আজ ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সত্য মিথ্যা-সুলেখা আক্তার শান্তা

নাজমার জবানবন্দি দেওয়ার আগে পুলিশের কাছে একটা অনুরোধ জানায়। পুলিশ অফিসার একজন সহৃদয় ব্যক্তি তিনি
নাজমাকে কথা বলার সুযোগ দিলেন। নাজমার বাবা অভাবী মানুষ। মেয়ে বড় হওয়ায় কপালে চিন্তার রেখা গভীর হয়।
দারিদ্র্যের মলিনতার মধ্যেও নাজমা ছিল সুন্দরী। অনেক খুঁজে পেতে মন্ডল বাড়ির রাখাল ঈমান আলীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া
হয় নাজমার। ঈমান আলীর বউ হিসেবে নাজমারও কাজ জুটে যায় মন্ডল বাড়িতে। প্রথম থেকেই মন্ডল বাড়ির বড় ছেলে
মজনুর চোখ পড়ে সুন্দরী নাজমার উপর। একদিন শোনা গেল নাজমা গর্ভবতী। তারপর দিন নদীর ঢালে পাওয়া গেল
নাজমার স্বামী ঈমান আলীর মৃতদেহ। নাজমার পক্ষে গ্রামে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে বাবাকে সঙ্গে করে শহরে চলে
আসে। সেখানেই জন্ম নেয় তার কন্যা সন্তান। পিতার সামান্য উপার্জন আর বাড়ি বাড়ি কাজ করে কোনভাবে চলে তাদের
জীবন। কিন্তু বৃদ্ধ বাবার অসুস্থতায় দেখা দেয় সংকট। খেয়ে না খেয়ে কোনভাবে জীবন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষে
চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় নাজমা। একদিন খুব সকালে হায়দার সাহেবের বাড়ি বারান্দায় রেখে আসে নিজের মেয়েকে।
দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে থাকে। বাচ্চার কান্না শুনে কেউ একজন এসে বাচ্চাটিকে ঘরে নিয়ে যায়। নাজমা তার সহকর্মী
রহিমার কাছ থেকে খোঁজ খবর আগেই সংগ্রহ করেছিল। ধনাঢ্য হায়দার সাহেব ছিল নিঃসন্তান। জীবনে সবকিছু পেলেও
ওই একটা জিনিস বহু চেষ্টা করেও সে পায়নি। একটা সন্তানের জন্য এত সম্পদ বিত্ত বৈভব সবকিছু অর্থহীন মনে হয়।
নাজমা ক্রমাগত হায়দার সাহেবের বাড়ির দিকে দুর থেকে নজর রাখতে থাকে। কয়েক দিন অপেক্ষার পর
আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখতে পেয়ে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বুক থেকে পাথরের বোঝা নেমে যায়। দেখে হায়দার সাহেবের স্ত্রী
বারান্দায় এসে দাঁড়ালো তার মেয়েকে কোলে করে। মেয়েটি দুহাত দিয়ে হায়দার সাহেবের স্ত্রীর গলা জড়িয়ে বুকের সাথে
মিশে আছে। নাজমা কয়েক দিন দেখে এদৃশ্য। সে নিশ্চিত হয় মেয়েটি তার ভালো থাকবে। অসুস্থ পিতাকে নিয়ে শহরের
বাস করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। গ্রামে ফিরে যায় তারা। ঘাত প্রতিঘাতে কাটতে থাকে জীবন। জীবন সংগ্রামে পরাজিত
পিতার জীবন সমাপ্তি ঘটে একদিন। বাবার মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়ে নাজমা। জীবনে যতক্ষন স্পন্দন থাকে যেকরে হোক
দেহটাকে টেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নাই। নাজমার ভাষায় নিঃশ্বাস হয়ে ওঠে জীবনের বোঝা। দুঃখের রাত্রি পোহাতে দেরি
হলেও এক সময় সকালের দেখা মেলে। কিন্তু নাজমার জীবনের অন্ধকার ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। অভাব অনটন
অপরদিকে পিতার মৃত্যুতে অসহায় নিঃসঙ্গতা জীবনের বোঝা ভারী করে তোলে। এভাবেই পার হতে থাকে দিন মাস
বছর। এক সময় হাপিয়ে ওঠে নাজমা। জীবন সমুদ্রের কুলকিনারা দেখতে পায় না। মনে পড়ে মেয়ের কথা। এতদিন
হয়তো মেয়ে তার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। ভাবে, এই নিদানে নিশ্চয়ই মেয়েটা আশ্রয় হতে পারে তার। নাজমা হায়দার
সাহেবের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। গেট দিয়ে ঢোকার সময় গাড়িতে একটি মেয়েকে বের হয়ে যেতে দেখে। খোঁজ নিয়ে
জানতে পারে মেয়েটি হায়দার সাহেবের একমাত্র মেয়ে রুনা। নাড়ির টান বলে কথা। নাজমা বুঝতে পারে মেয়েটি তার
কন্যা। সে নিজ কন্যার দাবি নিয়ে হাজির হয়। স্তম্ভিত হায়দার সাহেব কখনো ভাবেনি এমন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন
হতে হবে। রুনাকে নিয়ে একটি শান্তির সংসার সাজিয়েছিলেন তিনি। নাজমা ঝড়ের মতো সেখানে ঢুকে সব ওলট-পালট
করে দেবার উপক্রম করেছে। যে কঠিন সত্যটি রুনার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে আজ বুঝি তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
রুনা অবাক বিস্ময়ে শুনছিল সব কথোপকথন। বাদানুবাদ এবং তর্কবিতর্ক দীর্ঘ হতে থাকে। যুক্তি তর্কের মারপ্যাঁচে
নাজমা পরাজিত হলে পুলিশ ডাকা হয়। পুলিশ দেখে নাজমার চেতনায় হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। ভাবে, সে একি করছে।
পুলিশের কাছে স্বীকার করে টাকার জন্য সে মিথ্যা দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিল। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
জবানবন্দী দেওয়ার সময় নাজমা অশ্রু সজল চোখে বলে, ওই মেয়ের শরীরে যে রক্ত আমার শরীর ফাইড়া দেখেন একই
রক্ত পাইবেন। নাজমা ডিএনএ পরীক্ষার কথা জানেনা, জানলে হয়তো সেই কথাই বলতো! পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসা
করলো, তাহলে তুমি তোমার মেয়ে দাবীটা মিথ্যা বললে কেন? নাজমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হতভাগ্যদের দুর্ভাগ্যের জীবন
অনন্তকালের অপরিবর্তনীয় ললাট লিখন। কোন ভাগ্য গুনে তার গর্ভজাত সন্তান সেই বাঁধা অতিক্রম করতে পেরেছে।
তাকে আবার অদৃষ্টের চিরাচরিত শৃঙ্খলে বন্দী করতে চায় না সে। মেয়েটা আমার অনেক উপরে উঠে গেছে, ওকে টেনে
নিচে নামিয়ে কি লাভ? আমার জীবন তো প্রায় শেষ। ফকিন্নির কাতারে অগণিত মানুষ। ওকে এখানে টেনে নামিয়ে কি

হবে? ও ওখানেই সুখে থাকুক। কাহিনীর করুন বর্ননা শুনে পুলিশ অফিসারের মনটা ভারী হয়ে ওঠ। তিনি নাজমাকে
বলেন, তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে কিন্তু জীবনে আর কখনো এ মুখো হইও না। সকালে নাজমা ছাড়া পেয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে
রওনা দেয়। তখনো ভোরের কুয়াশা ভেদ করে সূর্য ওঠেনি।

কবি সুলেখা আক্তার শান্তা্র -সত্য মিথ্যা

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ