Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
সুলেখা আক্তার শান্তা’র ছোট গল্প-তিতিক্ষা – Pratidin Sangbad

সুলেখা আক্তার শান্তা’র ছোট গল্প-তিতিক্ষা

আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খুব ঘটা করে পাত্রী দেখতে গিয়েছিল আনিস। পাত্রী দেখার পর সকলের মুখভঙ্গি দেখে
বুঝতে পারে পাত্রী তাদের পছন্দ হয়নি। পাত্রী দেখতে কালো। অভিভাবক সঙ্গী-সাথীদের মতামতের বিরুদ্ধাচারণ করা
তার হয়ে ওঠেনা। আনিস অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। কাউকে কিছু না বলে মেয়েটির কথা ভাবতে থাকে। এখন কি হবে
মেয়েটির। অপছন্দের মেয়েটির আর কি বিয়ে হবে না। অবিবাহিতাই থেকে যাবে সারা জীবন। মহাসমারোহে পাত্রী দেখতে
যাওয়া পাত্র পক্ষের অবসম্ভাবী প্রশ্নহীন রেওয়াজ। অপরদিকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে পাত্রী পক্ষের পাত্র দেখতে যাওয়াটা প্রথা
বিরুদ্ধ কাজ। সাধারণত এধরনের কাজ কেউ ঘটা করে না। করলে নিরবে নিভৃতে করে। ঘটা করে করলে ভালো হতো।
পাত্র-পাত্রী দেখা এখন সৌজন্য আর আনুষ্ঠানিকতার যাঁতাকলে আটকা পড়েছে। এমন দেখাদেখিতে কোন পক্ষই প্রকৃত
অবস্থা অবগত আবার সুযোগ পায় না। যারা বিয়ে করবে সংসার করবে তারা তুচ্ছ হয়ে যায় আনুষ্ঠানিকতার চাপে। পাত্র-
পাত্রীর পরস্পরকে জানার কোন সুযোগও রাখা হয় না। কখনো রাখলে তা সৌজন্য বিনিময়ের সীমায় সীমাবদ্ধ থাকে। এ
যেন, যার বিয়ে তার খবর নাই…এর মতো। অসংগতি গুলো বিরক্ত করে আনিসকে। সে চুপ করে থাকে। উপাদেয় ভুড়ি
ভোজের আয়োজন করেছিল কন্যা পক্ষ। সবাই এক পেট খেয়ে বিরস বদনে বিদায় নেয়। কালো মেয়েটির দুঃখ নিয়ে কেউ
ভাবেনা। এর মধ্যেই সেই রূপহীনার চেহারার এক ঝলক দুত্যি কেমন করে যেন আটকে যায় আনিসের চোখে।
মেয়েটির নাম রোকেয়া। তার বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ অব্যাহত ছিল। খোঁজাখুঁজির পর সুদর্শন এক পাত্র পাওয়া যায়
হতশ্রী মেয়েটির জন্য। ছেলেটি মাদকাসক্ত। ছেলেপক্ষ বিষয়টি গোপন রাখে। তাদের আশা বিয়ে হলে যদি ছেলের
মাদকাসক্তি মুক্তি ঘটে। কি নিষ্ঠুর প্রত্যাশা, বিস্ময়কর মানসিকতা এবং বিবেকহীন সিদ্ধান্ত। যেখানে নারীর জীবন তুচ্ছ
তাচ্ছিল্যের বিষয়। উৎসর্গ আর বলির বস্তু। সুখের স্বপ্ন দেখা এক নারীর জীবন অবলীলায় জুড়ে দেওয়া হয় নরক যন্ত্রণার
শৃংখলে।
মাদকাসক্ত স্বামীর সংসারে শুরু হয় রোকেয়ার দুঃখের জীবন। ঘাত প্রতিঘাত বাদানুবাদের অন্তহীন সংগ্রাম। কোথায়
কোন অভিযোগ অনুযোগ করে লাভ হয় না। আপনজনরাও বলতে থাকে একটু মানিয়ে চলতে। ধৈর্য ধরো সব ঠিক হয়ে
যাবে। এমন সুদর্শন স্বামী পেয়েছ তার মুখ দেখেই তো সব দুঃখ ভুলে থাকা যায়। ধরনের আরো কত কি। জীবনের এই
পর্যায়েকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে রোকেয়া। যে কোন মূল্যে ফারুককে আসক্তি মুক্ত করতে চায়। ধৈর্য সহ্যের সব
পরীক্ষা নিষ্ঠার সঙ্গে দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেনা। ব্যর্থতার সমস্ত অপবাদ আর গঞ্জনায় শিকার হতে হয় তাকে। বিষময়
হয়ে উঠতে থাকে তার প্রাণ। জীবন যন্ত্রণা ক্রমেই অসহনীয় হয়ে ওঠে। এক সময় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে সংসার থেকে
বেরিয়ে আসা ছড়া কোন উপায় থাকে না। মরিয়া হয়ে সে ডিভোর্স দেয়। ডিভোর্স দেওয়াটাও সহজ ছিল না সেখানে
অনেক সংগ্রাম করতে হয়। এক যুদ্ধ শেষ হলে আরেক যুদ্ধ শুরু হয় তার জীবনে। নারীর জন্য অনিরাপদ পৃথিবীর পথে
পথে সমস্যা আর সংকট। এক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বহু সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হয়। সমস্যার বেড়াজাল ছিন্ন
করে জীবন টিকিয়ে রাখাই দূরহ হয়ে পড়ে। সমস্যা সমাধান করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। জীবন তার কাছে
ভাড়ি বোঝা হয়ে ওঠে। সেই বোঝা বয়ে বেড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। জীবনের সমাপ্তি টানার চরম সিদ্ধান্তটি নিতে হয়
তাকে। সে আত্মহত্যা করবে।
পাশের নদীতে নতুন একটা ব্রিজ হয়েছে। ব্রিজের ওপারে বিস্তৃত কাশবন। বাতাসে রেশমের চাদরের মতো দোলে। দূর
থেকে কাশবনের দৃশ্য মনোরম দেখায়। কাছে গেলে নাকি পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আনিস বহুবার কথাটা শুনেছে। অনেক দিন
ধরে ভাবছিল কাশবন দেখতে যাবে। পড়ন্ত বিকেলে নিরিবিলি রাস্তা। ব্রিজ পার হতে গিয়ে দেখে একটি মেয়ে মাঝে দাঁড়িয়ে
আছে। মেয়েটি তার আগমন লক্ষ্য করছে। আনিস এগিয়ে যায়। কাছাকাছি আসতে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে, এতো সেই
কনে দেখার পাত্রী মেয়েটি। আনিসের বিশ্বাস ছিল মেয়েটি তাকে চিনতে পারবে। একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কেমন
আছেন। মেয়েটি ততাধিক আশ্চর্য হয়ে বলে, কে আপনি। আপনাকে তো চিনলাম না। আনিস পরিচয় প্রসঙ্গটা চেপে যায়।
বুঝতে পারে কনে দেখার মুহূর্তে মেয়েদের অবস্থা। সেই সময় কাউকে এক ঝলক দেখে চিনে মনে রাখার কথা নয়। আনিস

পরিস্থিতি হালকা করতে বলে, সরি। আমার এক পরিচিতের সঙ্গে আপনার বেশ মিল আছে। তা কোথায় যাবেন আপনি?
বেড়াতে এসেছেন বুঝি? মেয়েটি সৌজন্য রক্ষার্থে মাথা নাড়ে। আনিস স্বউৎসাহে বলতে থাকে, বেড়ানোর জন্য জায়গাটা
খুব ভালো কিন্তু আপনাকে যেতে হবে ব্রিজের ওপার। ওই কাশবনের দিকে। বিশাল এলাকা। অনেকেই দেখতে আসে।
আমিও যাব ওদিকে। চলুন আপনাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিই। কৌতুহলী আনিস নিজের মনোভাব চেপে রাখে। উদ্ধার
করতে চায় এর হঠাৎ এখানে আগমনের কারণ।
জীবন সংহারের জন্য একটা জায়গা খোঁজে রোকেয়া এখানে এসেছিল। নিরিবিলি দেখে ব্রিজের উপরটা বেছে নেয়। হঠাৎ
করে এই উটকো ঝামেলা উপস্থিত হওয়ার বিরক্তি মনে চেপে রাখে। কথা না বাড়িয়ে আনিসের আহবানে তার পিছে পিছে
চলতে শুরু করে। মেয়েটির আকস্মিক আগমনের কারণ নিয়ে আনিসের মনে অনেক প্রশ্ন। তবুও বিব্রত হবার মত কোন
প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকে। পুরো কাশবনটি ঘুরে দেখায়। মেয়েটি ততক্ষণে কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে। চুরি করতে গিয়ে
ধরা পরার মত অবস্থা তার। নিজেকে প্রকৃতিপ্রেমী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে রোকেয়া। ততক্ষণ সন্ধ্যা হয়ে
এসেছে। ফিরে যাবার প্রস্তুতি নেয়। আনিস বলে উঠে, আপনি বুঝতে পারছেন না বাসা থেকে অনেক দূর চলে এসেছেন
আপনি। আপনাকে একা ছেড়ে দেওয়াটা দায়িত্বহীন কাজ হবে। আর আমি অতটা দায়িত্বহীন নই। ‌অবশ্যই আপনাকে
বাসায় পৌঁছে দেব। আনিসের আন্তরিকতা রোকেয়ার মন স্পর্শ করে। জীবনের কষ্ট কেমন যেন একটু হালকা হয়। ফেরার
পথে অনেক কথা হলেও পরিষ্কার হয় না হঠাৎ এখানে আগমনের কারণ। কাশবন থেকে একটু দূরে নদীর বাঁক। স্থানটি
আরো মনোরম। বিকালে সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় প্রকৃতি এখানে অপরূপ রূপ ধারণ করে। প্রতিদিন বহু লোকের সমাগম
ঘটে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে। ‌আনিসের মুগ্ধ বর্ণনায় আকৃষ্ট হয় রোকেয়া। পরদিন নদীর বাঁকে সূর্যাস্ত দেখার আমন্ত্রণ
গ্রহণ করে সে। যথারীতি পরদিন আনিসের সঙ্গে নদীর বাঁকে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে হাজির হয়। দেখা
সাক্ষাৎ আলাপচারিতায় সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। রোকেয়ার কাছে পুরো ব্যাপারটা খুবই তাজ্জব মনে হয়। আত্মহত্যা
করতে এসে এমন আত্মরক্ষার ঘটনা কল্পনাকে হার মানায়। তাদের সম্পর্ক তখন আপনি থেকে তুমিতে গড়িয়েছে। সে
ভাবতে থাকে কাউকে আকর্ষণ করার মতো কোনো রূপ, গুণ তার মধ্যে আছে! তবু আনিস কেন এগিয়ে এলো তার দিকে।
প্রশ্নটি অবশ্য আনিসকে কয়েকবার করা হয়ে গেছে। আনিস প্রতিবারই ধৈর্য ধরে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চমৎকৃত করেছে।
রোকেয়ার মন থেকে অনিশ্চয়তার মেঘ কাটতে থাকে। মনে মনে আনিসকে তার সম্পর্কে সব কথা খুলে বলার তাড়া
অনুভব করে।
আনিস রোকেয়া রেস্টুরেন্টে ঢোকার পথে বিপত্তিটা ঘটে। রোকেয়ার মাদকাসক্ত প্রাক্তন স্বামী ফারুক সামনে এসে দাঁড়ায়।
ফারুকের সুদর্শন চেহারায় ক্লান্তি আর বিষণতার ছাপ। ক্ষীণ কণ্ঠে রোকেয়াকে বলে, কেমন আছো? রোকেয়া নিশ্চুপ।
ফারুক বলে, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। বলুন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোকেয়া বলে। ফারুক আনিসের দিকে একবার
তাকিয়ে বলে, একটু একান্তে বলতে চাই। বিরক্তি নিয়ে রোকেয়া বলে, যা বলার এখানেই বলুন। ফারুকের কথার সারমর্ম,
জীবনে সে অনেক ভুল করেছে। রোকেয়াকে হারানো ছিল তার আর একটা বড় ভুল। নিজেকে সে অনেক সংশোধন
করেছে। এখন সে নতুন করে বাঁচতে চায়। রোকেয়া তার সঙ্গী হলে সেই কাজটা সহজ হবে।
সুদর্শন ফারুকের হৃদয়স্পর্শী কথা গুলো করুন আকুতি হয়ে আনিসের কানে বাজতে থাকে। ফারুক এখনো ভালবাসে
রোকেয়াকে। তা না হলে এমন অনুরোধ আসে কি করে! আনিস থমকে যায়। সে কি ভুল করছে। পিছিয়ে আসতে চায়
আনিস। রোকেয়াকে বুঝিয়ে বলে, একটা মানুষ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার জন্য তোমার সাহায্য চায়। তুমি তাকে বিমুখ
করো না। রোকেয়ার সমস্ত নারী সত্তা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। উচ্চস্বরে বলে ওঠে, সে কথা বলার তুমি কে? বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে
বর্ণনা করে জীবনের দুঃসহ ঘটনা। বিবাহের বন্ধন একজন পুরুষ তুচ্ছ করতে পারলেও নারী যক্ষের ধনের মতো তা বুক
দিয়ে আগলে রাখে। নারীর কাছে তা মহা মূল্যবান সম্পদের মতো। সংসারের বন্ধন টিকে থাকার কারণ নারীর সীমাহীন
আত্মত্যাগ। জীবন রক্ষা করার ব্রত নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল সে। পরিস্থিতি সেই সুযোগ তাকে দেয়নি। বরং নিজের জীবন
শেষ করার দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল সে। আনিস রক্ষা না করলে নিজের জীবন ত্যাগের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটতো সেই
উপাখ্যান। আনিসের ভালোবাসা তাকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছে। সে আর কিছু চায়না। সবকিছুর বিনিময়ে রক্ষা
করতে চায় সেই ভালোবাসার বন্ধন।