রিতা আর সানজানা দু’বোন। বাবার অতি আদরের মেয়ে। তাদের মা মারা যাওয়ার পর বাবা সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর
বিয়ে করবেন না। দুই মেয়েকে নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন। আজিজা ছেলে তোফায়েলকে বলেন, বাবা তুই আবার
বিয়ে কর। সংসারটা গুছিয়ে রাখার জন্য তো কাউকে দরকার। না মা আমি আর বিয়ে করবো না, আমার দুই মেয়েকে
নিয়েই থাকতে চাই আমি। তোফায়েল আহমেদ তাঁর সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন। আজিজা মুখে যাই বলুক সে জানে সৎ মায়ের
সংসারের পরিণতি। মা মরা ফুটফুটে দুই নাতনির জীবনে তিনি চান না তেমন দুঃসহ পরিণতি নেমে আসুক। তারপরও
তোর সংসারটা দেখার জন্য একজন মানুষ দরকার। আমি আর কতদিন, মেয়ে দুটো বিয়ে দিলে পরের বাড়ি চলে যাবে।
আজিজা বাস্তবতা বোঝাতে চান। মা, আমার মেয়ে দুইটাকে কেউ চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলবে এটা আমার সহ্য হবে না।
আমি এভাবেই থাকতে চাই যত কষ্টই হোক। ঠিক আছে বাবা। রিতা আর সানজানা বাবার দুই পাশে দুইজন দাঁড়িয়ে
একসঙ্গে বলে ওঠে, বাবা তুমি আমাদের প্রিয় বাবা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। কেন মা আমি প্রিয় হলাম তোমাদের কাছে?
আমরা যা বলি তুমি তাই শোনো। আমাদের কোন আবদার অপূর্ণ রাখনা। আমাদের খাইয়ে দাও, ঘুম পাড়িয়ে দাও,
আমরা যা চাই তাই দাও। তোমরা আমার দুই রাজকন্যা, আমার বাবা হওয়া সার্থক করে রেখেছো। আজিজা আনন্দ অশ্রু
লুকাতে পারেনা।
এলাকায় তোফায়েল আহমেদ একজন গণমান্য ব্যক্তি। বিভিন্ন বিচার সালিশে তাঁর ডাক পরে। কোন কোন দিন বাড়ি
ফিরতে রাত হয়। কিন্তু মেয়ে দু’জন বাবাকে ছাড়া পড়বে না, খাবে না, এমনকি ঘুমানোর সময় ঘুমাবেও না। কখন বাবা
আসবে সেই অপেক্ষায় থাকে। আজিজা নাতনিদের তাগাদা দেয়, খাওয়া, পড়া, ঘুমানোর কথা বলে। কে শুনে কার কথা,
তাদের এক বুলি বাবা আসবে তারপর। ছেলে আসার পর আজিজা অনুযোগ করে বলেন, তুই জানিস মেয়ে দুইটা তোকে
ছাড়া কিছুই বোঝে না তাও কেন রাত করে বাড়ি ফিরিস? মা এলাকার লোকজনের দিকটাও তো দেখতে হয়, কাজ শেষ
হলে দেরি করি না, সোজা বাড়ি চলে আসি। তোর মেয়েদের তো বোঝানো যায় না। তাদের একই কথা, বাবা আসে না
কেন? নে মেয়েদের কাছে গিয়ে ওদের মনটা শান্ত কর। তোফায়েল আহমেদ মেয়েদের কাছে যান। মাথায় হাত বুলিয়ে
আদর করেন। মেয়েরা সমস্বরে বাবার প্রতি তাদের অভিযোগের কথা বলে। তোমার সঙ্গে কথা বলবো না, তুমি এত দেরি
করে আসো কেন? মা বাহিরে কাজ থাকে, তা সেরে আসতে হয়। আমিও তোমাদের রেখে বাহিরে থাকতে চাই না।
দু’বোনের এককথা নাও হয়েছে আর বলতে হবে না, এখন থেকে আর ভুল করোনা। ঠিক আছে মা। তোমাদের কথার
অমতে চলা যাবে না।
গড়িয়ে চলে সময়ের স্রোত। সানজানা আর রিতা বিয়ের উপযুক্ত হতে না হতেই বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। তোফায়েল
আহমেদ বলেন, মেয়ে আমার ছোট, বিয়ের বয়স হয়নি। অনেক বিয়ের প্রস্তাব না বলে দেওয়া হয়। তারপরও প্রস্তাব
আসতে থাকে। তোফায়েল আহমেদের দুই মেয়ের বিয়ের পাত্র আসার যেন হিড়িক পড়ে গেছে। সানজানা বড় মেয়ে, তাই
বিয়ের জন্য পাত্র আসলে সানজানাকেই আগে দেখানো হয়। সানজানা আর রিতা দুজনেরেই বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে।
একবার কাকতালীয়ভাবে দু’জনকেই দুই পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায়। এমন ঘটনাও ঘটে। তোফায়েল আহমেদ যতই বলেন,
মেয়েদের বিয়ে দিবেন না তাতে প্রস্তাব আসা বন্ধ হয় না। দুই মেয়ের একসঙ্গে বিয়ে দিলে শূন্য হয়ে যাবে তার ঘর। শূন্য
ঘরে কেমন করে থাকবেন তিনি। সানজানাকে এক পাত্রপক্ষ পছন্দ করে। তাদের কথা পাত্র পাত্রীর সঙ্গে একটু আলাদা
ভাবে কথা বলতে চায়। একান্তে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়। পাত্র নাদিম সানজানাকে বলে, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে
আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আবেগে নাদিম সানজানার হাত স্পর্শ করে কথাগুলো বলে। হাত স্পর্শ করায় সানজানা
ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। বিয়ের আগেই হাত ধরে, এই ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না। সে তার বাবাকে জানিয়ে দেয় এই পাত্রসঙ্গে
তার বিয়ে হবে না। নাদিম জেদি ছেলে। সে কম কিসে। বিয়ে করলে এখানেই করবে। পরিবারের লোকজন নাদিমকে শান্ত
করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নাদিমের এককথা যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে বাড়িতে। পাত্র হিসেবে নাদিম
কোন দিক দিয়ে কম নয়। এমন পাত্র হাত ছাড়া করা বোকামি। তোফায়েল আহমেদ বড় মেয়ের জেদের ব্যাপারে অবগত।
একবার না করলে তাকে দিয়ে হ্যাঁ করানো কোনভাবেই সম্ভব না। নাদিমের পাগলামো দেখে তোফায়েল আহমেদ ছোট
মেয়ে রিতাকে বিয়ে দেন নাদিমের কাছে।
নাদিম বলে, যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম তাকে আনতে না পারলেও আরেকজনকে তো এনেছি। রিতা অল্প বয়সে বিয়ে
হওয়ায় খুব কান্নাকাটি করে। বাবা, বোন, দাদিকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। কান্নাকাটি করার কারণে স্বামীর বাড়ি
থেকে রিতাকে প্রায় সময় বাবার বাড়ি দিয়ে আসা হয়। এক সময় রিতার মন-মানসিকতা ঠিক হয়। সে আর বাবার বাড়ি
যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে না। সানজানারও বিয়ে হয় সুপাত্র দেখে। সেও ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সানজানার
বাড়ি বেড়াতে যায় রিতা কিন্তু সানজানা কখনো রিতার বাড়িতে যায় না। নাদিমকে অবজ্ঞা করার বিষয়টি তাকে হয়তো
এখনো পীড়িত করে নীরব পরাজয়ের গ্লানি। রিতা কখনো তার বাড়িতে আসার জন্য বললে, সানজানা নানা অজুহাতে
এড়িয়ে যায়। সানজানা বোনের বাড়ি না আসুক কিন্তু বোনের প্রতি ভালোবাসার অনেক টান।
সানজানা আর রিতা দুই বোনই এখন কয়েক সন্তানের মা। রিতা চায় দুই বোনের ভালবাসার বন্ধন চিরদিনের জন্য অটুট
করে রাখতে। সানজানার ছেলের সঙ্গে রিতার মেয়ের বিয়ে দিলে দুই পরিবারের অবিচ্ছেদ বন্ধন সৃষ্টি হতে পারে। যে কথা
সেই কাজ। দুই বোন সম্মত হয় ছেলে মেয়ের এমন বিয়েতে। রিফাত আর রেহেনার দুজনের বিয়ে পাকাপাকি হয়ে থাকে
বড় হলে তাদের বিয়ে হবে।
নাদিম ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রেখে অকালে মৃত্যুবরণ করে। পরিবারকর্তার মৃত্যুতে সংসারে খুবই দুর্দশা নেমে আসে।
অনেক জমি ক্ষেত থাকায় রিতার কারো কাছে হাত পাততে হয় না। জমি বিক্রি করে সংসার খরচ চালায়। যে দুই বোনের
এত সুসম্পর্ক সে দুই বোনের এখন আর দেখা সাক্ষাৎ নাই, কোন যোগাযোগ নেই।
রিতার স্বামী মারা যাওয়ার পর সানজানা রিতার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখে না। ভাবে বোনের দিনকাল খারাপ যদি
বোনকে কোন কিছু দিয়ে সাহায্য করতে হয়। রিতারও জেদ, অভিমান কম না সে নিজেও তার বোনের সাথে যোগাযোগ
করে না। বোনের স্বামী মৃত্যুবরণ করল তখনও আসেনি চোখের দেখা দেখতে! তাছাড়া আগে পিছে অনেকবার যাওয়া
হয়েছে আনতে, আসে নাই। রিতার স্বামী মৃত্যুবরণ করার আগেই বাবা, দাদি মৃত্যুবরণ করেছেন। ছেলেমেয়ে নিয়ে রিতা
পড়ে থাকে স্বামীর ভিটায়।
সানজানা ছেলেকে বিয়ে করাবে তাই অনেক জায়গায় মেয়ে দেখে। কিন্তু রিফাত বিয়ে করবে না সে বেঁকে বসে। মা তুমি
যদি ছেলেকে বিয়ে করাও তাহলে ছেলের জন্য রেহেনাকেই ঘরের বউ করে আনো। এত রেহেনা, রেহেনা করিস না তো!
আমি কি কোন কিছুতে কম বুঝি? এককালের প্রতিশ্রুতি এখন কেন রাখবা না? এখন তাদের যে দিনকাল এই অবস্থায়
আমি তোকে সেখানে বিয়ে করাবো! ভালো-মন্দ মিলিয়ে মানুষের জীবন। আর এমন বেঈমানী আল্লাহ সহ্য করবেন না।
মায়ের মুখের উপর এমন কথা বলার তোর সাহস হলো কি করে?
মা আমি চাইনা তোমার কোন কথা বরখেলাপ হোক।
আমি কি করি না করি সেটা তোকে দেখতে হবে না। তোকে যেটা বলি তুই সেটা কর।
সানজানা ছেলেকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবে। রিফাত মাকে কিছু না বলে, সে রিতা খালার বাড়ি এসে হাজির। খালার কাছে
বলে, আমি রেহেনাকে বিয়ে করতে চাই। রিতা বলে, তুমি বিয়ে করতে চাও বেশ ভালো কথা, তোমার মাকে আসতে
বলো।
মা তো রেহেনাকে মেনে নিতে চায় না! সে রেহেনাকে তার ছেলের বউ করবে না। তোমার মা যদি না চায় সেখানে আমি
আমার মেয়েকে বিয়ে দেই কিভাবে!
খালা আপনি অমত করবেন না। বাবা আমি অমত করব না তুমি তোমার মাকে নিয়ে আসো। খালা আপনি আপনার
বোনকে চিনেন না? সে একবার যেটা না বলে সেটা তাকে দিয়ে হ্যাঁ বলানো যায় না। বাবা তোমার মা যেটাই বলবে সেটাই
হবে তা কি করে হয়? কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য তো দিতে হবে? আপনার বোন আপনি জানেন না সে কেমন? জানি
বলেই তো আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে চাই না। আমি গরিব, আমার গরিব অবস্থা নিয়েই থাকি।
তোমার মা ধনী সে তার অবস্থানেই থাক। আপনাদের দু'বোনের জেদের কাছে আমাদের দুইটা জীবন নষ্ট হয়ে যাক সেটা
চান? রেহেনা কোন কিছুই বলে না শুধু মা আর রিফাতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিফাত রেহেনার কাছে গিয়ে বলে,
তুমি আমার সঙ্গে চলো। আমাদের কাউকে লাগবে না, তুমি আমি বিয়ে করব। রেহেনা সাহস পায় না, সে মায়ের অনুমতি
চায়। মা তাকে অনুমতি তো দেয়ই না বরং সে রিফাতকে চলে যেতে বলে। রেহেনা কান্নাকাটি করে মায়ের কাছে কাকুতি
মিনতি করে। রিতা বলে আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। যার বাড়ির বউ হবা? সে তোমাকে মেনে না
নিলে তুমি সেখানে কি করে থাকবা? রিফাতকে বুঝিয়ে রিতা বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। রিফাত বাড়ি গেলে সানজানা একপ্রকার
জোর করে রিফাতের অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেয়। রিফাত বিয়েতে রাজি না থাকলেও পরিস্থিতির কারণে সবকিছু তাকে মেনে
নিতে হয়। রেহেনা রিফাতের বিয়ের খবর শুনে মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা তোমরাই জয়ী হইলা, পরাজয় যা
হওয়ার আমার হলো। যেখানে তোমাদের প্রতিশ্রুতির কোন মূল্য নেই। মানুষের মনের চাওয়ার মূল্য নেই। ছোটবেলা
থেকে তোমাদের কথাতেই মনের মধ্যে স্বপ্ন সৌধ গড়ে উঠেছিল। আজ তোমাদের স্বার্থ আর জেদের কাছে তা ধূলিসাৎ হয়ে
গেল। মানুষ জীবনের সাধ ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে সন্তানের ইচ্ছার মূল্য দেয়। আর তোমাদের কারণে সন্তান পেল বেদনা
জীবন।