Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
শূন্যতা পূরণ-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

শূন্যতা পূরণ-সুলেখা আক্তার শান্তা

আনিস অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মায়া সবকিছু গুছিয়ে তার সামনে এনে রাখছে। ভাইয়া আপনি তো নাস্তা করেননি! নাস্তা করেছি। যতটুকু পেরেছি খেয়েছি। তুই কি আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে মেরে ফেলবি? আপনার খাওয়া তো পাখির আদার। এত কম খেলে কী করে চলবে? এ বয়সেই তো খাবেন, বয়স হলে খেতে পারবেন? বয়স হলে মানুষ নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়! তখন চাইলেও খেতে পারে না। হয়েছে, তুই বুড়ো মানুষের মতো কথা বলিস না। ভাইয়া,দুপুরে কী রান্না করবো? তোর যা ভালো লাগে তাই কর। আনিস অফিসে চলে যায়। মায়া আপন মনে গুনগুন করতে করতে ঘরের কাজে মন দেয়।

মায়া খুব সকালে আনিছের বাসায় চলে আসে। আর যায় রাতের খাবারের সব আয়োজন শেষ করে। মায়া দেখতে শুনতে মন্দ না, শ্যামলা হলেও সুশ্রী। চটপটে এবং বুদ্ধিদীপ্ত। কেউ দেখলে ভাববে না সে কাজের লোক। পোশাক আশাক আর ব্যক্তিত্ব সমীহ আদায় করে নেওয়ার মতো। আনিসের অফিস বাসার কাছে হওয়ায় দুপুরের লাঞ্চ বাসায় এসে করে। আনিস খেতে খেতে মায়াকে বলে, তুই না থাকলে বিপদেই পড়তে হত। যেভাবে যত্ন করে সমস্ত কাজ করিস অন্য কেউ এভাবে করত না। তোর কর্তব্যবোধে আমার দায়িত্ববোধ জাগ্রত হচ্ছে। এবার তোর একটা বিয়ে শাদি দেই। ভাইয়া আমার বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার বিয়ে হলে আপনার দিকে লক্ষ্য রাখবে কে? সে ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না। এক ব্যবস্থা হবেই। মায়া বলে, ভাইয়া আপনি বিয়ে করেন। ঘরে ভাবি আসুক। আনিস হাসতে হাসতে বলে, বিয়ে করবো দায়িত্ব আছে না আমি সংসারের বড় ছেলে। দায়িত্বের জন্য নিজের দিকটা দেখবেন না? এই যে আমাকে বিয়ে দিতে চান, বিয়ে হলে আমার ভাইয়ার রান্না করবে কে? দেখাশোনা করবে কে? তুই তোর ভাইয়াকে নিয়ে এত চিন্তা করিস! আনিস বড় ভাইয়ের মতো দায়িত্ব পালন করে মায়ার। কিছুদিন হলো একটি ছেলের উপর নজর পড়েছে। ছেলেটিকে তার পছন্দ। আগ্রহ করে ছেলেটির বিস্তারিত খবরা খবর নেয়। ছেলেটির অভিভাবকদের ডেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তারা সানন্দে রাজি হয়।

আনিস বিয়ের খরচ বহন করে। তার মহানুভবতায় সবাই মুগ্ধ হয়। আনিস স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে, যাক মেয়েটার বিয়ে হলো। বাসার জন্য অন্য কাজের লোক রাখে। কিন্তু মায়ার মতো আন্তরিকতার সঙ্গে কেউ কাজ করে না। এই ব্যাপারগুলো আনিসকে মায়ার কথা খুব মনে করে দেয়। আনিস বিয়ে করে। স্ত্রী টিনা খুব রাগী। যা বলে তাই করতে হয়। কোন কিছু এদিক সেদিক হলে খুব রেগে যায়। রাগলে তাকে আর থামানো যায় না। বড় ভাই মনে করে, আনিসের প্রতি মায়া সব আবদার অধিকার খাটায়। মায়া স্বামীকে নিয়ে ভাই আনিসের বাসায় বেড়াতে আসে। এ ব্যাপারটা টিনার ভালো লাগে না। কাজের মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছো। পর্ব শেষ।
সে স্বামী নিয়ে এখানে কেন বেড়াতে আসবে? কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। আনিস বোঝাতে চেষ্টা করে। ও আমাকে ভাই বলে মান্য করে, তাই ভাই মনে করে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছে। ক্ষিপ্ত টিনা বলে,‌ রাখো এসব, কাজের লোকের ভাই সাজতে চাও তুমি! তোমার বাসায় থেকেছে, খেয়েছে, বেতন নিয়েছে, আবার টাকা পয়সা খরচ করে বিয়ে দিয়েছো! এরপর তো তোমার কিছু করার নাই। টিনা তুমি আমার স্ত্রী এইভাবে কথা বলো আমি তা চাই না। ওকে আমি কাজের লোকের মতো কখনো দেখিনি। বড় মুখ করে এসেছে। আমাদের বাসায় দুই চার দিন থেকে পর চলে যাবে। আর তুমি যে সব কথা বলছ ও শুনতে পেলে কষ্ট পাবে। রাখো তুমি, ও কষ্ট পেলে কী হবে? স্বামী নিয়ে বেড়াতে জায়গা পেল না। আনিস কী খেতে পছন্দ করে মায়া সেসব রান্না করে। মায়া এ বাসায় থাকতে যেভাবে কাজ করতো সেভাবেই এখন কাজ করে। সবকিছু আগের মতো গোছগাছ করে রাখে। মনে করে তার আন্তরিকতায় ভাবি খুশি হবে। কাজ করতে করতে দেখে ড্রেসিং টেবিলের উপর গলার একটি হার পড়ে আছে। মায়া কৌতুহলবশত হারটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে। গলা বরাবর ধরে দেখে। কেমন লাগছে বুঝার জন্য হারটি গলায় পড়ে, গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে
দেখে তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। হারটি খুলে রাখে সে। টিনা ড্রেসিং টেবিলের কাছে এলে বলে, ভাবি আপনার হার। টিনা বলে, তুই হারটি ধরেছিস? হ্যাঁ ভাবি আমি গলায় পরছিলাম কেমন লাগে দেখতে। তোর সাহস তো কম না? তুই আমার জিনিস ব্যবহার করেছিস আমার অনুমতি ছাড়া! আর কী করেছিস কে জানে! কাঁচুমাচু হয়ে মায়া বলে, ভাবি আমার ভুল হয়েছে। এখানে হারটি দেখে আমি একটু গলায় পড়েছিলাম কেমন লাগে দেখতে। মেয়েদের স্বভাব তো আপনি জানেন?

আর আপনাকে তো তা বললাম। টিনার রাগ তখনও পড়েনি। কত বড় সাহস আমার হার পরছে। এরকম সাহস দেখাবে না। মায়া মনে মনে ভাবে, ভাইয়া কত ভালো মানুষ, তার স্ত্রী কেমন! মায়ার বেড়ানো হলে চলে যায়।
টিনা সবসময় কী এক মাথাব্যথায় ভোগে। এজন্য তার শরীর অনেক খারাপ থাকে। সংসারের দিকে তেমন লক্ষ্য রাখতে পারেনা। কাজের লোকের উপর সংসারের দায়িত্ব দিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু টিনার কারো কাজ পছন্দ হয় না। থালা বাটি ভালোভাবে ধোয়া হয় নাই, ঘর ঝাড়ু ঠিকমতো হয়নি, কাপড় ভালো পরিষ্কার হয় নাই, রান্না ভালো হয় নাই। কাজের লোকের নানা দোষ ধরতে থাকে। কাজের লোকও বিতৃষ্ণা হয়ে যায় টিনার উপর। কদিন পরপরই কাজের লোক চলে যায়। আনিস বলে শোনো তোমার যদি এদের দিয়ে কাজ করতেই হয় তবে এদের একটু স্বাধীনতা দিতে হবে। এদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। অসহিষ্ণু টিনা বলে, এরা ভালো করে কাজ করবে না তবুও এদের আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলতে হবে! আনিস পরিস্থিতি শান্ত করতে চেষ্টা করে। না, তা তুলবে কেন? একটা বাসায় কাজের লোক থাকা না থাকার সঙ্গে মান সম্মান ব্যাপার জড়িত। যেমন ধরো একটা বাড়িতে ঘন ঘন টুলেট টানানো থাকলে ওই বাড়ির বদনাম হয়। শুরু হয়ে যায় পুরো মহল্লায় বাড়িওয়ালার সমালোচনা। বাড়িওয়ালা লোক ভালো না তাই তার বাড়িতে ভাড়াটিয়া থাকে না।‌ টিনা
বিরক্ত হয়ে বলে, আমাকে এত যুক্তি দেখিও না তো! আর অন্যের জন্য নিজের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করো না।  আনিসের চেয়েও টিনার বাবার অবস্থা ভালো। স্বামীকে যে কোন কথায় টিনা বাবার অর্থের দাপটের খোঁচা দিতে ছাড়ে না। আনিস বলে টিনাকে, আমার চেয়ে তোমার বাবার অবস্থা ভালো। আমার যে কম আছে, তাই বলে আমি তোমার বাবার কোন কিছু চাই নাই। টিনা বলে, তুমি যদি কোন কিছু নিতে সেটা হতো যৌতুক। তুমি কি যৌতুক নিতে। আনিস বড় চোখ করে টিনের দিকে একটু তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে, যৌতুক নেয়নি তাতেই এত দাপট যৌতুক নিলে না জানি কি দাপট দেখাতে। টিনা যখন হেসে, আনন্দে কথা বলে, আনিসের তখন অনেক ভালো লাগে। ভাবে এমন করে যদি টিনা সবসময় কথা বলতো তাহলে কতই না ভালো লাগতো। টিনা স্বামীকে বলে, শোনো তোমাকে একটা খুশির সংবাদ দিতে চাই। বলো কী বলতে চাও। আমাদের নতুন অতিথি আসছে। আনিস আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। আমাদের ঘর আলো হবে? আমি বাবা হব? এই আনন্দে আনিস টিনাকে জড়িয়ে ধরে উঁচু করে তোলে। টিনা বলে ছাড়ো ছাড়ো যদি পড়ে যাই মহা সর্বনাশ হবে। আনিস টিনার কপালে চুমু দিয়ে ছেড়ে দেয়।

একদিন হঠাৎ ঘটে অঘটন। মায়া আনিসের বাসায় কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির হয়। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। তোর কী শেষ হয়ে গেছে বলবি তো? ভাবি আমার জামাই আমাকে তালাক দিয়েছে। আমার এখন কী উপায় হইবে! আনিস ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, এটা কী মগের মুল্লুক নাকি চাইলেই একটা মেয়েকে ডিভোর্স দিব? আমি এটা দেখে ছাড়বো! টিনা বলে, তুমি উত্তেজিত হয়ো না। কিছু কিছু পুরুষ আছে তারা বউ ছেড়ে দিলেই বাঁচে। আনিস সামাজিক বিচার সালিশের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির অনেক চেষ্টা করে সফল হয় না। বিষয়টি আদালতে দীর্ঘমেয়াদী আইনগত জটিলতায় পরিণত হয়। মায়াকে থাকতে হয় আনিসের বাসায়। টিনা বিষয়টি খোলাসা করে নেয়। বলে, থাক তুই এখানে। কাজ করবি ভাত খাবি। টিনা মায়াকে একটার পর একটা কাজের হুকুম দিয়েই রাখে। মনে হয় সে কিনে ফেলছে মায়াকে। আনিস মায়াকে জিজ্ঞেস করে কোন সমস্যা, খেয়েছিস? কিছু দরকার হলে আমাকে বলবি। কী আইটেম রান্না হবে মায়া জিজ্ঞেস করে আনিসের কাছে। টিনা তাতে ক্ষিপ্ত হয়। কোন কিছু দরকার হলে আমাকে জিজ্ঞাসা করবি। আমি বলে দেবো কী হবে না হবে। আনিসকে বলে, আমার কাছে জিজ্ঞেস না করে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে কেন? আনিস বলে মায়াকে, কিরে তোর
ভাবিরে কোন কিছু জিজ্ঞেস করিস না কেন? ভাইয়া ভাবির তো সবসময় মেজাজ গরম থাকে, তাই তার কাছে জিজ্ঞেস করি না। তাছাড়া ভাবি অনেক সময় ঘুমিয়ে থাকে এই কারণে আমি তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করিনা। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভাবির যদি কোন সমস্যা হয় তাই ডাকি না। তারপরও তুই আমাকে জিজ্ঞেস না করে তোর ভাবিকে জিজ্ঞেস করিস সে কী খেতে পছন্দ করে না করে।

টিনার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবে। গর্ভধারণ জটিলতায় টিনা মারাত্মক রক্তশূন্যতায় ভুগছে। ডাক্তার বলেছে রক্ত দিতে হবে। কিন্তু টিনার যে রক্তের গ্রুপ সেটি সহজলভ্য নয়। এ গ্রুপের রক্ত দরকার এই মুহূর্তে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আনিস দিশেহারা কী করবে কিছুই ভেবে পায় না। মায়ার রক্ত এ নেগেটিভ। মায়া রক্ত দিতে প্রস্তুতি নেয়। আনিস মহা খুশি। বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে সুস্থ রাখতে আরো রক্ত দেওয়ার জরুরী প্রয়োজন। আনিস সব ব্লাড ব্যাংকে ছোটাছুটি করেও ওই গ্রুপের রক্ত সংগ্রহ করতে পারে না। পরিচিতদের মধ্যেও ওই গ্রুপের রক্তদাতা কাউকে পাওয়া যায় না। অসহায় আনিস মায়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। মায়া অতিমাত্রায় রক্ত দেওয়ায় তার শরীর অবসন্ন। চোখ নিচে কালি পড়েছে। ডাক্তার তার শরীর থেকে আর রক্ত নিতে চায় না। মায়া ডাক্তারকে অনুনয় করে বলে, আমাকে নিয়ে চিন্তা করেন না। আমার শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত নিয়ে নেন। ভাবি আর বাচ্চাকে বাঁচান। চিকিৎসা সফল হয়। টিনা আর বাচ্চা দুজনে পৃথিবীর আলো দেখে পূর্ন সুস্থতায়। কিছু দিন পর ভগ্ন স্বাস্থ্য
মায়ার মৃত্যু হয়। মায়া শরীরের পুরো রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে যায় মা আর সন্তানকে। মায়ার মৃত্যুতে আনিসের বুক ফাটে নিরব হাহাকারে। চিৎকার করে বলে, হতভাগী একি করলি! আমার জন্য তোর জীবনটা শেষ করে দিলি! ভাই বলে ডাকেছিলি তাই জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলি, আমি তোর জন্ম জন্মান্তরের ভাই। টিনা অশ্রুশিক্ত নয়নে বলতে থাকে, যে মেয়েটাকে আমি এত অবহেলা করলাম আজ সে আমি আর আমার সন্তানকে নিজ রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে গেল নিজের জীবন শেষ করে। তোর এ ঋণ আমরা শোধ করব কী করে। মায়ার মৃতদেহ বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,মায়া তুই একি করলি। আমার খারাপ ব্যবহারের প্রতিদান দিলি তুই এভাবে। টিনা ভাবতে থাকে, কারো সঙ্গে গরিমা দেখাইতে নেই। কাউকে তুচ্ছ করতে নাই। মানুষ মানুষের জন্য। কখন কে কার উপকারে আসে কেউ বলতে পারে না,একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।