Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব-সুলেখা আক্তার শান্তা

ডেস্ক:

যাক অবশেষে আমি ঠিক সময় মত আসতে পেরেছি। বলতে বলতে এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে নাহিদ। নাহিদ ঢাকা থেকে চিটাগাং যাবে।একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ সে। অফিসের কাজে মাঝেমধ্যেই টুরে যেতে হয়। চেক ইন শেষ করে ওয়েটিংয়ে গিয়ে বসে। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে দৃষ্টি আটকে যায় তার। অনিন্দ্য সুন্দরী একজন বিদেশিনী। উদাস নয়নে এদিক-ওদিক দেখছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে প্রায়ই বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। তুলনা করলে এমন সৌন্দর্য এর আগ তার চোখে পড়েনি। সহজাত বাঙালির মত সে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল সুন্দরী তরুণী দিকে। বিদেশিদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলায় সে অভ্যস্ত। তরুনীটি বসে আছে একটু দূরে। নাহিদের স্মার্টনেস প্রয়োগ এখানে দৃষ্টিকটু হবে। এরমধ্যে বিমানে আরোহণের অ্যানাউন্সমেন্ট ঘোষণা হলো। সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ালো প্লেনে ওঠার জন্য। কিউ এ দাঁড়ানো বরাবরই নাহিদের অপছন্দ। সবশেষে ধীরেসুস্থে নিজের সিটের দিকে এগিয়ে যায়। সিটে গিয়ে একটু আশ্চর্য হলো, বিদেশিনীর পাশেই তার সিট পড়েছে। মনে মনে একটু আনন্দিত হলো। নাহিদ সৌজন্য বিনিময়ের পর বিদেশিনীর সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করে। হ্যালো, আই এম নাহিদ।
আই এম আইজা। আইজা বলে, আইজা তাজ্জব করে দিয়ে বলে, আমি কিন্তু বাংলা বলতে পারি। এরপর দু’জনে একসঙ্গে হেসে উঠে। এতক্ষণের উদাসী গাম্ভীর্য হালকা হয়। নাহিদ মনে মনে ভাবে শ্বেতাঙ্গ তরুণীদের মনে করা হয় রূপকথার পরী। তাদের এমন মুখ ভার করে রাখা মানায় না। দু’জনের আলাপচারিতা বেশ জমে ওঠে। আইজার দেশ জার্মানি। জার্মানির প্রধান শহর হামবুর্গে তাদের বাড়ি। ভাঙ্গা ইংরেজি এবং ভাঙ্গা বাংলায় আলাপ চলে। বিদেশিনীর বাংলা জানার রহস্যটা নাহিদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা অসংগতি বাঙালি কৌতুহলকে হার মানায়। জিজ্ঞেস করে আপনি কোথায় যাবেন?
আমি চিটাগাংগের পটিয়া যাব।
আমিও সেখানেই যাব। দু’জনেই একই পথে। আইজার চোখেমুখে একটা হতাশার ভাব দেখে। নাহিদ অতি উৎসাহ সংযত করে। আপনার সঙ্গে কেউ নেই একা দেখছি?
হ্যাঁ, আমি জার্মানি থেকে আমার স্বামী সন্তানের খোঁজে বাংলাদেশে এসেছি। আইজার চোখে দেখতে পায় পানি ছল ছল করছে। নাহিদের মনে আরো কৌতূহল জাগে আইজাকে জানার। তারা বাংলাদেশে থাকে বুঝি?
হ্যাঁ।
নাহিদ মনে করে আইজার মন কোনো ব্যাপারে খারাপ হয়ে আছে। সে কোনো কথা বলতে চাচ্ছে না। নাহিদ বলে, আপনার যদি কোন কথা বলতে আমাকে ইচ্ছা করে, আপনি বলতে পারেন। আমার দেশের বাড়ি চিটাগাং পটিয়ায়। আমি ঢাকায় থাকি। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করি।
আইজা ও আচ্ছা আচ্ছা। কোনভাবেই যেন হতাশার মলিনতা তার চেহারা থেকে দূর হলো না। প্লেন চট্টগ্রামে ল্যান্ড করে। সবাই বের হবার প্রস্তুতি নেয়। দু’জন দু’জনের গন্তব্যে চলে যায়। আইজা আগে থেকে বুক করা একটি হোটেলে ওঠে। শুরু করে স্বামী-সন্তানের সন্ধান। স্বামীর নাম খালেদ, বাংলাদেশের চিটাগাং পটিয়া এতোটুকু ছাড়া আর কিছু জানা ছিল না তার।
কয়েকদিন অবিশ্রান্ত খোঁজাখুঁজি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। স্বামী-সন্তানের কোন হদিস করতে পারেনা। হতাশায় ভেঙে পড়ে। কোথায় তারা কেমন আছে ন্যূনতম একটু সংবাদে প্রশমিত হত তার প্রচন্ড উৎকণ্ঠা। সন্তানের জন্য মায়ের চিরন্তন আকুলতা বৃথা সান্ত্বনায় প্রশমিত হয় না। স্বামীর কথা ভাবে। তার হৃদয় যেমন অব্যক্ত কান্নায় ভারী হয়ে আছে তাদেরও কি তেমন হয়! কোন কূলকিনারা করতে না পেরে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় দেখেনা না সে।
কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও আইজার কথা নাহিদের মনে পড়েছে স্বাভাবিক কৌতূহলে। ফিরে আসার দিন এয়ারপোর্টে আবার আইজাকে দেখে আশ্চর্য হয় নাহিদ। আরো আশ্চর্য হয় আইজার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে। দেখলেই বোঝা যায় প্রচন্ড মানসিক এবং শারীরিক ধকলে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে সে। কৌতূহলের সঙ্গে মায়াও হয় নাহিদের। সেই দিন একই ফ্লাইটে আইজা চিটাগাং থেকে ঢাকায় ফিরছিল। এয়ারপোর্টে ওয়েটিং রুমে আইজাকে দেখে নাহিদ আইজা আপনি? দৃষ্টির উদাসীনতা তখন আরও গভীর হয়েছে। যাক আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হলো। আপনার স্বামী সন্তানের কি অবস্থা?
আমি তাদের খুঁজে পাইনি!
খুঁজে পাননি!
আমি তার কোন ঠিকানা জানিনা!
ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলতে পারেন, যদি আপনি আপত্তি না করেন। সৌজন্য বজায় রেখেই জানতে চায় নাহিদ।
আমার স্বামী খালিদ ও আমি জার্মানির একই কোম্পানিতে চাকরি করতাম। আমরা সেখান থেকেই দু’জনে দু’জনের প্রতি ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ি। এরপর বিয়ে করি আমরা। ঘর সংসার করি। তারপর ঘর আলো করে আমাদের প্রথম কন্যা সন্তান এলিজা জন্ম নেয়। এরপরে জন্ম নেয় আমাদের দ্বিতীয় সন্তান সোফিয়া। মানুষের জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত থাকে। আমার দুই মেয়ের দিকে তাকালে জীবন সংগ্রামের সব কষ্ট ভুলে যেতাম। খালিদের সঙ্গে আমার জার্মানিতে ছয় বছর ঘর সংসার। খালেদ ছিল ধর্মপরায়ণ। খালেদের কাছ থেকে শুনেছি তাদের বংশধরেরা ধর্মীয় যাজকের ঐতিহ্য ধারণ করতেন। ওর ধর্মীয় অনুভূতিকে আমি সর্বতোভাবে সম্মান করতে চেষ্টা করতাম। খালিদ তাতে খুব একটা সন্তুষ্ট বলে মনে হতো না। সন্তানদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করতো কখনো কখনো। ভাবতো সন্তানরা জার্মানিতে সু-সন্তান হয়ে গড়ে উঠবে না। খালিদের ইচ্ছা বাচ্চাদের দেশীয় কালচারের সঙ্গে পরিচিত করানো প্রয়োজন। সন্তানদের বাংলাদেশে নিয়ে গেলে সেটা সম্ভব হতে পারে। আমার বড় মেয়ের বয়স তখন ছয় বছর। স্কুলে যেতে শুরু করেছে। ছোটটার চার বছর। তখন একদিন হঠাৎ খালেদ কথাটা বলে। সে বাচ্চাদের নিয়ে দেশে যেতে চায়। তার বাবা মার বয়স হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তারা নাতনিদের একবার দেখতে চান। তখন ইউরোপ জুড়ে চলছিল অর্থনৈতিক মন্দা। জার্মানিতেও লেগেছিল সেই সংকটের ঢেউ। কাজ হারিয়ে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই সময়ে ছুটি নিলে কিংবা চাকুরী ছেড়ে গেলে পরবর্তীতে আমার পক্ষে কাজ পাওয়া কঠিন হবে। বিষয়টা আমি খালেদকে বুঝিয়ে বললাম। খালেদ ঝটপট উত্তর দিল, তোমার না গেলেও চলবে আমি বাচ্চাদের সামলাতে পারবো। আমি চুপ করে গেলাম। খালেদের অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাইনি কিন্তু আমার অনুভূতিতে ঝড় বয়ে গেল। কিছুদিনের তো ব্যাপার দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। খালেদের মুখ চেয়ে অসম্ভব বিষয়টা আমাকে মেনে নিতে হলো। বাচ্চারা নতুন জায়গায় যাওয়ার আনন্দে ছিল মশগুল। সব ঠিকঠাক হলো। একদিন তাদের প্লেনে তুলে দিয়ে অশ্রুসজল চোখে শুন্য ঘরে ফিরে এলাম। সে আজ পাঁচ বছর আগের কথা। আইজার চোখ থেকে তখন অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরছিল। নাহিদ স্তম্ভিত হয়ে শুনছিল হৃদয়বিদারক কাহিনী।
আইজা আবার শুরু করে। এই পাঁচ বছরের প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি দিনের কষ্টের কথা বলে বোঝাতে পারবো না। প্রথম কিছুদিন স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। খালিদের পিতা-মাতার অসুস্থতার কথা বলে বিভিন্ন অজুহাতে সময় পেছাতে থাকে। আমি বোকার মত অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকি। কি করে যে পাঁচ বছর পার হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। শেষের দিকে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিজেই বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেই। মায়ের বুক খালি করে সন্তান ছিনিয়ে নেওয়ার মতো কাউকে ভালোবেসে ছিলাম। আমি এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। এমন নিষ্ঠুর প্রতারণা কোন মানুষ মানুষের সঙ্গে করতে পারে। ভগ্নহৃদয়ে প্রচন্ড হতাশা নিয়েই চলে যেতে হচ্ছে দেশে।
নাহিদ বলে, আপনি আরো একটু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি কিছু মনে না করেন ঢাকায় আমার ফ্যামিলির সঙ্গে থাকতে পারেন। আমি আপনার স্বামী সন্তানদের খুঁজতে সাহায্য করতে পারি।
আইজার বিমর্ষ চেহারা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, আপনি আমার স্বামী সন্তানদের খুঁজতে সাহায্য করবেন?
আপনি চাইলে অবশ্যই করবো। আমার চেষ্টায় সামান্যতম সফলতা এলেও অশোক মনে করব নিজেকে। রাজি হয়ে যায় আইজা নাহিদের বাসায় যেতে। নাহিদ বাসায় নিয়ে আসে আইজাকে। নাহিদের মা ও বোন আইজাকে দেখে অবাক! মা রুবি বলে, ওমা এ তো বিদেশি!
মিলি বলে, ভাইয়া তুমি একে পেলে কোথায়?
নাহিদ বিস্তারিত সব কথা খুলে বলে। নাহিদের মা রুবি ছেলের মুখ সবকথা শুনে আইজার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। আফসোস করে বলে, আহারে স্বামী সন্তানের সঙ্গে একবার দেখা হলেও মনের হাহাকার কিছুটা কমতো। যাক আমাদের এখানে এসেছে যখন কিছুদিন থাকুক। তারপর রুবিনা নিজে হাতে অনেক ধরনের পিঠা বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে আইজার জন্য। নাহিদ পরিবারের আপ্যায়নে আইজাও বেশ খুশি। নিজের পরিবার হারানোর ব্যথা যেন এই পরিবারে এসে কিছুটা প্রশমিত হয়। নাহিদের বোন মিলির হৃদয় স্পর্শ করেছিল আইজার ঘটনাটি। মিলি সঙ্গ দিয়ে তাকে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করছিল। মিলি আশেপাশে সবকিছু ঘুরে দেখায়। মিলির সঙ্গেও বেশ ভাব হয় আইজার। নাহিদ তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঢাকা শহর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখায়। আইজা মুগ্ধ হয় নাহিদকে বলে, বাংলাদেশে খুবই সুন্দর। এখানের মানুষগুলো অনেক ভালো এটা বলে আইজা আবার চুপ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় তার স্বামীর কথা।
নাহিদ তা বুঝতে পারে, কয়েকদিন একসঙ্গে চলায় কেমন এক মমত্ববোধ জন্মে আইজার জন্যে। কিন্তু মুখ ফুটে বলে না। আইজার হৃদয়ে স্থান করে আছে তার স্বামী সন্তান। এছাড়া তার মনে অন্য কিছু আর উপলব্ধি নেই। আইজার অনির্দিষ্টকাল এখানে থাকা সম্ভব নয়। নিজ দেশে চলে যাবার প্রস্তুতি নেয়। নাহিদ আশ্বাস দেয় তার সন্তানদের সন্ধানের। সবারই মন খারাপ হয়ে আইজার জন্য। আইজার ও নাহিদের পরিবারের সকলকে ভাল লাগে। খুবই মায়া পড়ে যায় তাদের। যাবার সময় আইজা বলে, আমি আবার ফিরে আসবো তোমাদের ভালবাসার টানে। রুবি বলে, তুমি আবার ফিরে এসো। নাহিদ আইজাকে নিয়ে বের হয় এয়ারপোর্টের দিকে। অসঙ্গত হলেও নাহিদ হৃদয় তোলপাড় করে কিছু বলার জন্য। সহানুভূতি থেকে সৃষ্ট আন্তরিকতা কখনো হয়তো ভালোবাসায় রূপ নেয়। কিন্তু সে কথা বলতে বড়ই সংকোচ হয়। নাহিদ হঠাৎ আইজাকে বলে ফেলে, আমি তোমার হাতটা ধরতে পারি? আইজা নির্দ্বিধায় হাতটা বাড়িয়ে দেয় ধরার জন্য।
যাক তোমাকে স্পর্শ করা স্মৃতি হয়ে থাকবে। আইজা বলে, আবার ফিরে আসবো হয়তো তোমারই টানে আর আমার বিদীর্ণ অস্তিত্বের সন্ধানে। মন যে আমার পড়ে রয়েছে এখানে। উভয়ের চোখ তখন বাষ্পরুদ্ধ। আইজার প্লেন ছেড়ে দেয়। প্লেনটা যতদূর দেখা যায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নাহিদ প্লেনের দিকে। নাহিদ ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসায় ফিরে আসে। ব্যস্ত হয়ে যায় নিজের কাজে। কিন্তু শত ব্যস্ততার মাঝেও ভুলতে পারেনা আইজাকে। হৃদয় উঁকি দিয়ে ওঠে আইজার সঙ্গে অল্প কয়েকদিন চলার স্মৃতি।

লেখক-সুলেখা আক্তার শান্তা