Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ৫শত বছরের ঢাকের হাট – Pratidin Sangbad

কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ৫শত বছরের ঢাকের হাট

কারো হাতে সানাই, কারো হাতে বাঁশি, করতাল ও মঞ্জুরীসহ নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র, কাঁধে ঝুলছে ঢাক। হঠাৎ করে দেখে মনে হতে পারে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী দেখাতে এসেছেন সবাই। কিন্তু আদতে তা নয়। এদের সবাই এসেছেন শ্রম বেঁচতে। রীতিমতো হাট বসিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তারা। জেলার কটিয়াদী উপজেলায় শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে প্রতি বছর উপজেলা সদরের পুরাতন বাজারে ৫শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট বসে। পূজার আয়োজকগণ দেশের প্রায় সর্বত্রই সুনাম ছড়িয়ে পড়া এই হাটে ছুটে আসেন ভালো মানের বাদক নিতে। করোনা মহামারির প্রভাব থাকলেও সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক গতিতে। পূজামন্ডপগুলোও ইতোমধ্যে সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। লগ্ন শুরু হলেই ঢাক-ঢোলের তালে পূজারীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে পূজামন্ডপগুলো। তাই দূর দূরান্ত থেকে ঢাক ঢোল, সানাই, বাঁশি নিয়ে আগমণ শুরু হয়ে গেছে। আয়োজকরা জানায়, এখানে ছাড়া দেশের কোথাও এ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের হাট বসে না। তবে এ হাটে কোনো কেনাবেচা হয় না। পূজামন্ডপে বাজনা বাজিয়ে আরতী দেয়া, দুর্গা মাকে খুশি করা আর দর্শক ভক্তদের আকৃষ্ট করতেই যন্ত্র বা ব্যান্ড পার্টি চুক্তিভিওিকভাবে এখান থেকে ভাড়া দেয়া-নেয়া হয়। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, ঢাকা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক দুর্গাপূজার আয়োজকরা এ হাটে এসে দরকষাকষি শেষে চুক্তিতে বাধ্য-যন্ত্রিদের নিয়ে যায়। পরে দুর্গোৎসবের শেষদিন প্রতিমা বিসর্জন
পর্যন্ত বাদ্য বাজিয়ে যন্ত্রিদের বিদায় দেয়।
মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের ভাটি অঞ্চল, কুমিল্লার হাওড়াঞ্চল থেকে শত শত বাদ্যযন্ত্র এ হাটে আসেন। ঢাকঢোল, সাঁনাই, বিভিন্ন ধরনের বাঁশি, কাঁসি, কওালসহ হাজার হাজার বাদ্যযন্ত্রের পসরায় হাট উপচে পড়ে। যন্ত্রীরা দলে দলে দফায় দফায় বাজায় বাদ্যযন্ত্র। বাজনার তালে তালে নাচ আর রঙ ঢঙয়ের অঙ্গভঙ্গিতে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে থাকে।
একটি ঢাক ১২-১৫ হাজার, ঢোল ১০-১২ হাজার, বাঁশি প্রকারভেদে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার,‘ব্যান্ডপার্টি’ ছোট ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার এবং বড় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দেয়া হয়। বাদ্যযন্ত্রীরা পূজামন্ডপে বাজনা বাজিয়ে
দর্শক ও ভক্তদের আকৃষ্ট করে থাকেন। দুর্গাপূজা শুরুর দিন থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত টানা ৫ দিন তাদের বাজনা বাজাতে হয়। সিলেট বিয়ানিবাজার থেকে এসেছেন আব্দুল মালিক তিনি জানান, কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাটে আমরা আসি। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঢাক
বাজাতে চলে যাই। গত বছর পাঁচ দিনের চুক্তিতে সিলেটের একটি পূজামন্ডপে গিয়েছিলাম। এ বছরও বিভিন্ন জায়গার লোকজনের সঙ্গে কথা চলছে।
শ্রীনগর মুন্সিগঞ্জ থেকে জিবন চন্দ্র দাস জানান, আমার বাপ-দাদারা এই হাটে আসতেন। ১০ বছর ধরে আমিও এই ঢাকের হাটে আসি। প্রত্যেকবারই বায়না হয়ে যায়। জনশ্রূতিতে আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ই সর্বপ্রথম তাঁর রাজপ্রাসাদে দূর্গাপূজার আয়োজন করেন। উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। আজও রাজার আমলে খনন করা কোটামন দিঘীটির মনোরম দৃশ্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। পূজা উপলক্ষে রাজাপ্রাসাদ থেকে সুদূর মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের পরগনার বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠানো হয়। ঢাকঢোল বাঁশিসহ বাদ্যযন্ত্রীদের আগমনের জন্য সে সময় নৌ-পথ ব্যবহার করা হতো। বাদ্যযন্ত্রীরা কটিয়াদী-মঠখোলো সড়কের পাশে পুরোনো ব্রক্ষপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাট নামক স্থানে পূজার দুইদিন আগে এসে পৌঁছাতো।

পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী মসুয়া গ্রামে বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরীর বাড়িতে মহা ধুমধামে পূজা শুরু হয়। সেই সঙ্গে চলে বিভিন্ন পূজার বাদ্যযন্ত্রের প্রতিযোগিতা। দিন দিন পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারদের মধ্যে ঢাকের হাটের স্থান নির্ধারণ নিয়ে দ¦›দ্ব শুরু হয়। পরে যাত্রাঘাট থেকে স্থান পরিবর্তিত হয়ে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী আড়িয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী কটিয়াদীর পুরাতন বাজারের মাছমহাল এলাকায় ঢাকের হাট গড়ে ওঠে। ঢাকের হাটকে কেন্দ্র করে এলাকায় শতশত মানুষের সমাগম ঘটে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয় স্থানীয় প্রশাসন।

কটিয়াদী পূজা উদযাপন পরিষদের আহবায়ক শেখর সাহা জানান, ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার প্রাসাদে পূজার আয়োজনের জন্য সেরা ঢাকির খোঁজ করতে গিয়ে বিক্রমপুর পরগনার প্রসিদ্ধ সব ঢাকিকে আমন্ত্রণ জানান। তারপর সবার বাজনা শুনে বেছে নেন সেরা দলটিকে। সেই সময় থেকে আমাদের এলাকায় ঢাক-ঢোলের হাটের শুরু।

কটিয়াদী পৌর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, এই ঢাক ঢোলের হাটটি আমাদের স্থানীয় ঐতিহ্য বহন করছে। এখান থেকে
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পূজারীগণ তাদের পছন্দ অনুযায়ী ঢাকী নিয়ে যায় তাদের পূজা মন্ডপে।

কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ জানান, পাঁচশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাক-ঢোলের হাট উপজেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই হাটটিই দেশের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় বাদ্যযন্ত্রের হাট হিসেবে পরিচিত। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এ হাটের গৌরব ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলেছে। প্রতিবছর স্থানীয় প্রশাসন আগত বাদ্যযন্ত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। দিনদিন হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা বাড়তে থাকায় বর্তমানে জায়গা সংকুলান হয়না কটিয়াদী বাজারে। তাই আগামীতে হাটের জন্য একটি ভালো স্থান নির্বাচন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।