Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
অসিয়ত-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

অসিয়ত-সুলেখা আক্তার শান্তা

লতা অনিন্দ্য সুন্দরী। মেয়ে হলেই জ্বালা তারপর সুন্দরী হলো তো কথা নাই। বাড়ির চতুর্দিকে বখাটেরা ঘুরঘুর করে। লতার ভাই নাহিদ ছোট হলেও বুঝে ওরা বোনকে উত্যক্ত করতে পারে। লক্ষ্য রাখে যাতে ছেলেগুলো বাড়িতে ভিড়তে না পারে। কতক্ষণ আর পাহারা দেওয়া যায়। ছেলেরা কেউ এদিক ওদিক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে। চকলেট বিস্কুট দিয়ে কেউ নাহিদকে হাত করার চেষ্টা করে। নাহিদ নাছোড়বান্দা কোন উপঢৌকন তাকে বিচলিত করতে পারবে না। সুন্দরী লতাকে দেখার জন্য ছেলেদের পাগলামি চলতে থাকে। মনে হয় যেন সবাই ওত পেতে আছে। তার প্রতি অতিমাত্রায় মনোযোগে লতা আশ্চর্য হয়। সেও মানুষ এবং সাধারন একটা মানুষ। ভালোবাসা প্রেম প্রীতি তার মনে জাগে কিন্তু অজানা আশঙ্কায় নিজেকে বিরত রাখে।
লতার বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ে। যেভাবে ছেলেরা উৎপাত করছে তাতে মেয়েকে ঘরে রাখা দায়। ছেলেদের ঘোরাঘুরি বাড়তে থাকলে দুশ্চিন্তা আরো বাড়ে। মেয়ে যেনো সংসারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধীর অপরাধের বোঝা টানতে হয় নিরপরাধীকে। কিছু করার নাই, নির্যাতিতকে মুখ বুজে থাকতে হয়। এই রীতিতে চলছে দুনিয়া। নিরুপায় লতার বাবা-মা সবার মতো উপায় বের করে। মেয়ের বিয়ে দিলে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। লতার ছোট আরো দুই মেয়ে আছে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝঞ্ঝাট মুক্ত হলে তাদেরও বিয়ে দিয়ে দেবে। সংসারে কন্যা সন্তান রাখার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে চায় তারা।
লতার জন্য পাত্রের সন্ধান চলতে থাকে। সৎপাত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বখাটেরাই পাত্র হয়ে বিয়ে করতে আসে। পিতা মাতার সান্ত্বনা মেয়ে তো তাদের কম সুন্দরী না, ভালো পাত্র নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। খোঁজ চলতে থাকে। বাশার আহমেদ বলেন, লতার মা ছেলে তো পাই কিন্তু দায়িত্ববান ছেলে খুব কম। তুমি চিন্তা করো না, দেখবা আমার লতা মার জন্য ভালো পাত্রই পাওয়া যাবে। লতার মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, তাই যেন হয়। লতা যেমন শান্তশিষ্ট লক্ষী মেয়ে ও যেন ভালো জামাই পায়। ঘটক লতার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। ছেলে বয়স্ক তবে হুজুর। ধর্মীয় লাইনে পড়াশোনা করেছে। ঘর গেরস্তি আছে ভালোই। বাশার আহমেদ আর সেতারা বেগমের মনে ধরে। এই পাত্রই মেয়েকে পর্দার মধ্যে রাখতে পারবে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় এই ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু লতা বেঁকে বসে। সে অমন বয়স্ক আর হুজুরকে বিয়ে করবে না। পাত্রের কিছু না থাক তাও ভালো, সে মানানসই ছেলেকে বিয়ে করবে। ইতিমধ্যে বয়স্ক হুজুর বাশার আহমেদকে বিমোহিত করে ফেলেছে। বাশার আহমেদের এক কথা, হুজুর ছেলে পাইছি এ আমাদের বংশের ভাগ্য। তুমি মেয়ের কথা শুনো না। ওর বিয়ের পর আরো দুই মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। বড় জামাই হুজুর হলে পরের দুই মেয়ের জন্যও হুজুর জামাই পাওয়া যাবে। কেউ লতার আপত্তি মানলো না। তাকে বিয়ে দেওয়া হলো বয়স্ক মুখলেসের সঙ্গে। ক্লাসে ভালো ছাত্রী হলেও তার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হলো না। পাত্রপক্ষ অবশ্য বলেছিল বিয়ের পর পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে যেমন সবাই বলে থাকে। লতাকে মোখলেসের সংসারে উঠতে হয়।
বাশার আহমেদ মেয়ের বিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। যাক মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। চৌদ্দগুষ্ঠীর ভাগ্য ভালো এমন হুজুর পাত্র পেয়েছি। তুমি কি বলো লতার মা? আপনি যা বলেন আমারও সেই একই কথা। আমিও খুব খুশি। এখন ভালোয় ভালোয় আর দুই মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে হয়।
বিয়ের পর লতার বাপের বাড়ি যাওয়া নিষেধ। কোথাও বেড়াতে যাওয়া নিষেধ। আপন ভাই তারও বাড়িতে আসা নিষেধ। বাড়ির চতুর্দিকে উঁচু করে বেড়া দেওয়া। মুখলেস আহমেদের নির্দেশ মাথার কাপড় ফেলাইতে পারবা না। উচ্চস্বরে হাসতে পারবে না। হাতে কাচের চুড়ি পড়তে পারবা না। কারণ চুড়ির টুং টাং আওয়াজ হবে। তাতে পরপুরুষের কান খাড়া হবে। স্বামীর বাড়ি আসার পর লতা গোসল করার পর কখনো চুল ছেড়ে শুকিয়ে দেখে নেই। কারণ স্বামীর নির্দেশ চুল ছাড়া যাবে না। ছোট দুই বোন ভাইকে দেখার জন্য লতার মন ছটফট করে। তাদের বাড়িতে আসা নিষেধ। বাবা যদি কখনো আসে পর্দার ওপর থেকে কথা বলতে হবে। মেয়ে চেহারা দেখাতে পারবে না। কঠিন সব বিধি নিষিধ।
লতার ছোট বোন রিপার বিয়ে। জামাই মেয়েকে বিয়ের দাওয়াত পাঠিয়েছে। কিন্তু লতা বিয়েতে যেতে পারবে না। বিয়েতে লোক সমাগম হবে। অনেক পর পুরুষ থাকবে পর্দার বরখেলাপ হবে। পুরুষের সম্মুখীন হওয়াই পর্দার বরখেলাপ। তাতে লতার গুনাহ হবে। গুনাহের ভাগীদার হতে হবে স্বামীকে। যে পথে গুনাহ আছে সে পথে না হাঁটাই উত্তম।
ছোট বোনের বিয়েতে যেতে না পারায় লতার খুব মন খারাপ। সে কল্পনা করেনি তার জীবনটা এমন হবে। অনেক মহিষী নারীর কথা সে পড়েছে যারা পর্দার মধ্যে থেকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। নিজের গড়া চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বিবেক বিবেচনা। স্বামীর আদেশ-নিষেধ মানতে মানতেই দিনরাত যায় লতার। তার গর্ভে সন্তান আসে। লতা বাবার বাড়ি যেতে চায় কিন্তু স্বামীর এক কথা বাবার বাড়ি যাওয়া যাবে না। স্বামীর বাড়ি এসেছো লাল শাড়ি পড়ে আর বের হবা সাদা শাড়ি পড়ে। মরণের পরে মানুষ যে সাদা শাড়ি পরে মুখলেস আহমেদ এটা দিয়ে তাই বুঝালো। ছোট বোন মুনা এবং ছোট ভাই নাহিদ বিয়েতে যাওয়ার অনুমতিও মেলে না। স্বামী যা বলে তাই মেনে নিয়ে সংসার করার রীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে লতা।
লতার বাবা বশির আহমেদ মারা যান। বাবার মৃত্যুতে যেতে দেননি স্বামী মুখলেস আহমেদ। মোখলেসের বোন জহুরা এই আচরণের প্রতিবাদ জানায়। জানতে চায় এত বাড়াবাড়ির কথা কোথায় আছে। সব প্রথার প্রচলন হয়েছে ভালো এবং মঙ্গলের জন্য নিপীড়নের জন্য নয়। ভাই বোনের বিয়েতে যাওয়া নিষেধ। পিতার মৃত্যুতে উপস্থিত হওয়া যাবে না। অগোচরে পর্দার বরখেলাপ হতে পারে। কোন যুক্তি বিচলিত করতে পারে না মোকলেসকে। দুঃখে লতার বুক ফেটে যায়। যাবে না কোনদিন সে বাহিরে। স্বামীকে বলতে চায় তার মৃত্যু হলে তোমার ঘরে মধ্যে মাটি দিও।
লতার ছেলে ভূমিষ্ঠ হয়। লতা খুব খুশি। ছেলে তার বড় হলে তাকে দুনিয়া ঘুরে দেখবে। আশায় বুক বাঁধে লতা। বিধি বাম। জীবনে ছন্দপতন ঘটে। ছেলে হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ স্বামী মুখলেস আহমেদ মারা যায়। দুর্ভাগ্যের কপাল যেন নিয়ে এসেছে সে। যেমন হোক তাও একজন স্বামী ছিল। এখন হতভাগ্য পরিচয় মর্যাদাহীন বিধবা হিসেবে। লতার স্বামী মারা যাওয়ায় এখন সবকিছু লতাকে করতে হয়। আবদ্ধ না করে পরিস্থিতি মোকাবেলার সুযোগ পেলে জীবন এখন সহজ হত। ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করায়। লতার সব আশা ভরসা এখন ছেলেকে কেন্দ্র করে। ছেলে একদিন বলে, মা আমার জন্য তোমাকে আর মাদ্রাসায় যেতে হবে না। আমি ভালো আছি আমাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। তুমি বাড়ি থেকে বের হবা না, হাটে বাজারে যাবানা। লতা লক্ষ্য করে ছেলের মন-মানসিকতা বাবার মতো হয়ে উঠছে। বাবা যেমন চাইতো মেয়ে মানুষ অন্তঃপুরবাসিনী হবে। বাড়ির ভিতর কঠোর পর্দায় থাকবে। ছেলেও তেমনি চায়। ছেলে তৌসিফ জানতে পারে তার মা হাটে বাজারে যায়। মনে মনে সে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেয় এখন থেকে মাদ্রাসায় থাকবে না। বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করবে। সে বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে থাকে।
লতার মা মারা যান। লতা মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাপের বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ছেলে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মা বাবা তোমাকে নিষেধ করেছে বাড়ি থেকে বের না হইতে। মৃত মানুষের কথা রাখোনি। তুমি এই বাড়ি থেকে বের হতে পারবা না। নানীর বাড়িতে অনেক লোক আসবে। অনেক বেগানা পুরুষের সামনে যেতে হতে পারে। কাঁদাকাটির সময় কোন পর পুরুষ দেখে ফেলতে পারে। আমি ছেলে হিসেবে তোমাকে সেখানে যেতে দিতে পারি না। কাঁদাকাটি যা করার এখানে বসেই করো। লতা কাকুতি মিনতি করে বলে, এ তোর কেমন কথা বাবা? মরা মায়ের মুখটা শেষবারের মতো একবার দেখতে পারবো না। জীবিত অবস্থায় তাকে দেখেছো মৃত অবস্থায় দেখা না দেখা সমান। তুমি কোন ভাবে সেখানে যাইতে পারবা না। যদি যাও তাহলে ভাববো তুমি তোমার স্বামীর আদেশ অমান্য করছো! মা তুমি থাকো তার চেয়ে আমি গিয়ে দেখে আসি। তৌসিফ মাকে না নিয়ে একাই রওনা দেয়।
লতা ভাবে এখন সে কী করবে। পিতার মৃত্যুর সময় যেতে পারিনি সেই বেদনা আজও তাকে দগ্ধ করে। মায়ের মৃত্যুর পর একই ঘটনা ঘটবে? কোনভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারে না। সে ভাবে আড়াল থেকে মৃত মায়ের মুখটা দেখে আসবে। রওনা দেয় বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িতে ঢুকতেই ছেলের চোখে পড়ে যায় মার দিকে। মা তুমি ছেলের কথা না মাইনা চইলা আসছো? থাকো তুমি আমি চলি আমার বাড়ি। একদিকে মায়ের জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে আর একদিকে ছেলে করছে রাগ। লতা কী করবে কোন কুল কিনারা পায় না। সে এক চরম সিদ্ধান্ত নেয়। মায়ের লাশ নিজ হাতে গোসল করিয়ে দাফন করতে দেয়। সারা জীবনের জ্বালা যেন কিছুটা প্রশমিত হয়।
বাড়িতে গিয়ে লতা উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে যায়। নারীর জীবন মনেই কী শিকলে বাঁধা চেতনা বিহীন জড়বস্তু। হাত-পা বাঁধা পরাধীনতা যেখানে পুরুষের হুকুম চূড়ান্ত। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিঃশব্দে অনুসরণ করতে হবে তাদের। যারা আসবে পিতার রূপে স্বামীর রূপে সন্তানের রূপে অনন্তকাল। তার হিতাহিত জ্ঞান বিবেচনা বোধ এর কী কোন মূল্য নেই। সে কোনদিন অমানুষের মতো চলেনি। তবু কেন অমানুষের জীবন যাপন করতে হবে। সে কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাপের বাড়ির দিকে চলে যায়। গ্রামের শেষ প্রান্তে ডেরা বাঁধে যে জমিটুকু সে পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিল। সেখানেই তার মৃত্যু হয় এবং অসিয়ত অনুযায়ী তার দাফন হয়েছিল কঠিন পর্দার নিয়ম মেনে।