রিমি পলি দুই বোন। পলি বেশ শান্ত রিমি খুব চটপটা। পলি সুন্দরী ফর্সা, রিমি শ্যামলা কালোও বলা চলে। রিমির সেসব নিয়ে কিছু আসে যায় না। মাথাও ঘামায় না তা নিয়ে। তার ধারণা চালাক চতুর হলে আর গুণ থাকলে কালোতে কিছু আসে যায় না। পলির বিয়ের কথা হয়। পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। এক দেখাতেই মেয়ে পছন্দ পাত্রপক্ষের। পলি দেখতে এমনই
যে কেউ তাকে এক দর্শনেই পছন্দ করবে। পলিরা ঢাকায় থাকে। পলির বাবার রয়েছে বিশাল সহায় সম্পত্তি। পাত্রপক্ষের নাসিরদের বাড়ি বরিশালের দক্ষিণে। তারাও এলাকার সম্ভ্রান্ত এবং ধনাঢ্য পরিবার। অনেক ঘটা করে পলির বিয়ে হয়। পলি স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছে। পলির দেবর সুদর্শন যুবক রবিন মাঝে মাঝে ঢাকায় বেড়াতে আসে। থাকে পলিদের বাসায়। এক বাসায় থাকলেও রিমির সঙ্গে রবিনের খুব একটা কথাবার্তা হয় না। রবিনের আলাপ জমানোর আগ্রহ থাকলেও বুঝতে পারেনা রিমির দিক থেকে কোন উৎসাহ আছে কিনা। রিমির নিরব পর্যবেক্ষণে বিষয়টি ধরা পড়লেও সে চুপচাপ থাকে। একদিন রিমি বারান্দা দাঁড়িয়ে প্রকৃতি অবলোকন করছিল। রবিন এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। দুজনে কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকার অস্বাচ্ছন্দ্য দূর করতে রিমি ভাবছিল কী বলা যায়। তখনই রবিন বলে ওঠে, রিমি আমি এই বাসায় আসি কেন জানো? রিমি আশ্চর্য না হয়ে বলে, আসেন বেড়াতে। আত্মীয় তো আত্মীয়ের বাসায় আসবেই। না, আমি আসি শুধু তোমার জন্য। তোমার মুখখানা একবার দেখার জন্য। যেদিন আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিনই তোমার প্রেমে পড়েছি। তোমাকে না দেখে থাকতে পারিনা। রবিন একটানা কথাগুলো বলে যায়। রিমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কী অবাক হচ্ছ তুমি? অবাক হবারই কথা। এগুলো শুধু আবেগ নয় মনেরও কথা। প্রকাশ না করে থাকতে পারছিলাম না। ভনিতা না করে কথাগুলো বলতে পেরে হালকা হয় রবিন। রিমির চোখে মুখে দ্বিধা দ্বন্দ্ব। ভালোলাগার সরাসরি এমন প্রস্তাবে যুবতী হৃদয় উদ্বেলিত হয়। হৃদয়ের জলোচ্ছ্বাস দমন করে কথাটি বলে, আমি দেখতে কালো আপনার কি আমাকে পছন্দ হবে? পছন্দ হবে কী, হয়েই তো আছে! রবিনের অন্তরদৃষ্টিতে তখন শ্যামলা বর্ণের মাঝে রূপের বর্ণচ্ছটায় বাঙালি নারীর চিরায়ত সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। যুগ যুগ ধরে যা বিমোহিত করেছে শাশ্বত রূপের মায়া। নারীও খুঁজে ফেরে বিনোদিত যে তার অন্তর্নিহিত সেই রূপের মোহে। রিমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তার অভিমত ব্যক্ত করে। তাহলে এই প্রেম টেম করে রাস্তায় ঘুরবো না, সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিবেন। হ্যাঁ, তুমি যদি চাও আমি তাই করবো। আজ দেখি তো কাল দেখি, একদিন ফ্যামিলি জানবে সেটা নিয়ে বকাবাজ্য করবে তা হবে না। বললাম তো তুমি যা বললে তাই হবে। তুমি বলছো তোমার ফ্যামিলিতে প্রস্তাব দিতে আমি তাই দেবো। রবিন বিয়ের প্রস্তাব দেয় পারিবারিক ভাবে।
প্রথমেই পলি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে কিছুতেই এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনা। এক ফ্যামিলিতে দুই বোন, এটা একটা উদ্ভট ব্যাপার মেনে নেয়া যায় না। রবিন ভাবীকে বুঝায়। আমি রিমিকে ভালোবাসি। রবিন তুমি বুঝার চেষ্টা করো যেখানে আমি আছি সেখানে আমার বোনও আসবে সেটা হয় না। কেন হয় না? রবিন তুমি বুঝতেছ না। ভাবী এমন ঘটনা আগে
কোথায়ও ঘটেনি তা নয়। অনেক পরিবারে এমন ঘটনা ঘটেছে এবং তারা সুখেই আছে। আমরা ইচ্ছা করলে দুইজনে পালিয়ে বিয়ে করতে পারতাম কিন্তু আমরা সেটা করতে চাই না।
পলি রবিনকে বুঝাতে না পেরে রিমির কাছে যায়। রিমিকে বলে, শোন আমি কিছুতেই রবিনকে বুঝাতে পারছি না। ও আমার কথা শুনছে না। তুই এই বিয়েতে রাজি হোস না।
কেন আপা? আমি চাইনা এক ফ্যামিলিতে দুই বোনের বিয়ে হোক।
তোমার সংসার তুমি করবা আমার সংসার আমি। তাতে সমস্যা কোথায়? মানুষ কি বলবে? মানুষে তো কত কথার দোষ ধরে, তার জন্য জীবন কি থেমে থাকবে। তুমি মানুষের কথা ভেবে তোমার বোনের সুখ
দেখবা না? বোন বোনের জা হবে এটা আমি মানতে নারাজ। তুই কি আর মরনের জায়গা পেলি না। এক সংসারে দু’জনকে মরতে হবে। ঠিক আছে আপা তুমি যদি না চাও করবো না এই বিয়ে। কিন্তু তুমি তোমার দেবরকে ঠিক রাইখো। পলি দেখে রিমি আর রবিন তার কথা শুনলেও তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। উদাস হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না, চুপচাপ বসে থাকে। পরিবর্তন গুলো পলির চোখে পড়ে। প্রাণবন্ত রবিন চুপচাপ। বিষন্নতার ছায়া তার সুদর্শন চেহারার
উজ্জ্বলতা মলিন হয়েছে। রিমির কালো রূপের তীক্ষ্ণ জ্যোতি হয়েছে ম্লান। বাস্তবের লাইলি মজনুর এমন মনবেদনা পলিকে বিচলিত করে। সে ঠিক করে এদের আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। রিমি আর রবিনের বিয়েতে মত দেয়। রিমি ও রবিন খুশি হয় বোনের প্রতি। অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যাওয়ায় রিমি রবিন নিজেদের কথায় মেতে ওঠে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে। রিমি বলে, বিয়ে হলেও পড়ালেখা শেষ না করে আমরা বাচ্চা নেব না কিন্তু। তাদের বিয়ে হয়। অনেক পরিকল্পনায় ভালোবাসায় কাটতে
থাকে সময়। বিবাহিত দম্পতিদের সন্তান কামনা স্বাভাবিক পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত প্রত্যাশা। কয়েক বছর হলো কিন্তু পলির বাচ্চা হয় না। এটা নিয়ে পলির অতিশয় দুশ্চিন্তা। অনেক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় কিন্তু কেউ নিশ্চিত কিছু বলতে পারে না। বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চূড়ান্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। শারীরিক ত্রুটির কারণে পলি কখনও মা হতে পারবেনা। পলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। কান্নাকাটিতে বুক ভাসায়। বন্ধ্যা নারীর কপালে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের আঘাত একদিন আসতে পারে। সেই শঙ্কাটি ফুটে ওঠে তার মানস পটে। পলির স্বামী নাসির বিষয়টি সুস্থির চিত্তে গ্রহণ করে। কান্নাকাটি করোনা, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। এটা নিয়ে তুমি উতলা হইয়ো না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
রিমি বোনের অবস্থা দেখে ভেঙে পড়ে। বোনের জন্য চরম আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক করে সে বাচ্চা নেবে সেই বাচ্চা বোনকে দিয়ে দিবে। বোনের মুখে হাসি ফুটাবে। রিমি গর্ভধারণ করে। রিমি খুশি হয় আল্লাহ তার দিকে তাকিয়েছে। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। রিমির বাচ্চা গর্ভে থাকা অবস্থায় রবিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসকরা দেন ভীষণ এক দুঃসংবাদ। জানতে পারে রবিন মরণব্যাধি ক্যান্সার আক্রান্ত। আর বেশি সময় অবশিষ্ট নাই। যে কোন সময় পৃথিবী ত্যাগ করতে পারে। আলোর মাঝেও তাদের সংসারে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। বাচ্চা পৃথিবীতে আসার আগেই মরণব্যাধি ক্যান্সারে রবিনের মৃত্যু হয়। শোকের ছায়া নেমে আসে সংসারে। পলি বোনকে বুঝায়, যা হবার তা হয়ে গেছে। নিয়তির উপর কারো হাত নেই। এখন তুই ভেঙ্গে পড়লে এই বাচ্চার কি হবে? আমার বাচ্চা, পৃথিবীতে আসার আগেই ওর বাবা চলে গেল। বাবা ছাড়া পৃথিবীতে ও চলবে কিভাবে! তুই ভেঙ্গে পরিস না। আল্লাহ আছেন যা করার সব ব্যবস্থা তিনিই করবেন। রিমির মেয়ে হয়। পলি খুব উৎফুল্ল হয় বাচ্চা দেখে। বাচ্চার নাম রাখা হয় ঋতু। ঋতুর সবকিছু পলিই করে।
বাচ্চার মা বাচ্চার কোন কিছু করার সুযোগ পায় না। সবকিছু আগে থেকে করে রাখে পলি। রিমি পলিকে বলে আমি বাচ্চার মা প্রসাব পায়খানা যায় করুক সেটা তো আমি পরিস্কার করব। বাচ্চাকে নাওয়াব খাওয়াব। এগুলো করতে আমারও সাধ জাগে। আমি তোমার জন্য করতে পারিনা। দেখ রিমি তোর তো একটা সান্ত্বনা আছে তুই বাচ্চার মা হতে পারবি। কিন্তু আমি তো সন্তানের মা হতে পারব না। তুমি যা বলো হিসাব করে বলো? আমি চাইলেই সন্তানের মা হতে পারবো আমার কি স্বামী বেঁচে আছে? বাচ্চা নিয়ে দুই বোনের মধ্যে প্রায় তর্ক হয়। কেউ বাচ্চাকে ছাড়তে চায় না। ঋতুকে দু’জনেই আপন করে পেতে চায়। পলি একদিন আঁচল পেতে ভিক্ষা চায়, তুই ঋতুকে ভিক্ষা দে আমাকে। আমার সন্তান নাই আমি ঋতুকে নিয়ে থাকতে চাই। রিমি বলে, আমার স্বামী নেই আমি ঋতুকে বুকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। রিমি নিজের বাচ্চাকে কখনোই কোলে নিতে পারে না। কখনো কাছে নিয়ে একটু আদর করতে পারেনা। সে মনকে বুঝায়। আমার বোনের তো সন্তান হবে না ও ওকে নিয়েই থাক। রিমি ঢাকায় চলে আসে বাবা-মার কাছে। বাবা-মা তাকে বিয়ে
দেয়। বিবাহিত সংসারে বিধবা নারীর গঞ্জনা আর সুখ নিয়ে কাটতে থাকে তার জীবন।