেন, আমার স্বামীর খুব খারাপ অবস্থা, আমাকে কিছু টাকা দেন।
দেবো কিন্তু আমার বাসায় কাজ করে সেই টাকা শোধ করতে হবে।
হ্যাঁ তাই করবো, রিতা চাচীর কাছ থেকে টাকা নেয়। স্বামীর চিকিৎসা ওষুধপাতি সব ব্যবস্থা করে মায়ের কাছে দায়িত্বভার দেয়। হাবিব স্ত্রীকে বলে, তুমি যেয়েও না তোমার চাচীর কাছে আমি মরে যাই তাও ভাল! রিতা বলে, তুমি আমার স্বামী তোমার জন্য কিছু করতে পারলে মনে শান্তি পাব। রিতা ঢাকায় চাচীর বাসায় যায়। রিতারা দুই বোন বাসা থেকে চলে যাওয়ায় চাচীর মনে থাকা আক্রোশের কথা শোনাতে তিনি কখনোই ছাড় দেন না। চাচার বাসায় কাজ করে বেতনের টাকা দিয়ে রিতা ঋণ পরিশোধ করতে থাকে।
শিলা আর রবিউল বিয়ে করে সুখ-শান্তিতেই আছে। ফাহিমের সঙ্গে দেখা হয় রিতার। বেহাল অবস্থা দেখে ফাহিম বলে, তোমার এমন অবস্থার জন্য তুমি নিজেই দায়ী। আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তোমার বিশ্বাসে অটল রইলে। না হয় আমার কথায় রাজি হয়ে ঠকেই দেখতে। রিতা বলে, যা হবার হয়েছে এখন এ বিষয় নিয়ে কথা না বলাই ভালো। ফাহিম বলে, যদি কোনো ব্যাপারে আমাকে তোমার প্রয়োজন হয় জানিও। রিতা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে ফাহিমের দিকে।
রিতার স্বামী হাবিবের দুই পা কেটে ফেলতে হবে! জেনে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। এই মুহূর্তে স্বামীর পাশে থাকার দরকার। চাচীর কাছে দুই দিনের ছুটি চায়। রুপা সরাসরি না বলে দেয়। আমি এখন কাজের লোক পাব কোথায়? এত বড় বাড়ি একা সামলাবো কি করে! তুই কি ডাক্তার? তুই ওখানে যেয়ে কি করবি? রিতার মাথায় আগুন ধরে যায়। চিৎকার করে বলে, আমি যাব না আপনার বাসা থেকে। আমার স্বামীর যা হয় হোক। এমন পাষাণ হৃদয়ের মানুষের কাছে কোন ফরিয়াদের মূল্য নেই। রিতার কাছে খবর আসে তার স্বামী মারা গেছে। রিতা আল্লাহকে ডাকে। হে আল্লা তুমি আমাকে দুঃখ সহ্য করার শক্তি দাও। কাউকে কিছু না বলে পাগলের মতো ছুটে যায় মৃত স্বামীর লাশ দেখতে। রিতা কাঁদে বলে, অসুস্থ হলেও স্বামী তো বেঁচে ছিল। স্বামীহারা মেয়েরা জীবন্ত লাশের মতো। লাশ হয়েই বাঁচতে হবে বাকিটা জীবন। রহিমা মেয়ের মাথা হাত রেখে বলেন, আমাদের কোন কিছু না থাকলেও দুঃখ তো সম্বল আছে। চল আমরা দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকি। এক চিরদুখী আরেক দুঃখীকে পথ দেখায়।
লেখক-সুলেখা আক্তার শান্তা