Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
মার্জনা-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

মার্জনা-সুলেখা আক্তার শান্তা

বৃদ্ধা সাজেদা চোখে দেখে না। অল্প বয়সে চোখে ছানি পড়ায় তার এই অন্ধত্ব। চোখের অপারেশন করাবে করাবে করে আর করা হয় নাই। একমাত্র ছেলে ফাহিমের ভবিষ্যৎ ঠিক করতে মরিয়া ছিল সাজেদা। সামর্থ্য সক্ষমতার সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছে ছেলের জন্য। জীবন থেকে সময় অলক্ষে কখন খসে পড়েছে টের পায়নি। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। বাপ মা নিতে চাইলেও যায়নি সেখানে। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর প্রচলিত রীতির কথা ভেবে ছেলেকে নিয়ে স্বামীর ভিটায় কাটিয়ে দিয়েছে জীবন। সাজেদা অন্ধ হলেও মনের জোরে অনেক কিছু বুঝতে পারে। গাছের একটা পাতা পড়ার শব্দেও ইন্দ্রিয় সজাগ হয়, সে অনুমান করতে পারে। অন্ধ সাজেদা সবসময় তার ঘরের বারান্দায় বসে থাকে।
ফাহিম থাকে বিদেশে। ফাহিমের ছোট্ট ছেলে নাহিদ সব সময় দাদির কাছে থাকতে চায়। দাদির সঙ্গ খুব ভালোবাসে। তার মা চায় না নাহিদ দাদির কাছে বেশি থাক। দাদির কাছে গেলেই রেবেকা ছেলেকে জোর করে টেনে নিয়ে যায়। রেবেকার আচরণ বলে দেয় সময়ের পরিবর্তনে বউ শাশুড়ি রেষারেষির চিরাচরিত রূপে পরিবর্তন ঘটেনি। অন্ধ বৃদ্ধার পক্ষে একা একা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা কতটুকু সম্ভব সে বিবেচনা কে করে।
রেবেকা ছেলেকে ধমক দিয়ে বলে, উনার এখানে বিশ্রী গন্ধ এখানে থাকতে চাও তুমি। সে শাশুড়ি সাজেদাকে উনি, এই যে ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে থাকে। উনার কাছে মানুষ থাকতে পারে, গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে যায়। বুড়ির যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ, কবে যে মরণ হবে তারপর একটু শান্তি পাবো। সাজেদার অন্তরে সাল হয়ে বিঁধলেও মুখ নির্বিকার। অন্ধ দু’চোখ বেয়ে হয়তো দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য সাজেদার পরানটা ছিড়ে যায়। বৌমা, বৌমা বলে, ডাকতে থাকে। অনেকবার ডাকার পর কখনো রেবেকা সাড়া দেয়। কী বলবেন বলেন? ফাহিমের সাথে যদি একটু কথা বলাইতা তাহলে মনডা শান্তি পাইত। রেবেকা ছ্যাৎ করে ওঠে, আপনার ছেলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। তাকে কাজ করতে হয়, সারাদিন ফোনে কথা বললে তো চলবে না। ফাহিম ফোন করে। মায়ের খোঁজ খবর নেয় মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়। রেবেকা কায়দা করে বলে, ছেলে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায় মা বলে না। তোমার মা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। বলে, আমি আর কী বলবো। বলে দাও ভালোই আছি। এ কেমন মা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। এরকম মা আমি কোনদিন দেখি নাই। ফাহিম চুপ করে যায়। মন খারাপ করে বলে, মা যখন কথা বলতে চায় আমাকে দিও। রেবেকা স্বামীর মনটা আরো বিষিয়ে তোলে। বাদ দাও তো, উনি কথা বলতে না চাইলে তুমি কথা বলতে চাবা কেন? তোমার মায়ের মতো এমন মা দেখি নাই কোনখানে। খুব তো সুনাইতা মায়ের গুনগান, তোমার মা এইটা তোমার মা ওইটা। এখন তো তার কোন প্রমাণ পাইনা। রাখি এখন অনেক কাজ আছে। সারাদিন যায় তোমার মায়ের সেবা করতেই। ফাহিম পরিবেশ হালকা করতে চায়, সেবা করো তুমি তোমার ছেলের বউ থেকে তেমনই পাবা। সে কথা চিন্তা করেই তো তোমার মায়ের সেবা যত্ন করি!
কে যায়?
কি চাচি তোমার আবার কী হইল?
কে ফয়সাল?
তুমি চোখে দেখো না কিন্তু গলার আওয়াজে ঠিকই সব বুঝতে পারো।
বাবা কাছে আয় তো। দেখ বাবা, আমার এই পয়সা গুলায় কত হইছে। এইগুলা আজ কাল ধইরা জমায় নেই বহু দিনের জামা। গুইনা দেখ তো বাবা কত হইছে। ফয়সাল বলে, চাচি এই তোমার পয়সা? কে বলছে এইগুলা পয়সা? সাজেদা আশ্চর্য হয়ে বলে, কেন বাবা কী হইছে? এগুলো সব লোহার ছোট ছোট চাকতি। এই দিয়া পোলাপানে পয়সা পয়সা খেলায়।
রাবেয়া এগিয়ে আসে, কী হইছে?
রাবেয়ার তেড়ে আসা দেখে ফয়সাল পাশে সরে দাঁড়ায়। টাকা বাহিরের মানুষের গুনতে দেওয়া হয়, ঘরের মানুষরে বিশ্বাস করা হয় না। কেন আমারে গুনতে দেওয়া যায় না? সাজেদা কাচুমাচু হয়ে বলে, বৌমা ভাবলাম তোমার কাজকাম আছে। ফয়সাল যাচ্ছিল তাই ওরে ডাইকা পয়সা গুলো গুনতে বললাম। অনেক টাকা আছে আপনার, গুনে শেষ করার মতো সময় নাই। বৌমা বহুদিন ধরে জমাই তো তাই অনেক টাকা জমা হইছে। বউ কিছু টাকা নিয়া তুমি বাজার করাইও। ভালো-মন্দ খাওন যাইবো। কী খাইবেন বলেন? মুরগি খাইতে ইচ্ছা করে। আরেকটু কবুতরের ঝোল। আপনার ইচ্ছা তো কম না মুরগি কবুতর। দেখি আপনার ছেলে টাকা পাঠাইলে কিনন্যা খাওয়ামু। বউ আমার এইখানে যে টাকা জমাইছি এইগুলো নিয়ে বাজার করাও। না থাক আপনি এত কষ্ট কইরা জমাইছেন সেইগুলা কি খরচ করা যায়! ঠিক আছে বৌমা আমি এই টাকা দিয়া আমার চোখের চিকিৎসা করামু। ফাহিম টাকা পাঠাইলে তুমি বাজার সদাই কইরো। বেশ কদিন পর সাজেদা জিজ্ঞেস করে, বৌমা ফাহিম টাকা পাঠায় নাই? রাবেয়া তিরিক্ষি মেজাজে বলে ওঠে, আরে কী জ্বালায় পড়ছি। আপনার ছেলে টাকা পাঠায় মাস শেষে। মাস তো এখনো শেষ হয় নাই। এক মাসে সে কি দুইবার বেতন পায় যে দুইবার টাকা পাঠাইবো। মুরগির সালুন দিয়ে ভাত খাইতে বেতনের কথা জিগাইয়া আমারে অস্থির করতেছে। বৌ আমারে খাওয়ার খোটা দিও না বড় লজ্জা লাগে মা। আমি আর কিছু খাইতে চামু না। গলা কেঁপে উঠে সাজেদার।
ফয়সাল নীরবে শুনছিল এতক্ষণ। এসব এসব কথা শুনে তার খুব খারাপ লাগে। যে চাচিকে সবাই এত সমীহ করে তার এত অসম্মান। একজন বুড়ো মানুষ কিইবা খায়, সেটুকু নিয়ে এত গঞ্জনা সহ্য করা যায় না। আর একজন বিদেশ যাইয়া পইরা আছে দেশের কোন খবর নাই। নিজের একটা মা আছে তার তো কোনো খোঁজখবর নিতে হয়। ফয়সাল বাজারে যায়। মুরগি কবুতর এনে রাবেয়াকে দেয়, ভাবি রান্না করো। তোমার হাতের রান্না খাবো তাই নিয়ে এলাম। রাবেয়া রান্না শুরু করায় ফয়সাল খুশি হয়। যাক চাচি তো পরানটা ভইরা খাইতে পারবো।
একগুঁয়ে স্বভাবের রাবেয়ার মনে চালাকি। নীতিবোধ বর্জিত হলেও সে তার জেদ পূরণ করবে। বর্ষার দিন। রান্নাঘরে একটা সোনাব্যাঙ লাফিয়ে পার হবার সময় পাতিলের ঢাকনা দিয়ে সেটা আটকে রেখেছিল। সেটাই ভুনা করে শাশুড়িকে খেতে দেয়। কন্ঠ নরম করে বলে, আম্মা আপনার কবুতরের মাংস খান। আপনার জন্য আস্তা কবুতর ভুনা করছি। আশ্চর্য হয় সাজেদা, বৌমা তুমি আমারে আম্মা ডাকলা? তোমার ডাকে পরানটা জুরাইয়া গেল। সে খেতে চায় না। ভাবে আগের কোন কথায় বউ মনঃক্ষুণ্য হয়ে থাকতে পারে। বউকে তুষ্ট করতে চায়। আসো আমরা সবাই একসঙ্গে খাই। রাবেয়া বলে, আপনি মুরুব্বি মানুষ আপনি আগে খান। রাবেয়ার জোরাজুরিতে সাজেদা একাই খেতে রাজি হয়। এর মধ্যে ঘটে আরেক ঘটনা। ফাহিম মাকে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকে। চমকে দেবে বলে, দেশে আসার কথা সে কাউকে জানাইনি। মা খাবার মুখে দিবে ওই মুহূর্তে মাকে জড়িয়ে ধরে ফাহিম। মা রুদ্ধস্বরে বলে, এত বছর পর তুই আসলি। ফাহিম বলে, তুমি আমার সাথে কথা বল নাই কেন মা। রাগ করছো?
বাবা আমি তো তোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। তুইতো আমার সাথে কথা বলতে চাস নাই। মা আমি কি তোমার সঙ্গে কথা বলার কথায় না বলতে পারি।
মা কী দিয়ে ভাত খাওয়া? বাবা বউ আস্তা কবুতর দিছে, কবুতর খাইতেছি। ফাহিম উচ্চস্বরে বলে, কবুতর! এটা কবুতর! এটা তো ব্যাঙ মা! কী জানি বাবা আমি তো চোখে দেখি না। বৌমা দিয়ে গেল কবুতর বইলা। ফাহিম রাবেয়ার দিকে তাকায়। মাকে কী দিয়া খাইতে দিছো? আমার মা ব্যাঙ খাইতেছে? রাবেয়া দেখে ধরা পড়ে গেছে পরিত্রাণের কোন উপায় নাই। শেষ উপায় হিসেবে বলে, আমি কী দিছি নাকি উনি তো চাইলেন। সাজেদা বলেন, বৌমা আমি তোমার কাছে ব্যাঙ খেতে চাইছি? এইটা তুমি কী বলো?
সারা শব্দ পেয়ে ফয়সাল এসে দেখছিল রাবেয়ার কাণ্ডকারখানা। শেষে না বলে পারলো না, ভাবি মানুষের মানসিকতা ছোট হয় কিন্তু এতটা ছোট হয় তা জানতাম না। এই বুড়া মানুষটার উপর তোমার এত জেদ কেন? যেখানে চাচি তোমার কাছে কবুতর খাইতে চাইলো তুমি দিলে না। আমি বাজার করে আনলাম তাও তুমি এই কাজটা করলা? তার জমানো টাকা পয়সা নিয়া সেইখানে রাইখা দিলা ছোট ছোট লোহার চাকতি। ফাহিম কিছুটা অনুমান করলেও এতটা করেনি। আক্রোশের পরিমাণ দেখে সে বিস্মিত হয়।
ফাহিমের পা জড়িয়ে ধরে রাবেয়া বলে, আমি ভুল করছি আমাকে মাফ করে দাও। তুমি যে ভুল করছো তার কোন ক্ষমা নাই। তোমার মতো খ্যাপাটে মানুষ নিয়ে সংসার করা অসম্ভব। তুমি চলে যাও বাপের বাড়ি। সাজেদা দেখে তাকে উপলক্ষ্য করে পরিস্থিতি সর্বনাশের দিকে এগোচ্ছে। আরো উত্তপ্ত হওয়ার আগে সাজেদা ছেলের কাছে মিনতি করে, বাবা আমার নাতি তার মুখের দিকে তাকাইয়া বউ মারে মাফ করে দে। একটা সংসার ভাঙ্গা মসজিদ ভাঙার সমান। তুই ঘুনাক্ষরেও আর এই কথা কবি না। মায়ের কথায় শান্ত হয়ে আসে ফাহিম। দেখো যারে এত কষ্ট দিছো আজ সে তোমার সংসার বাঁচায়। ভালো শিক্ষা ভালো মানুষের কাছ থেকে নেও। মানুষ তো সবাই সবার মধ্যে মানুষের গুণ থাকে না।