Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
সুখ দুঃখের ঈদ-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

সুখ দুঃখের ঈদ-সুলেখা আক্তার শান্তা

                                             সুখ দুঃখের ঈদ – সুলেখা আক্তার শান্তা
রেহানার জীবন খুব একটা সুখের না তবু যেমন চলে তেমনি মেনে নেয়। মেনে নিতে হয়। দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষের
জীবন যেন এক সূত্রে গাঁথা। রেহানার স্বামী সেই যে বাড়ি থেকে গায়েব হয়েছে আর ফিরে আসেনি। অনেকে বলে
মরে গেছে, বেঁচে থাকলে ঠিকই ফিরে আসত। নাকি ইচ্ছে করেই নিরুদ্দেশ হয়ে আছে তাও জানে না কেউ। রেহানা
মনে মনে ভাবে, আমার কথা নাই চিন্তা করুক বাপ হিসেবে মেয়ে দুটোর কথা তো চিন্তা করতে পারে। আরো কত
কিছু আকাশ পাতাল ভাবে। ভিতরে তাড়া অনুভব করে, বইসা থাকলে হইবো না যাই গিয়া কাজ করি। বাড়ি বাড়ি
কাজ করে যা পায় তাই দিয়ে চালাতে হয় দুই মেয়ে নিয়ে সংসার। বড় মেয়ে ফারিয়া খুব নাক সিঁটকানো স্বভাবের।
এটা খাবে না ওটা ভালো না, এটা দাও ওটা দাও। তার চাহিদার আর শেষ নেই। রেহেনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, মা’রে
মানুষের বাড়ি কাজ করি তারা যা দেয় তাই তো এনে দেই। পরেরটা নিলে ভালো-মন্দ বিচার করা যায় না। ফারিয়া
ঝামটা মেরে বলে, এ গুলা খামুনা না। মাছ নাই, মাংস নাই, যে খাইতে পারে তারে দাও গিয়া। রেহেনা মেয়েকে
বোঝানোর চেষ্টা করে, তোদের ভালো-মন্দ খাইতে দিতে কি আমার মন চায় না? আমি চাই আমার মেয়ে দুইটা
ভালো খাইবো ভালো থাকবো। ফারিয়ার উচ্চাভিলাষী চলন বলন আর দারিদ্র্যের প্রতি বিতৃষ্ণা মাকে চিন্তিত
করে। বাবা নিরুদ্দেশ মা এত কষ্টে সংসার চালায় তা নিয়ে দুই মেয়ে ফারিয়ার আর মিনা  খুব একটা মাথা ব্যাথা
নাই। সে ভালো খাওয়া দাওয়া ভালো জামা কাপড় চায়। ফারিয়া মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে। কোন কথা তার মুখে
বাঁধে না। সন্তানের আবদার মিটাতে পারবা না তাহলে সন্তান জন্ম দিছিলা কেন? রেহেনা মেয়ের কথার উত্তর
খুঁজে পায় না সে স্তব্ধ হয়ে যায়।
ফারিয়া মাকে কিছু না জানিয়ে ঢাকায় চলে আসে। নিজে গ্রামের মানুষের সহায়তায় গার্মেন্টসে চাকরি জুটিয়ে
নেয়। রেহেনা মেয়ের খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পরে। কোথায় গেল কী হলো কিছুই বুঝতে পারে না। ‌নানা
জায়গায় মেয়ের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে কান্নাকাটি করে, তুমিও নিরুদ্দেশ হইলা
তোমার মেয়েও সেই পথ ধরল। তোমাদের পাষাণের অন্তর। কেউ যে তোমাদের নিয়ে চিন্তা করে কষ্ট পায় সে
কথা তোমাদের মনে হয় না। রেহেনা কান্নাকাটি করে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, এই বুঝি মেয়ে আর বাপ বাড়ি
ফিরে এলো। দুই মাস পর ফারিয়ার চিঠি আসে। সে ভালো আছে। ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। রেহেনা মেয়ের
খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়।
ফারিয়া চাকরি করলেও মা-বোনকে কোন টাকা পয়সা দেয় না। যোগাযোগও তেমন একটা করেনা। ফারিয়ার সঙ্গে
পরিচয় হয় আসিফের। আসিফের কাছে ফারিয়া নিজেকে বড়লোকের মেয়ে হিসাবে তুলে ধরে। বিশ্বাসযোগ্য একটি
কাহিনীও তৈরি করে। সে বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছে। বাবা মা এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করছিল
যাকে সে বিয়ে করতে চায় না। তাই সে রাগ করে চলে এসো এসে গার্মেন্টসে চাকরি করছে। বাবা মার কাছ থেকে
সে কোন অর্থকড়ি নেয় না।‌ চাকরি করে শুধু নিজের খরচ চালানোর জন্য। আসিফ বিশ্বাস করে ফারিয়ার কথা।
তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। শুভ দিনক্ষণ দেখে আগামীতে তারা বিয়ে করবে।
রেহেনা ছোট মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় যায়। ভাবে দুই সন্তানকে নিয়ে এক জায়গায় থাকবে। ফারিয়ার বাসা খুঁজে বের
করে। ফারিয়া মাকে দেখে অবাক হয়! তুমি কেন হুট করে এখানে আসলা? আসবা আমাকে তো বলে কইয়ে আসতে
পারতা? মারে, মেয়ের বাসায় মা আসবে তা আবার বলে কয়ে আসতে হবে? আমার মন চাইলো তাই তোর বাসায়

চলে আসলাম। আমার এখানে আসছো ভালো কথা কিন্তু তোমাদের এখানে রাখা যাবে না। আর তোমাদের কাপড়-
চোপড়ের যে অবস্থা। রেহেনা অবাক হয় মেয়ের কথা শুনে! ফারিয়া বলে, আমি এখানে সবাইকে বলছি আমার
বাড়ির অবস্থা ভালো। রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছি, নিজের খরচ চালাতে গার্মেন্টসে চাকরি করি। এখন
তোমাদের এই অবস্থা দেখলে আমার মান সম্মান থাকবে কিছু? ফারিয়া তার সমস্ত অস্তিত্ব থেকে দারিদ্র্যের
চিহ্ন সমূলে উপড়ে ফেলতে চায়।
মা আমরা তো ঢাকা শহর কিছু চিনি না! ঢাকা আইছি তোর ভরসায়। এখন তুই যদি তোর বাসায় ঠাই না দিস তাহলে
কই যাব? তোমরা বাড়ি চলে যাও। আমার এখানে তোমাদের কিছুতেই রাখা সম্ভব না! মেয়ের এমন কথায় রেহেনা
দুঃখ পায়, দু’চোখ ভিজে আসে। অশ্রু সংবরণ করে বলে, তোর বোনডারে কয়ডা খাইতে দে। খাওয়া হইলে আমরা
চইলা যামু।
রান্না ভাত নাই। তোমরা তাড়াতাড়ি চইলা যাও।
এতদূর থেকে মা-বোন যার ভরসায় এলো তাদের একটু বসতেও দিল না। গেটের থেকেই বিদায় করে দিল? এক
বাড়ির পাশে অশ্রুসিক্ত রেহানার অসহায় দৃষ্টিতে বসেছিল। মা মেয়ের বিপর্যস্ত শুকনা মুখ দেখে বৃদ্ধ রমিজ
মিয়া এগিয়ে আসেন। কে গো তোমরা, এখানে বসে আছো কেন? রেহেনা কোন কথা বলেন না। রমিজ মিয়া
সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের বাড়ি কই? কোথায় যাইবা? রেহানা সংক্ষেপে পরিচয় দিয়ে একটা
অনুরোধ করে। ভাই আমার এই ছোট মেয়েটা সারাদিন কিছু খায় নাই ওরে কিছু খাওন দিতে পারেন?
তোমাগো দু’জনের মুখ শুকনা। দেইখা বুঝছি অনেকক্ষণ খাওয়া-দাওয়া নাই। আসো আমার বাসায় যা আছে তাই
খাইবা।
রেহানা বলে, আমার খাওন লাগবো না। আমার মেয়েরে কয়টা খাইতে দিলেই হইবো।
শোনো আমার বয়স হইছে, মানুষের মুখ দেখলেই বুঝতে পারি কে সুখে আছে কে দুঃখে আছে। ক্ষুদা পেটে নিয়ে
যুদ্ধ করা যায় না। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হইলে পেট টারে আগে শান্তি করতে হইবো। এই আমার ভাঙাচোরা
ঘর। বৃদ্ধ দু’জনের খাবার ব্যবস্থা করেন।
খাওয়ার পর কিছুটা সুস্থির হলে রেহেনা সব কথা খুলে বলে। রমিজ মিয়া সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বলেন, বোন সবই
তো শুনলাম। এখন কোথায় যাবা কী করবা? যাই করো থাকোনের একটা জায়গা তো দরকার। তোমাদের এই
ঘুপড়ির মধ্যে একটা রুম নিয়া দেই। থাকো এইখানে। কাজকাম খুঁইজা লও তারপর দেখবা দুঃখ কইমা আইবো।
রেহেনা খুশি হয়ে বলে, যেখানে মুশকিল সেখানে আছান। ভাই খুব হতাশ হইয়া পড়ছিলাম। আল্লাহ অশেষ
মেহেরবান তিনি আপনার মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। আপনাকে আমি ভাই বলে ডাকবো। আপনি আমার
ধর্মের ভাই। তুমি আমারে ভাই বলেই ডাইকো। রমিজ মিয়া কয়েকটা কাজ জোগাড় করে দেন রেহেনাকে। সেই
কাজের ব্যস্ততায় দিন পারি দেয় মেয়ে মিনাকে নিয়ে।
সন্তান যেমনি হোক মা তো সন্তানকে ভুলতে পারে না। ফারিয়ার কথা খুব মনে পড়ে রেহানার। মেয়ের কথা মনে
করে কান্না পায়। রেহেনা ঢাকাতেই আছে সে কথা ফারিয়া জানেনা। সামনে কোরবানির ঈদ, কয়েকটা দিন বাকি
আছে। রেহানার জন্ম গরিব ঘরে। বাবার সংসারে কিংবা স্বামীর সংসারে কোনদিন কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য
হয় নাই তাদের। বিষয়টি অভাবী অনেকের মতো ভাগ্যের অমোচনীয় পরিহাস হিসেবে মেনে নিয়েছে। জঠর জ্বালা
নিবারণের ব্যবস্থাহীন সমাজে কোরবানি দেওয়ার সুযোগ কখনো কী হতে পারে? মিনা বলে, মা চলো আপার
বাসায়। মারে তোর বোনের বাসায় কেমনে যাই? সেতো এই গরিব মা, বোন পরিচয় দিতে চায় না! আর তার পরিচয়
সে বড়লোকের মেয়ে।
প্রতিদিনই মিনা বায়না ধরে, মা চলো না আপার বাসায় যাই।
একসময় রেহেনা বলে, আমি যদি দূর থেকে তোর বোনের বাসা দেখাইয়া দেই তুই যাইতে পারবি না?
মিনা বুঝতে পারে তার মা তার বোনের ব্যবহারে খুব কষ্ট পাইছে। মাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে, না
মা যেখানে তুমি এত কষ্ট পাইছো সেইখানে আমি যামু না। রেহেনা মেয়েকে আদর করে বলে, ঠিক আছে তুই কাঁদিস
না আমি তোকে নিয়ে একদিন যাব।
ঈদের দিন। রেহেনা যে বাসা গুলোতে কাজ করতো সেখানে আলাদা করে তার জন্য কোরবানির মাংস রাখা হয়েছিল।
রেহেনা খুশি হয়ে মাংস নিয়ে বাসায় ফেরে। অনেকদিন মাংস খাওয়া হয়না। কোরবানি ঈদের উপলক্ষে মাংস খাওয়া
হবে। সন্তানের মুখে মাংস তুলে দেওয়ার দৃশ্য দু’নয়ন ভরে দেখবে রেহানা। বড় মেয়ের কথা মনে পড়ে। চল মা, তুই

না তোর বোনের বাসায় যাইতে চাইছিলি। আমরা তিনজন মাংস রান্না কইরা ভাত খামু। মিনা উৎসাহ নিয়ে বলে,
মা তাহলে চলো আপার বাসায় যাই।
মেয়ের বাসায় গিয়ে ফারিয়াকে ডাকে, মা আমরা আইছি তোর কাছে। দেখ মাংস নিয়া আইছি। আমি রান্না কইরা
তগো দুই বোনেরে খাওয়ামু। ফারিয়ার কথায় কোন ভাবান্তর নাই।
তোমাগো কইছি না আমার কাছে আইবা না। কেন আইছো?
আইজ একটা পরবের দিন। ঈদের দিন মানুষ পরের বাসায়ও যাওয়া আসা করে। এইটা তুই কী বলিস। তুই কাউকে
বলিস না আমি তোর মা। আমিও কারো কাছে বলবো না।
তুমি বুদ্ধি শিখাইবা আর আমি সেই বুদ্ধি দিয়ে চলব? তুমি মানুষের বাড়ি বাড়ি থাইকা মাংস টোকাইছো আর এই
মাংস আমার এখানে নিয়ে আইছো? রেহানা অতি কষ্টে বলে, তুই মায়েরে অপমান কইরা যাই বলিস আল্লাহ যেন
তোরে মাফ করে।
তুমি যদি আমার ভালই চাইতা তাহলে এই টোকাইনা মাংস নিয়ে আমার বাসায় আসতা না। এইগুলা নিয়ে এখনি
চইলা যাও। রেহানা ভাবে, নিজের পেটের সন্তান যে এমন হতে পারে চাক্ষুস না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
অশ্রু সংবরণ করে বলে, আমরা চলে যাচ্ছি। আইছিলাম ঈদের দিন তিন মায়ে ঝিয়ে মাংস দিয়া একসঙ্গে কয়টা
ভাত খাইতে। সে খাওয়া হইয়া গেছে। আর কোনদিন তোর বাসায় যেন আসা হয় না। রেহেনা পেছনে দিক না ফিরেই
মিনাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ফারিয়ার ক্ষোভ মায়ের প্রতি নাকি দারিদ্র্যের প্রতি। কিন্তু এমন
দারিদ্র নিয়ে কাটছে দুনিয়া ভর বেশিরভাগ মানুষের জীবন অবলীলায়।
রেহানা বাসায় আসে বিষণ্ণ চিত্তে। বৃদ্ধ রমিজ বলে, কি বোন? কিছু একটা হইছে মনে হয়? যাই হয়ে থাক পরে
শুনব। আমি মাংস ভাত আনছি আসো একসঙ্গে খাইবা। না ভাই আমি খাবোনা। তোমার কথা শুনে কে? আমি ভাই
বলছি আসো খাইয়া নেই। রেহেনা, মিনা, রমিজ মিয়া এক সঙ্গে খায়। শোনো বোন আল্লাহ পাক কাউকে কোন
কিছু থেকে বঞ্চিত করেন না। তোমার এক জায়গায় কিসমত কাটা গেছে। আল্লাহপাক আরেক জায়গায় তোমার
রিজিক ঠিকই রাইখা দিছেন।