insert-headers-and-footers
domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init
action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121ছেলের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে রহিমা। ছেলের বিয়ের সব ঠিকঠাক। কথা বার্তা, আয়োজনের সবকিছু সম্পন্ন
হয়েছে। হঠাৎ ছেলে এখন একি কথা বলে! ছেলের কথায় অকস্মাৎ উলটপালট হয়ে যায় তাঁর চিন্তা চেতনা। মুহূর্তে বিস্মৃত
হয়ে পড়ে তার অতীত বর্তমান। বহুদূর থেকে ভেসে আসা জীবন স্মৃতির তরঙ্গ একে একে ভেঙে পড়তে থাকে তার ওপর।
রহিমা এসএসসি পাস করার পর বহু সংগ্রাম করে কলেজে ভর্তি হয়। মেয়েদের এত পড়াশোনা করে কি হবে! বেশি
পড়াশোনা করলে মেয়েদের বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। যুগ যুগ ধরে শুনা প্রচলিত আরো কত কথা। এত কিছু পরেও শেষ
রক্ষা হয় না। এইচএসসি পরীক্ষার আগেই শুরু হয় তার বিয়ের তোড়জোড়। ভালো পাত্র। এমন উপযুক্ত পাত্র আর পাওয়া
যাবে না। আগ্রহ করে এসেছে পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না। আকর্ষণীয় সব যুক্তির শেষ নাই। সামনে পরীক্ষার কথা বলে বিয়ে
ঠেকানোর শেষ চেষ্টাও নিষ্ফল হয়। পাত্রপক্ষের নাকি একটি গোপন আশঙ্কা ছিল। একদিকে মেয়ে সুন্দরী তার ওপর
এইচএসসি পাশ করলে এই পাত্রকে বিয়ে করতে অস্বীকার করতে পারে। পাত্রপক্ষের দাবীটা অনুরোধে করে কন্যা পক্ষকে
জানায়। বিয়েটা পরীক্ষার আগেই সম্পন্ন করতে হবে। বলা হয় ছেলের দাদি অসুস্থ তিনি নাত বউয়ের মুখ দেখে যেতে
চান। এ কথার উপর আর যুক্তি খাটে না। অবশ্য আশ্বস্ত করা হয় বিয়ের পর মেয়েকে পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়া
হবে। মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে যেমনটা চিরকাল বলা হয়ে এসেছে। এদিকে বিয়ের যখন সব ঠিকঠাক হঠাৎ করে একটি
বিষয় নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ছেলের দাবি বিয়েতে একটা মোটরসাইকেল দিতে হবে। নিরুপায় রহিমা বাবা সেই দাবি পূরণ
করে দেন। রহিমার বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রহিমার কোল জুড়ে আসে ছেলে আতিক। ক্রমাগত বাড়তে থাকে সংসার আর সন্তানের চাপ।
শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদের পারিবারিক সংঘাত। রহিমাকেও মেনে নিতে হয় বাঙালি বউদের ললাট লিখন। ব্যস্ত
স্বামীর সেদিকে কোন খেয়াল নেই। রহিমা বুঝে গেছে তাকে বলেও কোন লাভ হবে না। ছেলের ফুটফুটে মুখের দিকে চেয়ে
ভুলে থাকে সব। ভুলে যায় পরীক্ষা পড়াশোনার কথা। আর দশ জনার মতো জীবনের চাওয়া সংসারের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ
করে ফেলেন।
একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ ঘটে যায় সর্বনাশ। রহিমার স্বামী সোহেল লাশ হয়ে বাড়ি ফেরে সঙ্গে
দুমড়েমুচড়ে যাওয়া শখের মোটরসাইকেলটি। জীবনের সব স্বপ্ন যমদূতের মতো মুহূর্তে কেড়ে নিল মোটরসাইকেল। মাথার
উপরে সূর্যটা হঠাৎ যেন দপ করে নিভে গেল। নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারি দিক। সদ্য স্বামী হারা রহিমার
আহাজারি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে আকাশে বাতাসে। স্বামীর প্রাণহীন লাশের সঙ্গে নিজেকেও জীবন্ত লাশ মনে হয় তাঁর।
বাস্তবতার নির্মম পরিণতির কঠিন সত্যটা সামনে
এসে দাঁড়ায়। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না। একদিন শাশুড়িকে বলতে শুনে, ডাইনি, পোলাডারে খাইছে এখন
আবার কারে খায়!
রহিমা স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। রহিমার পিতা হাসেম আলী বিবেচক মানুষ মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে
পারেন। মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ে দেওয়ার অনুশোচনা তাকে দগ্ধ করে। মেয়েকে কাছে ডেকে বলেন, সারা জীবন
পড়ে আছে। এইভাবে জীবন পার করবি কি করে? আমরা কদিন তোকে পাহারা দিয়ে রাখব? ছেলেটাকে ওই বাড়িতে দিয়ে
আয়। তারপর বিয়ে শাদী করে আবার সংসারী হ। রহিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। আবার সংসারের স্বপ্ন দেখার
বিলাসিতা বিষময় পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সুখের চেয়ে জীবন বিষাক্ত হবার নজিরই বেশি। ছেলে আর নিজের
জীবন বাঁচাতে স্বাবলম্বী হওয়া ছাড়া উপায় নাই। পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা দরকার। অভিমানী কন্ঠে বাবাকে বলেন,
কপালে সুখ থাকলে এক বিয়েতেই সুখ হতো। সুখ চাইলে আমার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দাও। মোটামুটি মেধাবী ছাত্রী
ছিল সে। জীবনপণ করে লেখাপড়া শুরু করেন। উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক সম্পূর্ণ করে প্রচন্ড একাগ্রতায়। তারপর বেশি
দিন বসে থাকতে হয়নি। ভাগ্যক্রমে জুটে যায় প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষকের চাকরি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন রহিমা।
বহু সংগ্রামে জীবনে একটা স্বচ্ছন্দ গতি অর্জিত হয়েছে তাঁর। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। ভালোই চলছিল সবকিছু।
গোল বাধালেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোফরান সাহেব। সুন্দরী রহিমা বিধবা। অল্প বয়সে পতিহীন জীবন পার করার কষ্ট
তিনি বোঝেন। বিষয়টি তিনি নিজে বুঝে ক্ষান্ত না থেকে রহিমাকেও আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে থাকেন। গোফরান সাহেব
বিবাহিত। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু সম্পর্কে চিকিৎসায় অবহেলার কানাঘুষা
শোনা যায়। রহিমার প্রতি গোফরান সাহেবের অনুরাগ দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। দুই
স্ত্রী রাখার ধর্মীয় বিধানসহ তুলে ধরতে থাকেন নিজের যোগ্যতা। তৈরি করেন অকাট্য যুক্তি। এটা রহিমার দ্বিতীয় বিয়ে
এবং তার ক্ষেত্রেও দ্বিতীয়। সমানে সমান। মৃত প্রথম স্ত্রীর বিষয়টি বেমালুন চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সবাই সে কথা
বুঝলেও কোন কথার পাত্তা দেন না তিনি। অতএব এই বিয়েতে অসুবিধা কোন কারণ দেখেন না গোফরান। সে রহিমাকে
বিয়ে করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। রহিমাও মরিয়া হয়ে ওঠেন এমন বিয়ে পাগল লোকের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে।
অবশেষে পরিস্থিতি এগোতে থাকে চিরচেনা সেই গতানুগতিক পথে। শুরু হয় তাঁর চরিত্র নিয়ে কথা। রহিমা ভাবেন
বিধাতা নারীর জীবন কেন এমন চক্রে বন্দী করে দিয়েছেন। দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। অবশেষে শিক্ষা দপ্তরের ঊর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষের নিকট বিষয়টি অবহিত করেন। কর্তৃপক্ষ অবগত হয়ে গোফরান সাহেবকে অন্যত্র বদলী করে দেন। রহিমা হাঁফ
ছেড়ে বাঁচেন। জীবন তছনছকারী এক সংকট থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে সে। ছেলে আতিক ছিল রহিমা বেঁচে থাকার
একমাত্র অবলম্বন। ছেলের কথা ভেবে সতর্কতার সঙ্গে সব সম্পর্ক থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে সে। প্রতিমুহূর্ত সংগ্রাম
করেছে টিকিয়ে রাখা এবং টিকে থাকার জন্য। জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বিসর্জন দিয়ে ছেলের মধ্যে খুঁজেছে বেঁচে থাকার
সার্থকতা। ছেলে তার বড় হয়েছে। এখন চলছে সেই ছেলের বিয়ের আয়োজন।
রহিমা শরীরটা কদিন ভালো যাচ্ছে না। বুকের একপাশে চিনচিনে ব্যথা। শরীর খারাপ নিয়েও তত্ত্ববোধন করছে বিয়ের
সব আয়োজন। কোথাও কোন ত্রুটি যেন না থাকে। অবস্থাপন্ন ঘরের আদরের মেয়ে লুনা। যেমন মিষ্টি চেহারা তেমন
মিষ্টি আচরণ। রহিমা এমনটিই চেয়েছিল। তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলেন, জীবনটাকে সার্থক মনে হয় তাঁর। রহিমা লক্ষ্য করেন
ছেলে আতিক তাঁর পাশে কদিন ধরে ঘুরঘুর করছে। কি যেন বলতে চায়। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে রহিমা ছেলেকে কাছে
ডাকেন। কিরে কিছু বলতে চাস? আদর করে বলেন রহিমা। আতিক সাহস করে কথাটা বলে ফেলে। মা, ওরা শুনলাম
অনেক কিছু দেওয়ার আয়োজন করছে। আমার কিছু লাগবে না। তার পরের কথাটা বজ্রাঘাতের মত মুহূর্তে সমস্ত
শরীরকে ভস্মীভূত করে ফেলে। ছেলের কথা ছিল, আমার কিছু লাগবে না ওদের একটা মোটরসাইকেল দিতে বলো।
রহিমার কন্ঠ থেকে একটি শব্দ নির্গত হয়েছিল, তুই কোনদিন মোটরসাইকেল চালাবি না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন
রহিমা। ডাক্তার এসে জানায় হার্ট অ্যাটাক করেছিল।
পুনশ্চঃ বিয়ে ভেঙে যায়। অপয়ার অপবাদ জোটে লুনার কপালে। দীর্ঘদিন পরে আতিক খোঁজ নেয় মেয়েটির। লুনার বিয়ে
হয়নি শুনে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। আতিক লুনার বিয়ে হয় এবং আতিক আর কোনদিন মোটরসাইকেলে ওঠেনি। আবেগ
পরিহার করে সে উপলব্ধি করে বাস্তবতা। আতিকের মায়ের সম্পূর্ণ জীবনটা মোটরসাইকেল ট্রাজেডির একটি নির্মম
উদাহরণ। বাইক দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ মৃত্যু হয় জীবন শুরু করা তরুণদের। প্রতিদিন কত মায়ের কোল খালি হয়, কত
সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী হারায় স্বামীকে। মৃত্যুর এই মহোৎসব অপ্রতিরোধ্য ধারায় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ওটা একটা
অনিরাপদ যানবহন। কোন এক পর্যায়ে দুর্ঘটনা ঘটাবেই। তখন দেহে প্রাণ থাকা না থাকা পরের প্রশ্ন।