আজ ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিষন্ন বিদায়-সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক: এখন আর শরীরে আগের মতো শক্তি নেই। কাজ করতে হলে শক্তির প্রয়োজন। দিনদিন শরীরে কি হয়েছে কিছুই বুঝিনা। মনোয়ার স্ত্রী ভানুরে বলে, ওহিদার মা ভাত দাও।
ভাত নাই। ছোট ছেলে দুইটা ভাত চাইল ওদের ভাত দিতে পারি নাই।
মনোয়ারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আমি যাই মাছ ধরতে। যা মাছ পাই তা বাজারে বেইচা যে টাকা আসে, তা দিয়ে বাজার সদাই নিয়ে আসি। বাচ্চাদের মুখে তো খাবার দিতে হবে। এক ছড়া জাল কিনতে পারলে মাছ ধরা যেত ভালো। এইভাবে হাত দিয়ে ডুবাইয়া কত আর মাছ ধরা যায়! মনোয়ারের চার সন্তান তাদের নিয়ে অভাব-অনটনের মধ্যে কাটে দিন। মনোয়ারের মধ্যে কোন হায়-হুতাশ নেই কোনমতেই দিন পার হলেই চলে।
ভানু বলে স্বামীকে, ছেলে তিন জনকে নিয়ে তো চিন্তা করি না, মেয়েটা বিয়ের সমতুল্য হাওয়া যত চিন্তা বেড়ে গেল। ওহিদার ভালো ভালাই বিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যাই। ওহিদার চোখ একটা টেরা হওয়ায় বিয়ের সম্বন্ধও আসে না। মানুষ ভাবে চালচুলো নাই তার মেয়ের আবার কিসের বিয়ে! তাই হয়তো আমার মেয়েকে কারো চোখে পড়ে না।
ওহিদা মানুষের বাড়ি বাড়ি লাকড়ি যোগাড় করে দেয়। তাতে মানুষ খুশি হয়ে যা দেয় তাই নিয়ে বাড়ি আসে। ওহিদা ও মুখ ফুটে কোন
কিছু দাবীও করে না পরে যদি কাজে না ডাকে এই আশঙ্কায়। কারণ এক-একদিন চুলায় হাড়িও চলে না।

আদিলের চোখে পড়ে ওহিদা। আদিলের খুব মনে ধরে ওহিদাকে। আদিল বিয়ে করতে চাই ওহিদাকে। ওহিদার মতো আদিলেরও এক চোখ টেরা। তা দেখে ওহিদা একটু দ্বিমত পোষণ করে। ভানু মেয়েকে বুঝায় তাতে কি হয়েছে? যে সমস্যা ছেলের সেই সমস্যা তোরও তো আছে। বিয়ের যখন একটা ঘর এসেছে তখন তুই আর না করিস না। আদিলের সঙ্গে ওহিদার বিয়ে হয়। এরপর দু’জনে রীতিমতো সংসার করে।

মনোয়ারের মাছ ধরে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বেশি মাছের আশায় ছেলে রবিনকে তার সঙ্গে মাছ ধরতে নিয়ে যায়। রবিন মাছ ধরতে পারে ভালো। রবিনের বন্ধু নাহিদ জিজ্ঞাস করে, রবিন স্কুলে যাবি না?
রবিন বলে, স্কুলে যাইতে মন চায়। অভাবের সংসার আমি মাছ না ধরলে আমাদের খাওয়া পড়ায় খুব কষ্ট হয়। দুঃখ করে বলে, আমার আর স্কুলে যাওয়া হবে না রে।

আদিল দেখতে কালো। তা নিয়ে ওহিদার সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। তোমার মতো কালো ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছে।
আমাকে দেখেই তো তোমাকে বিয়ে দিয়েছে? আমাকে তোমার পছন্দ না। আমার এই অসুন্দর নিয়ে তোমার দিন দিন দ্বন্দ্ব আর ভালো লাগেনা। আদিল ঝামটা মেরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
ওহিদা বলে, যাও, যাও, আমার দু’চোখের সীমানা থেকে দূরে চলে যাও।
আদিল মুখ গম্ভীর করে মাঠের এক কোনে বসে থাকে। সখি তা দেখে আদিলের সামনে যায়। কি ব্যাপার আদিল ভাই তুমি এখানে বসে আছো?
অসুন্দর হলে যা হয় তাই হয়েছে আমার!
সখি বলে, তোমার জন্য আমার আফসোস হয়, বড় মায়া লাগে তোমার জন্য।
আদিল বলে, আমাকে ভালোবাসর মানুষ তো নেই। তাহলে আমার বউকে দেখাতাম আমাকেও কেউ ভালোবাসে।
সখি বলে, আমি যে তোমাকে ভালোবাসি কখনো কি তা লক্ষ্য করেছো?
তোমার ভালোবাসা যদি আমি টের পেতাম তাহলে কি তোমারে রেখে ওই দেমাগি মেয়েকে বিয়ে করতাম?
ভালো তো আমি তোমাকে বাসি। এখন তো জানলে? কি করবে তাহলে?
আদিল দু’হাত দিয়ে সখির গাল ধরে বলে, তোমাকে আমার বউ করব। তুমি করবে আমাকে বিয়ে?
যাকে ভালোবাসি তার ডাকে না সাড়া দিয়ে পারা যায়। চলো আমরা দু’জন তাহলে বিয়ে করি?
হ্যাঁ আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি। আদিল সখিকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসে।
ওহিদা সখিকে ঘরে আনা দেখে মুখ মোচড় দেয়। দেখবো দেখবো কত ভালবাসে!
আদিল আর সখির বোঝাপড়া খুব ভালো। সখি আদিলকে বলে, তুমি যে রোজগার করো তাতে তো সংসার চলে, একটু সঞ্চয় করতে গেলে সবাই মিলেমিশে রুজি করতে হয়। আমিও এখন থেকে কাজে নেমে পড়বো।
তোমার কাজ করা দরকার নেই।
তুমি আর না করো না। সংসার আমরা মিলেমিশে করব।
আদিল দেখে সখির বুদ্ধি জ্ঞান খুবই ভালো। আদিলের প্রয়োজনি জিনিস দরকার হলে সখিকে বলে।
ওহিদা দেখে যে স্বামী ছিল তার, এখন তার ভাগীদার হয়ে দাড়াইছে। ওহিদা দেখে সে এখন একা হয়ে গেছে। স্বামীর ভালোবাসা থেকে সে হয়েছে বঞ্চিত। রাগের জিদ্দে হাড়ি-পাতিল আছাড় মারে।
আদিল বলে, কি ব্যাপার তুমি এমন করছ কেন?
বুঝনা তুমি? সখিরে নিয়ে তুমি যে রং ঢং খেলায় মেতেছো তা আমার ভালো লাগেনা।
আদিল বলে, তোমার কাছে তো আমি ছিলাম অবহেলা মানুষ। অবহেলার মানুষ এখন তোমার কাছে আমার দরকার হলো বুঝি?
তোমাকে আমার প্রয়োজন হয়নি আর হবেও না। সংসারটা তো আমারও। তোমরা দু’জনে মিলেমিশে যুক্তি পরামর্শ করো, আমি যে একজন মানুষ তার কি খেল আছে?
তুমি তো তোমার মতো করে থাকতে চাও সেই ভাবেই তোমাকে থাকার সুযোগ দিয়েছি।

আদিলের ফসলের একটু জমি আছে আর মানুষের বাড়ি গরু রাখার কাজ করে। আদিলের চলে যায় কাজে। সখিও চলে যায় কাজে। বাড়িতে থাকে ওয়াহিদা আর আদিলের বৃদ্ধ মা। গ্রামের শাহিন মাতুব্বর আদিলের বাড়ির পাশের তার জমি। ক্ষেতে কাজ করা অবস্থা পানি পিপাসা নিবারণের জন্য আদিলের বাড়ি যায়। বাড়িতে ঢুকতেই শাহিনের দৃষ্টি যায় ওহিদা দিকে। শাহিন পানির উদ্দেশ্যে করে বারবার ওহিদাকে দেখার জন্য যায়।
শাহিন একদিন ওহিদার হাত ধরে বসে। ওহিদা হাত টেনে আপনি আমার হাত ধরছেন কেন?
শাহিন বলে, তোমাকে আমার ভালো লাগে। এই কথা শুনে ওহিদা একটা হাসি দেয়। শাহিন ও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।
শাহিন একদিন শাড়ি, লাল চুড়ি নিয়ে যায় ওহিদার বাড়ি।
ওহিদা তা পেয়ে বেজায় খুশি। সবার অলক্ষ্যে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। বাড়িতে কেউ না থাকায় সেই সুযোগটা কাজে লাগায়। আদিলর মা মাজেদা চলাফেরা করতে পারে না শুয়ে বসে দিন চলে। বয়সের ভারে চোখেও দেখতে পায় না। মাজেদা চোখে না দেখলে কি হবে! বাড়িতে কেউ ঢুকলে অনুমান করতে পারে। মাজেদা জিজ্ঞেস করে ওহিদাকে, বউ বাড়িতে কেউ আসছে নাকি?
ওহিদা কই, কেউ তো আসেনি।
শাহিন প্রতিদিন ওহিদার সঙ্গে দেখা করে। দু’জন এমন ভালোবাসা আবদ্ধ হয়েছে, পুরাতন সংসার তারা ভুলে নতুন সংসার করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় তাদের নিলাখেলা লোকজনের চোখে ধরা পড়ে। ওহিদার কীর্তিকলাপের কথা বাবা মনোয়ারের কানে যায়। মনোয়ার গরিব হতে পারে কিন্তু তার মান সম্মান আছে। মনোয়ার মেয়ে ওহিদাকে বলে, তুই যদি ওই মাতুব্বরের সাথে আর কথা বলিস তাহলে আমাকে বাবা বলে পরিচয় দিবি না!
ওহিদা বাবাকে বলে, ভালোবাসা কোন অপরাধ না।
স্বামীর সংসার থাকতে অন্য পুরুষের সাথে কিসের ভালোবাসা?
আমার দোষ খুঁজে পাও তুমি! আদিল যে আমাকে রেখে আরেকটা বিয়ে করেছে তা তুমি দেখনা?
সে বিয়ে করেছে তোকে তো আর ফেলাই দেয় নেই।
শাহিন মাতুব্বর আর ওহিদার মেলামেশা কেউ বন্ধ করতে পারে না। দু’জনার চক্ষুলজ্জা নেই বললেই চলে। দু’জনের একটাই কথা যে যাই বলুক তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। হয় তারা দেখবে, না হয় তারা চোখ বন্ধ করে রাখবে।

আদিল শ্বশুরের কাছে যায় তার মেয়ের অভিযোগ নিয়ে। শ্বশুরের কাছে বলে, আপনার মেয়েকে আপনি নিয়ে আসেন। তার বেহায়াপানা আর দেখা যায় না!
মেয়েটা আমার মাথা উঁচু করে কথা বলার মুখ রাখলো না। এটাই হবে আমার ওকে শেষ বোঝনা। মনোয়ার মেয়ে কাছে যায়। ওহিদাকে বলে, তোর জন্য তো এই বুড়া বয়সে আর পারি না কারো কাছে মুখ দেখাইতে। আমার সম্মানের দিকে একটু তাকা।
যে তোমার কাছে নালিশ করেছে সে কেন আমাকে রেখে বিয়ে করেছে? মান-সম্মান শুধু মেয়েদের বেলায় যায় ছেলেদের বুঝি যায় না? মেয়েকে বিয়ে দিয়েছো বিবাহিত মেয়ে উপর কেন অধিকার খাটাতে আসো?
শাহিন মাতুব্বরের তো বউ বাচ্চা আছে? তারপর সে বয়স্ক লোক!
সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে ভালোবাসে। রাখবে ভালো খাওয়াবে ভালো।
মনোয়ার বুঝে নিল মেয়েকে আর ফেরানো সম্ভব না! মন ভারি করে বাড়ি চলে আসে। এসে বউ ভানুর সঙ্গে চেঁচামেচি করে। মনোয়ার দু’দিন ধরে উপোস। ঘরে নাই চাউল,ডাল। বাচ্চারা ক্ষুধার জ্বালায় আর্তনাদ করে। রবিন তাও একটু বুঝে টুনু আর পাবনের মুখের দিকে তাকানো যায়না। বাচ্চাদের আর্তনাদ দেখে মনোয়ার রাগে আরো গর্জে ওঠে। এরই মাঝে মনোয়ারকে ডাকতে আসে শাহিন মাতুব্বার। শাহিন মাতুব্বরের ডাকে মনোয়ার যেতে চায় না। ভানু বলে, যাও ডাকছে যখন তখন শুনে আসো। মনোয়ার যায় স্ত্রীর কথা মত। পরনে লুঙ্গি, গায়ে সাদা গেঞ্জি আর ঘাড়ের গামছা নিয়ে ছুটছে। শাহিন মাতুব্বরের কাছে পৌঁছালে মনোয়ার জিজ্ঞেস করে কি জন্য আমাকে ডেকেছো?
খুশির সংবাদ দিতে চাই! আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই?
মনোয়ার বলে, ছি: ছি: ছি:।
রাগ করেন কেন? আমি খবর পেয়েছি আপনার দু’দিন ধরে চুলায় হাড়ি চলে না। আমার কাছে ওহিদাকে বিয়ে দিলে আপনার আর কষ্ট করতে হবে না। যখন যা লাগবে সবই আমি দেবো।
তোর মত পিচাশের কোন উপকার চাইনা! শাহিন মাতুব্বরের মুখের উপর থু মেরে চলে আস্তে নেয়।
শাহিন স্তম্ভিত ভাবে, কি আমার মুখের উপর থু! পিছন থেকে মনোয়ারের ঘাড়ের গামছা দিয়ে গলায় দুই হাত দিয়ে টেনে ধরে। এরপর মনোয়ার নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু শাহিনের সঙ্গে পেরে ওঠে না। শাহিন মনোয়ারার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে সেখান থেকে সরে পড়ে। ভানু স্বামী বাড়িতে আসায় দেরি হাওয়া স্বামীর জন্য অস্থির হয়ে যায়। গ্রামের লোকজন দেখে একটি লোক জঙ্গলে পড়ে আছে। দেখে গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায়। ভানু খবর পেয়ে আসে, এসে দেখে স্বামীর মৃত্যু লাশ। বলে, শাহিন মাতুব্বার বাড়ি থেকে খবর দিয়ে আনে। উনি আমার স্বামীকে মেরে ফেলছে।
লোকজন বলে, ওহিদাকে নিয়ে প্রায় প্রায় শাহিন মাতুব্বরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হতো মনোয়ারের।
ভানু ছোট দুই ছেলে কোলে নিয়ে স্বামীর লাশের পাশে কেঁদে বলে, এখন আমার বাচ্চাদের নিয়ে কি উপায় হইবো। টুনু আর পাবন বাবার গায়ের উপর উঠে কান্না করে। এমন দৃশ্য দেখে সবার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। পুলিশ খবর পেয়ে আসে। গ্রামের লোকজন সবাই বলে, আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই?
পুলিশ বলে, সময়ের কাজ সময়ের প্রেক্ষিতে চলে। কোন কিছু তার আগে করা সম্ভব নয়। আপনারা ধৈর্য ধরুন এর বিচার আপনারা পাবেন।
কিন্তু এই অসহায় পরিবারের কে নিবে দায়িত্ব কে দিবে দু’মুঠো ভাত জোগাড় করে। নাকি অনাহারে ধুকে ধুকে মরবে। ভানুর অভাব-অনটনের কাছে হার মানতে হয়। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে পারেনা। তাই সন্তানের জন্য স্বামীর হত্যার বিচার না নিয়ে শাহিন মাতুব্বার টাকার কাছে আত্মসমর্পণ করে। শাহিন মাতুব্বারও হত্যা সাজা থেকে পার পেয়ে যায়।

লেখক- সুলেখা আক্তার শান্তা

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ