Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
আলো মেঘের কালো ছায়া-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

আলো মেঘের কালো ছায়া-সুলেখা আক্তার শান্তা

সরোয়ার পুরো এলাকা চোষে বেড়ায়। সরোয়ারের জ্বালায় কারো গাছে ফল ফলাদি থাকে না। কারো গাছে ফল দেখলেই সরোয়ার পেরে নিয়ে যায়। কেউ কিছু বললে উপদ্রব আরো বেশি করে। সেই সঙ্গে গাছের ডালপালাও ভেঙ্গে রেখে আসে। এই বিষয় তাকে কোন ভাবেই বিরত করা যায় না। সরোয়ারের একাকী জীবন। পরিবারের কেউ নাই যার কাছে তার বিরুদ্ধে বিচার দেওয়া যায়। কাজকর্ম সে কিছুই করে না। পেটের তাগিদে কখনো কিছু কাজ কাম করে। যা পায় তাই হাট বাজার করে নিজেই রান্না করে খায়। এমন অবস্থা দেখে গ্রামের নাসির আহমেদ গার্জিয়ান হয়ে সরোয়ারকে বিয়ে করিয়ে দেন। চাল চুলা হীন সরোয়ার সংসার করার মতো তেমন কিছুই ছিল না। শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র সরোয়ারকে দেওয়া হয়। তা দিয়েই তাদের সংসার সাজানো হয়। স্বামীর যে কিছু নেই তা নিয়ে সাহিদার আফসোস নেই। তার ভাবনা গায়ে খেটে কাজ করলে কোন কিছুরই অভাব হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো সরোয়ার কোন কাজ করতে চায় না। সাহিদা স্বামীর কাজের জন্য যতই তাড়াহুড়া করুক তাতে কোন কাজ হয় না। কি করবে পেট তো আর বোঝেনা। বাপের বাড়ি থেকে এটা ওটা চেয়ে আনে তা দিয়েই সংসার চলে। সাহিদা এটাও ভাবে এইভাবে তো আর সংসার চলে না। সংসার চালানোর জন্য আয় রোজগারের পথ করা দরকার। সে বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা এনে বাড়ির পাশে একটি দোকান
দেয়। ভাগ্যক্রমে দোকানটা বেশ ভালোই চলতে থাকে। সরোয়ারের সংসার খরচ জোটানোর মুরোদ না থাকলেও আছে বড় বড় কথা। মেয়ে মানুষের দোকান চালানো যাবে না। সাহিদা স্বামীর কথায় বেঁকে বসে। কেন দোকান চালানো যাবেনা? পরপুরুষ তোর মুখ দেখুক এটা আমি চাইনা। খাওয়ান পরন দিতে পারেন না বড় কথা তো ঠিকই বলতে পারেন।

সারোয়ারের পৌরুষে আঘাত লাগে। কি আমি খাওন পরন দিতে পারি না? বলেই সাহিদার গায়ে হাত তোলে। তোর দোকান করা ছুটামু। সাহিদার এককথা, আমি তো আর চুরি চামারি করতাছি না। আমি কাজ করে পেট চালাচ্ছি। এতে যদি কেউ কিছু বলে, বলুক, আমি সেকথার ধার ধারি না। যেখানে কাজ কইরা তুমি আমারে খাওয়াইবা সেইখানে আমি কাজ কইরা তোমারে খাওয়াই। বইসা খাও তুমি। সংসার খরচ চালাইতে পারো না তাই দোকান করা নিয়ে কোনো কথা বলবা না। বউয়ের কামাই খাবা আবার বউয়ের কাছ থেকে টাকাও নিবা, আর শাসিয়ে বলবা, দোকান চালাইতে পারবি না। সাহিদা দোকান করে কিছু টাকা জমায় সেই টাকা সরোয়ার না বলে নিয়ে যায়। সাহিদা বিলাপ করে কাঁদতে থাকে। আমার কি সর্বনাশ করলো, কয়টা টাকা জমাই ছিলাম তাও নিয়ে গেছে। সাহিদার মেয়ে হয়। দুর্ভাগ্য মেয়েটি জন্মায় এক চোখে অন্ধত্ব নিয়ে। সেই কারণে সরোয়ার বউকে প্রায়ই মারধর করে। স্ত্রীকে দোষারোপ করে, তোর কারনেই আমার সন্তান অন্ধ হইছে।
চিরাচরিত নিয়মে দোষারোপের বোঝা মাথায় নিতে হয় সাহিদাকে। যেন ইচ্ছে করে মা তার সন্তানকে এক চোখ অন্ধ করে জন্ম দিয়েছে। এতে সরোয়ারের কোন দোষ নেই। আবহমানকালের নিয়মে পুরুষের দেওয়া অপবাদ মাথায় নিয়ে পার করতে হয় নারীর জীবন। এরপর জন্ম নেয় আরো দুই সন্তান। সাহিদা মনস্তাপ, স্বামীকে বলে, তুমি তিনটা সন্তানের বাবা।

কোনদিন পারো নাই রোজগার করে সন্তানের সামনে কিছু এনে দিতে। যা করার আমাকেই করতে হয়। সারোয়ারের নির্লিপ্ত উত্তর, তুই পারোস তাই করস, আমি পারিনা তাই করি না। কেন তোমার লগে হাত পাও নাই? বুদ্ধি আক্কেল নাই? সবই আছে কিন্তু তোমার কাজ করতে ভালো লাগে না। আইজাইরা খাওন পাইলে কেউ কাজ করে? এই যে তুমি বসে বসে সব পাচ্ছো এতে লজ্জা শরমের বালাইও তোমার নাই। খোঁটা দিবি না। খোঁটা দিলাম কই? কিছু বললেই খোঁটা হয়ে যায়। তোমার নাদুস নুদুস শরীরটা পালছো কোন কাজকাম না করে। তিনটা সন্তানের বাপ হইলা। রোজগার পাতি না করে পুরা সংসারের দায়িত্ব দিয়া রাখছো বউয়ের মাথার উপর নিশ্চিন্তে। সাহিদা বীতশ্রদ্ধ। সংসারের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত। সে বলে, এমন সংসার দিয়ে কি করমু। যেদিকে দুই চোখ যায় সেই দিকে চলে যাব। থাকো তুমি তোমারে লইয়া। সন্তান তিনজন নিয়ে সাহিদা ঢাকায় চলে যায়।

ঢাকায় এসে একটা চায়ের দোকান দেয় সাহিদা। সারাদিন সে দোকান করে। বাসায় লুইপা রান্নাবাড়া করে আর ছোট দুই ভাই বোনকে দেখাশোনা করে। সাহিদা বাসায় এসে দেখে সবকিছুই গোছগাছ। বড় মেয়েটা সংসারের সবকিছু করতে পারে দেখে সংসার নিয়ে তার ভাবতে হয় না। সে থাকে দোকান নিয়ে। মা এলে লুইপা তাড়াতাড়ি খাবার দেয়। যাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে মা আবার দোকান যেতে পারে।
সাহিদা দোকান, ছেলেমেয়ে নিয়ে দিন ভালোই চলছিল। কিছুদিন হলো তার শরীর আর চলে না। ডাক্তারের কাছে যায় ওষুধ খায়, কিন্তু কোন উন্নতি নাই। এখন দোকানের কাজ তেমন করতে পারেনা। দোকানে লোকজন আসলে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস তাড়াতাড়ি দিতে পারে না। এভাবে দোকানের আয় রোজগারও ধীরে ধীরে কমে আসে। লুইপা ভাবে সে দোকানে বসবে। কিন্তু সাহিদা মেয়েকে দোকানে বসতে দিতে চায় না। মেয়েকে বলে, দোকানে বসবি কে কি বলবে কে কি ভাববে। লুইপা মা কে বলে, মা, মানুষ কি বলবে বলুক। কেউ কি আমাদের এক বেলা খাবার দেবে? মানুষ মানুষের ভাবনা ভাবুক আর আমরা আমাদের কাজ করে যাই।
সময় এগিয়ে চলে। লুইপা দোকানে বসে। আয় রোজগারও ভালো। দোকান ভালোভাবে চলাতে লুইপা একা পেরে ওঠে না। লাইজু বোনের সঙ্গে দোকানে বসতে শুরু করে। ছোট ভাই মাহিন পড়ালেখা করে। লুইপা দেখে কিছু টাকা তার জমেছে। বোনটা বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। লুইপা মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে, টাকা পয়সা যখন কিছু আছে আমরা একটা ছেলের খোঁজ করে লাইজুর বিয়ে দেই। বড় মেয়ের এমন উদ্যোগে সাহিদা খুব খুশি হয়। বলে, মা আগে তোর বিয়েটা দেওয়ার দরকার। মা আমার বিয়ে হলে ভাইয়ের পড়াশোনা চলবে কি করে? তারপর তোমাকে দেখবে কে? সাহিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জীবন এক প্রবাহ মতো কোন কিছুর জন্য কোন কিছু থেমে থাকে না। মা তুমি বেশি ভেব না। আমার ভাই বোন আর তোমাকে ছাড়া আমি নিজের জন্য কিছু ভাবিনা। লাইজুর বিয়ে হয়। প্রশান্তি পায় সাহিদা।

লুইপার দোকানের সামনে দিয়া গার্মেন্টসে আসা যাওয়া করে সুমন। মাঝে মাঝে লুইপার দোকানে বসে চা খায়। লুইপা নিজের দোকান করা নিয়ে ব্যস্ত। দোকানে চা খেতে খেতে সে লুইপার দিকে তাকায় এটা লুইপা লক্ষ্য করে না। একদিন সুমন বলে আমি প্রায়ই তোমার দোকানে বসি, কেন বসি বলতে পারো?
চায়ের জন্য বসেন। শুধুই কি চার জন্য? আমি বেশি কিছু বুঝিনা। আর কোনকিছু বুঝতেও চাই না। কেন আপনি বসেন আমি কি করে বলবো? তোমার জন্য বসি। আমার জন্য বসেন আমার আবার কি হলো?
তোমাকে দেখার জন্য। অন্ধ মানুষকে কেউ দেখতে চায়? যার এক চোখ অন্ধ। সুমন আর কোন কথা বলে না চুপ করে চলে যায়। এক চোখ অন্ধ শ্যাম বর্ণের লুইপার চেহারায় এক মায়াবী আকর্ষণ আছে। সুমন হয়তো সেই আকর্ষণের খোঁজ পেয়েছে। সুমন দেশ থেকে তার মামাকে নিয়ে আসে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মামাকে লুইপাদের বাসায় পাঠায়। সুমনের মামা দবির দেখেন লুইপার এক চোখ অন্ধ। সে ভাগ্নেকে এখানে বিয়ে করাতে নিষেধ করেন। সে সাফ জানিয়ে দেন, না এখানে বিয়ে করা যাবে না। কিন্তু সুমন এখানেই বিয়ে করবে। সুমনের পরিবারের একই কথা, না এই মেয়েকে বিয়ে করানো যাবে না। সুমনের পরিবারের কথা ছেলে আমার শিক্ষিত। সে ভালো মেয়ে পাবে। এই মেয়ে দেখতে সুন্দর না, পড়ালেখা জানেনা তার উপর চোখ একটা
অন্ধ। এই মেয়ে সুলক্ষণা না। একে ঘরের বউ করা যাবে না। সুমনের পরিবার রাজি না হলেও লুইপার মা বিয়েতে সম্মত।

সে মেয়েকে বুঝিয়ে রাজি করে। মেয়েকে বলে, মা তুই দেখতে কালো, পড়ালেখা জানিস না। তারপর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। তোর ছোট বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কি কোন ছেলে আসবে বিয়ে করতে? তাও ভালো এই ছেলে সব জেনেশুনে বিয়ে করতে চাইছে। ছেলের পরিবার রাজি না থাক ছেলে তো রাজি। সুমনের পরিবারের অমতেই সুমন আর লুইপার বিয়ে হয়। লুইপার শ্বশুর বাড়ি যাওয়া হয়নি। সন্তান হওয়ার পরও শ্বশুরবাড়ির মানুষ তাকে মেনে নেয় নেই। স্বামী সন্তান নিয়ে লুইপা ভালোই আছে। স্বামীর ভালোবাসায় তার শ্বশুরবাড়ির না যাওয়ার আফসোস নাই। স্বামী সন্তান নিয়ে সে অনেক সুখী।