Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
অপূর্ণ বন্ধন–সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

অপূর্ণ বন্ধন–সুলেখা আক্তার শান্তা

অপূর্ণ বন্ধন-সুলেখা আক্তার শান্তা
মমতার মন অনাবিল মাতৃস্নেহে ভরপুর। ভাই বোনের জন্য মায়া মমতার ফল্গুধারা তাঁর হৃদয়ে সর্বদা বহমান। যেভাবেই হোক ভাই বোনের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারলেই মনে শান্তি পায় মমতা। পিতা মাতার আকস্মিক মৃত্যু তার মনে দায়িত্ববোধের চেতনা আরো তীব্রতর করে। মা-বাবার ভূমিকাটি তাকেই পালন করতে হয়।
একটি হাসপাতালে নার্স হিসাবে কর্মরত মমতা। ঘরে বাইরে দুই জায়গাতেই সামাল দিতে হয় তাঁকে। অফিসে যাওয়ার আগে ভাই বোনের প্রয়োজনীয় সবকিছু করে রেখে যায়। যাতে ভাই বোনের কোন কিছু আর করতে না হয়। ভাই বোনের কোন কাজ করলে মমতার হৃদয় ব্যথিত হয়।
সংসারে কোন কাজের লোক রাখে না সে। যে টাকাটা কাজের লোকের পিছনে খরচ করবে, সেটা ভাই বোনের জন্য খরচ হলে তারা উপকৃত হবে। নিজের যত কষ্টই হোক তা হাসিমুখে বরণ করে নেয়। মমতারা দুই বোন দুই ভাই। ভাই-বোনের মধ্যে মমতাই বড়। ভাই ইমরান বোন মমতাকে বলে, পড়ালেখা শেষ করলাম এখন বসে না থেকে কিছু একটা করতে চাই। আমার এক বন্ধুর কাছে ভিসা আছে, আমি ওর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কথা বললেই তো আর হবেনা প্রয়োজন টাকা-পয়সা।
মমতা বলেন, তুই তো জানিস, আমার কাছে জমা কোন টাকা পয়সা নাই। যা বেতন পাই, তা সংসার খরচ আর তোদের পড়ালেখার পিছনে খরচ হয়ে যায়। আর তোদের নিয়ে এইতো আছি। যদি পারিস দেশেই একটা কিছু করার চেষ্টা কর।
ইমরান উদ্ধত স্বভাবের। বলে, আমার কথার কোন দাম নাই। ভাই যাবে বিদেশ আর বোন হয়ে তুমি দেখো তোমার স্বার্থ। স্বার্থপরের মতো নিজের স্বার্থ না দেখে ভাইয়ের কথা চিন্তা করো।
মমতা ভাইয়ের মুখে এ কথা শুনে ভাবে, ভাই অবুঝ তাই এমন কথা বলে। মমতা ভাইয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে অফিস থেকে লোন নেয়। অফিসে মমতার ভালো আচরণের কারণে কলিগদের মধ্যে কেউ টাকা ধার দিয়ে সহযোগিতা করে। মমতা ভাই ইমরানকে বিদেশ পাঠায়। আশা নিয়ে থাকে ভাই টাকা পাঠাবে। ঋণের টাকা পরিশোধ করবে। মমতার আশার বিপরীত ঘটনা ঘটে। ইমরান বিদেশ গিয়ে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা বোনের সঙ্গে যোগাযোগও করে না। ভাইটা বোধ হয় অসুবিধা আছে, মমতা নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়। ভাই আকরাম তারও বায়না, তাকে বিদেশ পাঠাতে হবে। তার পড়ালেখা করতে ভালো লাগেনা। আকরাম কথায় মমতা বলেন, ইমরানের বিদেশ পাঠানোর ঋণের টাকা কাউকে পরিশোধ করতে পারিনি। এখন আবার তুই বিদেশ যেতে চাইছিস আমি টাকা পাবো কোথায়!
ওই ভাইয়ের জন্য টাকা ম্যানেজ করতে পেরছ আর এখন আমার জন্য পারবা না। বোন হয়ে তোমার কোন বিবেক বিচার নাই। দুই ভাইকে দুই চোখে দেখো। মমতা চিন্তিত হয়ে বলে। আমি যা করি সব তো তোদের জন্য করি। তোরা ছাড়া কে আছে আমার বল!
হয়েছে, হয়েছে আর বলতে হবে না। ভাইয়ের জন্য কিছু করতে পারোনা এদিকে ভাই ভাই বলে প্রাণপাত করো। এমন শুকনো মুখে ভাই ভাই বলার দরকার নাই। তুমি আমাকে বিদেশ পাঠাবা কিনা বলো? আর না হয় যেদিকে দুচোখ যেতে চায় সেদিকে চলে যাব। ভাইয়ের এমন কোথায় মমতা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ইমরানের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই আবার আকরামকে বিদেশে পাঠানোর ঋণের বোঝাও মাথায় নিতে হয়। সে আরো ঋণ করে আকরামকে বিদেশ পাঠায়। মমতা দুঃসাধ্য ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মানসিক চিন্তায় উৎপীড়িত হতে থাকে। বোন ঈশানা ছোটবেলা থেকে নিজেকে নিয়ে মশগুল। নানা বিষয়ে তার দাবি যখন তখন। টাকা থাক বা না থাক তার দাবি পূরণ করতেই হবে। মমতার অনেক সময় কষ্ট হলেও সেভাবে, বোন তো বোনের কাছে দাবি করবে। ওরা ছাড়া আর কে আছে আমার।
সহনশীল আচরণের কারণে মমতাকে সবাই ভালবাসে। অফিসের বস আসিফ তাকে পছন্দ করে। সে মমতাকে বিয়ে করতে চায়। একদিন বিয়ের প্রস্তাব দেয় মমতাকে।
মমতা ভাবে ভাই বোনের দায়িত্ব তার পালন করতে হবে। তাছাড়া আছে অনেক ঋণ। ভাইয়েরা দেশে আসলে তাদের বিয়ে-শাদী করাতে হবে। ছোট বোন আছে তার বিয়ে দিতে হবে। এদের নিয়েই মমতার স্বপ্ন। সুন্দরভাবে এদের গুছিয়ে দিতে পারলেই হলো। তার জীবনে আর অন্য চাওয়া পাওয়া নাই।
ভাই বোনের দায়িত্ব পালন করতেই সে বস আসিফের বিয়ের প্রস্তাব না বলে দেন।
আসিফ বলেন, তোমার ভাই বোনের দায়িত্ব আমিও তোমার সঙ্গে পালন করতে চাই। দুজন ভাগাভাগি করে করব সে কাজ।
ভাই বোনের বোঝা একান্তই আমার। আমার কাজ আমি করতে চাই। সেখানে অন্য কাউকে ভাগীদার করতে চাইনা।
মমতা তোমার কাজের ভাগীদার করে আমাকেও সার্থক হতে দাও। এমন মমতাময়ী মানুষের মমতা থেকে দূরে রেখোনা আমাকে। তুমি জানো আমি তোমার কিসের প্রেমে পড়েছি। মমতার মু0খটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রোমাঞ্চিত হয়। হাসি দিয়ে বলে, কিসের প্রেমে?
তোমার সততা, নিষ্ঠা, তোমার গুণ, তোমার ধৈর্য, তোমারে সংগ্রামী এই জীবন, যা আমাকে আকৃষ্ট করে। মমতা রাখবে আমাকে সারা জীবন তোমার পাশে।
হ্যাঁ রাখবো। সারা জীবন পাশে রাখব।
হারাতে দেবে না তো?
ধরে রাখবো, হারাবে কেন!
জানো, আমি যদি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ থাকি তাহলে কেউ পারবে না তোমার কাছ থেকে আমাকে আলাদা করতে। তুমি আমার হৃদয়ে নিরবে জায়গা করে নিয়েছো। তোমাকে না পেলে মনে হয় জীবন আমার অর্থহীন হয়ে যাবে।
হয়েছে জনাব। এত ইমোশনাল ভাব দেখাতে হবে না। যে মানুষটি আমার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাতে কি আমি হারিয়ে যেতে দিতে পারি। আমিও চাই তাকে পাশে রাখতে। প্রতিজ্ঞা করে বিশ্বসংসারের দুর্গম পথ তারা একসঙ্গে পাড়ি দেবে।
আসিফ আর মমতা বিয়ে করেন। সংসার জীবনে তারা খুব সুখী। সুখী দম্পতির ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। মমতার ছোটবোন ঈশানা সবার সঙ্গে আচরণে সবকিছু ঠিক থাকলেও মমতার সঙ্গে ব্যতিক্রম। ঈশানা বোনের উপর অধিকার খাটাতে গিয়ে অনেক সময় পাগলামি করে বসে। সীমা পরিসীমা থাকেনা সেইসব কাণ্ডকারখানার। মমতাকে সবসময় মানসিক অত্যাচারের মধ্যে রাখে। ঈশানার বায়নার শেষ নাই। এটা খাবে না ওটা খাবে না। কিংবা তার পছন্দের কিছু তৈরি করে দিতে বলবে, পরে বলবে, না আমি তা বলিনি। তার বিপরীত আরেকটা বলবে। ঈশানার খামখেয়ালি স্বভাব নিরবে মেনে নিতে হয় মমতাকে। মমতা স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকলেও ভাই বোন দিয়ে সুখের মুখ দেখেনা। দীর্ঘদিন যাবৎ দুভাই ইমরান আর আকরামের দেখা-সাক্ষাৎ পায়না। ভাইদের জন্য তার হৃদয় কাঁদে। ভাইদের জন্য মমতা অন্তর ক্ষত হয়ে যায়। ঈশানা বোন মমতাকে বলে, ভাইদের টাকা পয়সা দিয়ে বিদেশ পাঠাইছো তারা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে না। তোমার স্বভাব ভালো না বলেই তোমার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করে না।
হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। ভালোনা বলেই মনে হয় এমনটা করে। জানিনা কি করলে তোদের কাছে ভালো হতে পারব।
আসিফের কর্মস্থলে বিদেশে ছয় মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য একটা প্রস্তাব আসে। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলে স্ত্রী সন্তান রেখে বিদেশ যায় সে। ছয় মাস পার হয়ে বছর পার হলেও আসিফ দেশে ফিরে আসেন না। মমতার ঋণ পরিশোধের সংকট গভীরতর হতে থাকে। দু’ভাইয়ের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারলে এই বোঝাতে থেকে বাঁচতাম। ইমরান আর আকরাম সঙ্গে ঈশানার কথা হয়। তাকে মাসে মাসে কিছু টাকাও দেয়। ঈশানা সেই টাকা বোন মমতাকে দেয় না এমনকি তাকে জানাতেও দেয় না যে ভাইয়েরা তাকে টাকা দিয়েছে। ভাইদের টাকার গরিমা দেখায় বড় বোন মমতাকে। বোন মমতার সঙ্গে যোগাযোগ করে না অথচ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভাইরা তাকে টাকা দেয়। সে অনেক ভালো তাই ভাইরা তার খোঁজ খবর রাখে।
মমতার জীবনে একটি আশার আলো ছিল হঠাৎ সেটিও নিভে যায়। জানতে পারে তার স্বামী বিদেশে সেটেল হওয়ার জন্য এক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছে। দুঃখ ক্ষোভ অভিমানে রুদ্ধ হয়ে আসে তার কন্ঠ।
মমতা বলেন, আমাকে সংসারের এ কেমন বন্ধনে আবদ্ধ করলে হে বিধাতা। যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সে সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলো না। আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবে বলে ওয়াদা করেছিল, সে ওয়াদা একটা স্বার্থের কাছে বিলীন হয়ে গেল। মমতা ঈশানাকে বলেন, ভাইয়েরা তো তোকে টাকা দেয় সেই টাকা তোর কাছে জমা থেকে। কিছু টাকা দিলে সংসার খরচে উপকার হয়। আমি চোখে-মুখে কোন পথ না দেখে তোর কাছে টাকাটা চাইলাম।
ঈশানা ঝামটা মেরে বলে, আমি কেন এই টাকা দিব তোমাকে? এটা আমাকে দিয়েছে এটা আমার টাকা। সেখানে তুমি লোভ করো কেন? মমতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাই যেন ভাই-বোনের একমাত্র ব্রত! মমতার স্বামী বিদেশ থেকে আসে না সেই খোটাও দেয়। তোমার স্বভাবের কারণে স্বামী বিদেশ থেকে আসে না। মমতা বোনের কথায় কোনো প্রতি উত্তর করেনা।
ছোট বাচ্চা রেখে অফিসে যায়। অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে বাচ্চা না খেয়ে আছে। কারো প্রতি দোষারোপ না করে সে ভাবে, তার চাকুরীর জন্য ছেলের প্রতি এমন অবহেলা হচ্ছে। ভাইদের ঋণের টাকা, স্বামী দূরে থাকা, বোনের দেওয়া মানসিক যন্ত্রণা। নানা বিষয় হাঁপিয়ে ওঠে মমতা। ঋণের টাকা পরিশোধের কোনো উপায়ান্তর দেখে না সে। মমতা চাকুরী থেকে অগ্রিম অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় যাতে একত্রে কিছু টাকা পাওয়া যায়। রিটায়ারমেন্টের টাকা, আর তার সঙ্গে ঘরের ফার্নিচার বিক্রির টাকা যুক্ত করে ঋণ পরিশোধ করে। মমতার চাকরি নাই হাতে টাকাও নাই। বড় বোন মমতার এমন দুর্দশা দেখে, বোন ঈশানা বলে, সে আলাদা খাবে। মমতা বলেন, এক জায়গায় থেকে আলাদা খাবি একথাও আমার শুনতে হলো। এক বাসায় থেকে আলাদা রান্না করে খায় ঈশানা। বাচ্চাকে অভুক্ত রেখে চোখের সামনে ঈশানা খেয়ে উঠে যায়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর রাতুলের শীর্ণ মুখ দেখে বুক ফেটে যায় মমতার। বেদনা আপ্লুত মমতা ছেলে রাতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদে।
ভাই-বোনের নিষ্ঠুর কীর্তিতে হতভম্ব মমতা সিদ্ধান্ত নেয় অন্য কোথাও চলে যাবে। একটি বাসার বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসার চাকরি করে। আর সেই বাসায় মমতা থাকে। সেই বাসায় ছেলে রাতুলকে রাখা সুযোগ না থাকায় হোস্টেলে রেখে পড়ালেখা করায়। দুই ভাই দেশে এসে বিয়ে করে সে খবর মমতা জানতে পায়। প্রচন্ড দুঃখবোধ তার সমস্ত অস্তিত্বকে নাড়া দেয়। ভাবে, কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার যোগ্যতা তাঁর কোন কালে হলো না। মমতা ভাবে বুক দিয়ে আগলে রেখেও কেন সে কারো আপন হতে পারল না। আপনজন থাকলেও তাঁর আজ একা পথ চলতে হয়। একাকীত্ব পথ হয় তাঁর জীবন চলার সঙ্গী। মমতার মত অনুভূতিপ্রবণ কিছু মানুষের বিষাদময় জীবন গাঁথা সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যায়।