Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
সুলেখা আক্তার শান্তা’র-মায়ের মুখ – Pratidin Sangbad

সুলেখা আক্তার শান্তা’র-মায়ের মুখ

পাপিয়া ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে সে সুন্দরী। সৌন্দর্যের সঙ্গে ভালো-মন্দ কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হয়। তার যোগ হয়েছে
দাম্ভিক এবং উন্নাসিক স্বভাব। সব সময় নিজেকে ফিটফাট রাখে। চাচতো ভাই বোন এবং বাড়ির সমবয়সী সবাই সবার
সঙ্গে মিলেমিশে একসঙ্গে খেলা করলেও পাপিয়া কারো সঙ্গে খেলে না। এমনকি সহজে কারো সঙ্গে কথাও বলে না। কেউ
কখনো তার গায়ে একটু স্পর্শ করে কথা বললে, বলে, এই আমাকে ধরিস না আমার গায়ে ময়লা লাগবে। নাজিয়া বলে,
কারো হাতে ময়লা নেই। আর কেউ কি হাতে ময়লা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় যে স্পর্শ করলেই তোর গায়ে ময়লা লাগবে? তোদের
হাতে সব সময় ময়লা থাকে, তোরা কখনো হাত ধুস না। নাজিয়া রেগে যায় সঙ্গে সঙ্গীরাও। সবাই একসঙ্গে বলে, আমরা
হাত ধুই না? সবাই মিলে পাপিয়ার হাতে, গায়ে ময়লা লাগিয়ে দেয়। পাপিয়ার চিৎকারে একাকার করে ফেলে। পাপিয়ার
মা সানজিদা বলেন, আমার মেয়ের একি অবস্থা। কি হয়েছে মা? সবাই ভয়ে দৌড়ে পালায়। পাপিয়া ফুপিয়ে কাঁদতে
কাঁদতে বলে, মা ওই ছোটলোক গুলো, আমার গায়ে ময়লা দিয়েছে। দেখো আমার কি অবস্থা করেছে। পাপিয়ার মাও বলতে
থাকেন, পোলাপানগুলির কান্ড দেখছো! তুমি আর ওদের সঙ্গে খেলবে না। আমি কি ওই ছোট লোকগুলোর সঙ্গে খেলি!
ওদের কাছে যাই? না তুমি যাওনা। আমি ওদের অনেক বকে দেব। বুঝতে পেরেছি, তুমি ওদের সঙ্গে খেলো নাই তাই ওরা
হিংসা করে তোমার সঙ্গে এমন করছে। পাপিয়া গোসল করতে গিয়ে বারবার গায়ে সাবান দেয়, তারপরও মনে হচ্ছে তার
গায়ে ময়লা আছে। গায়ের ময়লা সরে গেলেও পাপিয়ার মনের হয় ময়লা যায়নি। নিজেকে শুধু অপরিষ্কার মনে হয়।
সানজিদা মেয়ের মনের পরিস্থিতি বুঝে বিষয়টা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে।
পাপিয়া বিয়ের উপযুক্ত না হলেও পড়ালেখা চলাকালীন তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। বাবা মা এক সময় আর উপেক্ষা
করতে পারে না। ভালো ঘর এবং বর দেখে মেয়ের বিয়ে দেন। শ্বশুর বাড়ির লোকজন পাপিয়াকে অনেক আদর আগ্রহ
করে ঘরের বউ করে নেন। পাপিয়াকে স্বামীর পরিবারের লোকজন সবাই ভালোবাসে।
মেয়েরা নাকি গিন্নি হয়েই ভূমিষ্ঠ হয়। বিয়ের আগে যেমন তেমন বিয়ের পর অন্য মানুষ। পাপিয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা
তেমনই। আচার-আচরণে চলন বলনে সে পরিপক্ক। সকালে বেলা করে ঘুম থেকে উঠে, নাস্তা করে। নাস্তা শেষে টিভি
দেখতে বসে। সংসারের কোন কাজ করে না। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে কোন কাজ করতে দেয় না। ‌ পাপিয়া শুয়ে বসে
কাটালেও শ্বশুর বাড়ির সবকিছুতেই মাতবরি করে। এটা এমন হয়েছে কেন? এটা এখানে কেন? বউয়ের কার্যকলাপ দেখে
স্বামী জিতু বলে, তুমি তো কোন কাজ কাম করো না বরং মানুষকে এটা ওটা বলে, প্রেসারের মধ্যে রাখো। এটা আমার
সংসার, এখানে আমার প্রয়োজনের জায়গায় প্রয়োজনীয় কথা বলার রাইট আছে।
তুমি বলো, বলতে তো তোমাকে না করা হচ্ছে না। কোন কিছু অতিমাত্রায় করলে সেটা একটু বেশি হয়ে যায় না? ক্ষিপ্ত হয়
পাপিয়া, তুমি আমার স্বামী তুমি আমার দিকটা না দেখে অন্যের দিকটা দেখো! আমি তোমার বা অন্যের কোন কিছু
বুঝিনা, চোখে যা পরে তাই বলি। জিতুর ব্যবসা ঢাকায়, সেখানেই তাকে থাকতে হয়। পাপিয়া বায়না ধরে তাকে ঢাকায়
রাখতে হবে। জিতু বোঝাতে চেষ্টা করে, এখানে আমার পরিবারের সবাই থাকে তুমিও তাদের সঙ্গে থাকবা। আমি তো
আসা যাওয়ার মধ্যেই আছি। পাপিয়া বলে, আমার এককথা। আমি বলছি আমি ঢাকায় থাকবো, ঢাকাতেই থাকবো।
আবিদার কানে কথাটি গেলে ছেলেকে বলেন, বৌমা যখন ঢাকায় থাকতে চাচ্ছে তখন তাকে সেখানেই রাখো।‌ এইটা নিয়ে
আর কথা বাড়িও না। জিতু বলে, ঠিক আছে মা।
পাপিয়া কথা ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। মা বলছে বলে, তুমি আমাকে ঢাকায় রাখবা? আমি যখন বলছি সেই কথার গুরুত্ব
নেই!
জিতু বলে, এত কথা ধরো না। হ্যাঁ মায়ের কথার একটু গুরুত্ব থাকবে। পাপিয়া এ কথা শুনে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে
দেয়। তাকে কেউ খাওয়াতে পারে না। জিতু অনেক অনুনয় বিনয় করে বোঝাতে চেষ্টা করে। পাপিয়ার জেদ কিছুতেই
খাবার মুখে নেয় না। ঠিক আছে তুমি রাগ করোনা, এখন থেকে তোমার কথার মূল্য থাকবে সর্বাগ্রে। ভাত নিয়ে জিতু
পাপিয়াকে খাওয়াইয়া দেয়। পাপিয়া ভাত মুখে দিয়ে বলে, এখন থেকে তাহলে আমার কথার মূল্য থাকবে তো? হ্যাঁ তোমার

কথা মূল্য না থেকে পারে, তাহলে তো তুমি আবার এরকম খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিবা। বউয়েরা‌ যেমন স্বামীর কথা
শুনে তেমন স্বামীদেরও বউয়ের কথা শুনতে হয়।
তুমি কি আমার কথা শোনো? নাকি আমারই তোমার কথা শুধু পালন করে যাই।
শুধু আমার কথা পালন করে যেতে হবে।
আমিও পারি তোমাকে কথা পালন করানোর জন্য। তবে আমি তেমনটা করব না।
জিতু আর পাপিয়া ঢাকায় সংসার শুরু করে। একটা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব বড় হতে থাকে। পাপিয়া থাকায় জিতুর নিয়মিত
বাড়ি যাওয়া হয় না। ফোনেই যোগাযোগ সারতে হয়। পাপিয়ার ভালো লাগে না বিষয়টি। একদিন সে বলেই বসে,
সারাদিন পর বাসায় এসেই ফোনে কথা বলা শুরু করো। আমার আর দরকার কি? এই নিয়ে স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে বাক-
বিতন্ডা হয়। পাপিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, বাড়ির সঙ্গে এত যোগাযোগ করা চলবে না। শান্তি প্রিয় জিতু বিষয়টি আর
প্রলম্বিত করতে চায় না। কিন্তু পাপিয়ার জেদ প্রশমিত হয় না। আবিদা ছেলে যখন অফিসে থাকে তখন ছেলের সঙ্গে কথা
বলেন। জিতু অফিস থেকে আসলে পাপিয়া জিতুর মোবাইল চেক করে দেখে বাড়ির সঙ্গে কথা বলছে কিনা। পাপিয়া
দেখতে পায় জিতু তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। পাপিয়া মোবাইল আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলে।‌ তুমি এইটা কি করলে
আমার মোবাইল ভেঙ্গে ফেললে? হ্যাঁ ভেঙ্গে ফেললাম! তুমি আমার অজান্তে তুমি তোমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলো কেন?
বাসায় তো তোমার জন্য কথা বলতে পারি না বাইরেও তোমার জন্য কথা বলতে পারব না। না, পারবা না! জিতু সংসার
ঠিক রাখার জন্য আর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে না। আর শুধু ভাবে বিয়ে তো করলাম নাকি গলায় ফাঁসির রশি পরলাম!
জিতু আর পাপিয়ার এক এক করে দুই সন্তানের বাবা মা এখন। পাপিয়া স্বামীকে বলে, অনেক বছর ধরে তো তোমার মা
ভাই বোন বাড়ির জমি খেত খাচ্ছে। সেখান থেকে তো আমাদের কিছু আনা হয় না। এভাবে এজমাইলি পড়ে থাকলে পরে
কিছুর পাওয়া যাবে না। এখন তুমি বাড়ির বিষয় সম্পত্তির ভাগ চাও। জিতু ঘাড় ঘুরিয়ে, কেন এখানে কি আমার খারাপ
অবস্থা যে বাড়ির সম্পত্তির ভাগ নিতে হবে! এখানেরটা তো তুমি করছো। আর ওখানেরটা তো তোমার বাবার, তার ভাগ
তুমি ছাড়বো কেন?
ঠিক আছে তুমি না পারলে আমি বলছি। পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে জিতু বলে, তুমি একটা মানুষ বটে। আমি একটা কি
বটে? বললে তুমি সহ্য করতে পারবেনা। ‌তার চেয়ে না বলাই ভালো। পাপিয়া রাগ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে মায়ের
কাছে চলে যায়। ছেলে মেয়েকে দাদির কাছে যেতে দেয় না। বউয়ের বাপের বাড়ি কাছে হলেও যাওয়া আসা না থাকায়
আবিদা নাতি নাতনি দেখার জন্য খবর পাঠায়। পাপিয়া ছেলে মেয়েকে ছাড়াই নিজে যায় শাশুড়ির কাছে। বৌমা তুমি
এসেছ আমার নাতিরা কই? দেখছেন তো সঙ্গে আনি নাই তারপরও কেন জিজ্ঞেস করছেন? আমি যে জন্য এসেছি, এই যে
আপনারা সম্পত্তি খাচ্ছেন? আপনার ছেলে জিতুর কথা একবারও কি ভাবেন? আপনারা ভাববেন না আমি জানি তাই
আমার নিজেরই আসতে হলো। এখন আমার স্বামীরটা আমাকে বুঝিয়ে দেন। আবিদা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, তুমি দু'দিন ধরে
এসে স্বামীর সম্পত্তি ভাগ চাও? আর আমরা এত বছর সংসার করেও স্বামীর সম্পত্তির ভাগ চাইনি। আর বিষয় সম্পত্তি
কতটুক আছে তাও জানিনা। আপনি যেটা করেননি বা যেটা পারেননি সেটা আমি পারবো না বা করবো না তা কি করে
হয়? ঠিক আছে তুমি কথা বাড়িয়ো না। আমি তোমার ভাগের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
পাপিয়া ছেলে মেয়েকে এটা ওটা দামি জিনিস খাওয়ায়। তা দেখে বাড়ির এক ভাইয়ের ছেলে সুমন বলে, ফুপু তুমি এটা কি
খাওয়াচ্ছ? হাত পেতে বলে, আমাকে দেবে? তোমরা এটা খাবে কোথা থেকে? দেখবেই বা কেমন করে? যে জিনিস দেখো
নাই বা খাও নাই সেটা আর নতুন করে খেতে হবে না। পরে আবার খেতে চাইলে পাবে কোথায়? সুমনের মুখটা মলিন হয়ে
যায়। সে নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে যায়। পাপিয়ার মা সানজিদা বলেন, এটুকু বাচ্চার সাথে তুই এমন করতে পারলি?
ওর হাতে একটু দিলেই হতো। ওর একদিন খেয়ে লাভ কি? অন্যদিন তো খেতে পারবে না। তার চেয়ে না খাওয়াই ভালো।
সানজিদা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, মেয়ে একটা পেটে ধরছিলাম বটে। পাপিয়া নিজের সম্পত্তি বুঝে নিয়ে বিধি ব্যবস্থা
করে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে যায়। জিতু সম্পত্তি বাটোয়ারা ব্যাপার জানতে পেরে বলে, তুমি এই কাজটা কি ঠিক
করেছ? হ্যাঁ ঠিক করেছি। তোমার যখন মনে হলো তুমি ঠিক করেছ তাহলে আমি আর কি বলবো। মাকে আমি মুখ
দেখাবো কি করে! দেখানো তো দূরের কথা তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারবা না। যদি করো এই
দুই বাচ্চার কসম। বাচ্চার কসমের কথা শুনে জিতু কি করবে বুঝতে পারে না। স্তব্ধ হয়ে যায় সে। সাংসারিক উন্মত্ততার
অনেক কথা শুনেছে আজ নিজের জীবনে অনুভব করছে এই যন্ত্রণা।

আবিদার ছেলের কথা নাতি নাতনির কথা অনেক মনে পড়ে। ছেলে তাঁকে ফোন দেয় না বাড়ি ও যায় না। ছেলের সঙ্গে
কথা বলার জন্য তাঁর মনটা অস্থির হয়ে পড়ে। ভেবে পায় না কি করবে। বউয়ের কাছে ফোন দেয়। বৌমা জিতুর সঙ্গে
একটু কথা বলতে চাই। ও ফোন দেয় না,  ফোন দিলেও ধরে না। আর বাড়িতে তো আসেই না। তুমি যদি একটু কথা
বলতে বলে দিতা? আপনার ছেলে আপনার সাথে দেখা করে না কথা বলে না তার জন্য আমি কি করবো? পুত্রবধূর কথা
শুনে বলেন, থাক মা। ‌ছেলের যদি মায়ের কথা মনে পড়ে তাহলে ফোন করবে দেখতেও আসবে। পাপিয়া গরিমা নিয়ে
বলে, দেখেন ছেলে যায় কিনা। আবিদার বউয়ের গরিমার বিপরীতে কোন কথা বলেন না। মনোবেদনা আর অশান্তি নিয়ে
হঠাৎ একদিন আবিদার মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুতে জিতু যায় না। প্রচন্ড ক্ষোভ আর অভিমানে মায়ের মৃত্যুতে সে পাথর
হয়ে যায়। জীবিত থাকতে যে মায়ের মুখ দেখতে পারলাম না, পারলাম না নিজের মুখ দেখাতে। মরে যাওয়ার পর নাই বা
দেখলাম তাকে।