আজ ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আঁধার কেটে আলো তো আসবেই-সুলেখা আক্তার শান্তা

 

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক:

দিন কিভাবে চলে যায় সংসারের কাজের ব্যস্ততার কারণে তা টের পায়না হোসনারা। স্বামী হারিয়ে সন্তানদের মা-বাবার দুই ভূমিকার দায়িত্ব পালন করছে সে একা। ঈশানা আর মাসুদ তার ছেলে-মেয়ের ইচ্ছা পড়ালেখা করে মায়ের আশা পূর্ণ করবে, পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করে মায়ের মুখে ফুটাবে হাসি।
ছেলে-মেয়ের মুখে কথা শুনে হোসনারা বুক ভরে যায়। ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, বাবা বড় হয়ে মায়ের দুঃখ দূর করবে! তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?
মাসুদ বলে, আমি বড় হয়ে ব্যাংকার হব।
ঈশানা বলে, মা আমি বড় হয়ে জজ হব।
হোসেনেরা ছেলে মেয়ের ইচ্ছা কথা জেনে খুবই উৎসাহিত হয়।
মাসুদ বলে, মা, সব মানুষের গঠন তো একি আকৃতির। তাহলে মানুষ এই কথা বলে কেন? মানুষের মত মানুষ হও!
বাবা, আকৃতিতে মানুষ হলে কি হবে! ভালো মানুষ হতে হলে ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে চলতে হবে। ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মোটকথা সব দিকেই সে ভালো কাজ করবে।
এজন্য এই কথা!
হ্যাঁ, লক্ষী সোনা বাবা।
ঈশানা বলে, মা আমি জজ হয়ে, ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের কোনো আপস করব না।
দোয়া করি তাই হও। আমার লক্ষী সোনা বাবা-মা। এবার ঘুমিয়ে পড়ো। হোসনারা দুই সন্তানকে দুই পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে, হোসনারা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঈশানা ক্লাস টেন এ পড়ে। ঈশানা স্কুলে যাওয়া আসার পথে এলাকার প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের ছেলে ইরান তাকে বিরক্ত করে।
ইরান বলে, ঈশানা আমি তোমাকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই?
আমি আপনাকে ভালোবাসি না বিয়েও করতে চাইনা!
আমি যা চাই তাই পাই, আমি তোমাকেও পাবো। আমার মতে যদি তোমার মত এক না হয় এর পরিনাম খারাপ হবে!
আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন!
যদি মনে করো তাই, তাহলে তাই।
ঈশানা স্কুল থেকে বাড়ি এসে চুপচাপ বসে থাকে।
হোসনারা মেয়ের মন খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করে, কিরে মা, তোর মন খারাপ কেন?
ঈশানা মায়ের কাছে কিছুই বলে না। ভাবে, মা চিন্তা করবে!
কিন্তু ঈশানাকে রীতিমতো বিরক্ত করেই যাচ্ছে ইরান। ঈশানা জ্বালাতন সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে মায়ের কাছে বলে।
হোসনারা বলে, এসব কথা তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন? ও চেয়ারম্যানের ছেলে হয়েছে তাতে কি হয়েছে? আমি আজি ওর বাবার কাছে বলব।
বোনের সঙ্গে এমন আচরনের কথা শুনে মাসুদও রেগে ওঠে। মা আর ছেলে একসঙ্গে যায় চেয়ারম্যান ইদ্রিসের বাড়ি, তার ছেলের অভিযোগ নিয়ে।
চেয়ারম্যানে ছেলের ব্যাপারে অভিযোগ শুনে গলা বাজিয়ে বলে, ছেলে মানুষ এরকম একটু-আধটু করতেই পারে, এগুলো ধরতে হয় নাকি!
মাসুদ উঁচু স্বরে বলে, আপনার ছেলেকে সামলান না হয় এর ফল ভালো হবে না!
কি আমাকে শাসাতে এসেছো? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে জানো?
হোসনারা বলে, চেয়ারম্যান আপনি জনগণের প্রতিনিধি আপনি পারেন না এভাবে কথা বলতে। বাবা হিসাবে আপনার উচিত ছেলেকে সামাল দেওয়া।
হয়েছে আমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না!
হোসনারা ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে আসে। এরপর থেকে হোসনারা মেয়েকে স্কুলে দিয়ে যাওয়ার আসা কাজ নিজেই করে।
ইরান বলে, ও মাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা হচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে যখন পড়েছ তখন আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে সুন্দরী অপ্সরী!
হোসনারা বলে, তুমি চেয়ারম্যানের ছেলে হও আর যাই হও এরপর থেকে এমন করলে পুলিশ ডাকবো।
তাতে কাজ হবে না বরং আপনার মেয়ে মান সম্মান যাবে! কিছুতেই ইরানের উৎপাত থামেনা, দিন দিন বেড়েই চলছে জ্বালাতন। এর মাঝেই ঈশানা এসএসসি পাস করে। হঠাৎ করে চেয়ারম্যান ইদ্রিস ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে ঈশানার জন্য।
হোসনারা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
কি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান! চোখ মুখ লাল হয়ে যায় ইদ্রিসের।
লোকজন হোসনারাকে বুঝায়। যাক তাও ভালো, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে মেয়ের জন্য। চেয়ারম্যানের ছেলে যেরকম কোন সর্বনাশও তো হতে পারে। বিয়ের কথা যখন বলছে তখন রাজি হয়ে যাও। হোসনারা ভেবে দেখে সত্যিই তো এদের সাথে টক্কর দিয়ে পারা যাবে না। তারচেয়ে মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা করি। ঈশানা বলে, মা আমি এমন ছেলেকে বিয়ে করব না। অজানা আশংকায় মায়ের বুক কাঁপে। মারে কোন দুর্ঘটনা ঘটার চেয়ে ইজ্জত মান নিয়ে বাঁচা ভালো।
ঈশানা মায়ের কথা শুনে চুপ হয়ে থাকে।
হোসনারা চেয়ারম্যান ইদ্রিসকে বলে, আপনার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি। কিন্তু মেয়েকে পড়ালেখা করতে দিতে হবে। বিয়ের পর মেয়ে আমার কাছেই থাকবে এবং পড়ালেখা শেষ হলে তারপর আপনার বাড়িতে যাবে।
চেয়ারম্যান বলে, প্রস্তাব মেনে নিলাম। ঈশানা আর ইরানের বিয়ে হয়। বিয়ের পর শর্তের কিছুই মানে না। ঈশানার পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। বাড়ির সমস্ত কাজ করানো হয় ঈশানাকে দিয়ে। ইরান বাড়িতে অন্য মেয়ে মানুষ নিয়ে আড্ডা দেয়। ঈশানা স্বামীকে কিছু বললে, ক্ষিপ্ত হয়ে মারধর করে। সদম্ভ বলে, এরকম করবো তোর সহ্য করতে হবে। শ্বশুর-শাশুড়িকে বললে, দু’জনেরই একই উত্তর, পুরুষ মানুষ এমন একটু-আধটু করেই থাকে। তোমাকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে।
আপনারা ছেলেকে আস্কারা দিয়ে খারাপ বানিয়েছেন।
শাশুড়ি জলি রাগত কন্ঠে, ছেলে মানুষ করা তোমার কাছে শিখতে হবে?
আপনার ছেলে যেমন আছে তেমনি থাক। কিন্তু আমি এখানে থাকবো না আমি বাবার বাড়ি চলে যাব। আমার পড়ালেখা বন্ধ করিয়েছেন সমস্ত কাজ করেও আমি আপনাদের মন পেলাম না! আমার এখানে থেকে কি হবে? মায়ের কাছে যেয়ে আমি পড়ালেখা করবো।
ইরানের মেয়েদের নিয়ে আড্ডা আর থামানো যাচ্ছে না।
ঈশানা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, এভাবে আর সহ্য করা যায় না। স্বামীকে বলে, তুমি এদের বাড়ি থেকে বের করবে নাকি আমি বের করব। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের চিল্লাফাল্লা দেখে ইরানের বান্ধবীরা চলে যায়। বান্ধবীদের চলে যাওয়ায় ইরান চুলের মুঠি ধরে ঈশানাকে মারধোর করে। সঙ্গে যুক্ত হয় বাবা ইদ্রিস মা জলি। ছেলের স্বাধীন ইচ্ছায় আমরা বারণ করি না তুই বলারকে? তোকে আমরা ঘরের বউ করে আনতাম নাকি! তুই দেমাগ দেখাইছিস তোর দেমাগ ভাঙার জন্য তোকে বউ করে আনা হয়েছে। সেই দেমাগ দেখানোর জ্বালা তো এখন সহ্য করতেই হবে। ইরান জোর করে মুখের মধ্যে বিষ ঢেলে দেয়। বিষের যন্ত্রণা ঈশানা বলে, আমাকে মৃত্যুর কাছে ঠেলে দিলে। যে মৃত্যুর জন্য যন্ত্রণায় আমি ছটফট করছি একদিন আমার কাঠগড়ায় তোমার বিচার হবে। সাড়াশব্দ না পেয়ে ভাবে ঈশানা মারা গেছে। ঈশানাকে চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে খাটের নিচে রেখে দেয়। চিরন্তন মায়ের মন, সন্তানের কিছু হলে মা হৃদয় দুলে ওঠে। হোসনারা সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে। হে আল্লাহ আমার তুমি দুটি সন্তান দিয়েছো। একটি সন্তানকে তুমি নিয়ে যাবে! আমার সন্তানকে তুমি আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। বিনিময় আমার জীবন তুমি নিয়ে নাও। পাশ দিয়ে একটি কবুতর উঠছে, হোসনারা কবুতর দেখে খুশি হয়ে। আল্লাহ তুমি আমার সন্তানকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছো তোমার কাছে লাখ শুকরিয়া। হোসনারা আর ছেলে মাসুদ যায় ঈশানার শ্বশুরবাড়ি। হোসনারা বলে, আমার মেয়ে কোথায়?
জলি বলে, আপনার মেয়েতো এ বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে!
মাসুদ পুরো ঘর খুঁজে কোথাও পেল না বোনকে।
ইরান বলে ঈশানা এখান থেকে চলে গেছে।
তারমধ্যে খাটের নিচ থেকে আওয়াজ আসে। ইশানা বলে, পানি পানি। হোসনারা শব্দ পেয়ে খাটের নিচে উঁকি দেয়, দেখে চাদর পেঁচানো, মাথার চুল দেখতে পেয়ে টেনে বের করে, দেখে ঈশানার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার মেয়ের এই হাল করেছে। মেয়েকে নিয়ে যেতে নেয়। ইদ্রিস চেয়ারম্যান, স্ত্রী জলি বাধা দেয়। বলে, মেয়েকে নিয়ে যেতে হলে এই কাগজে সই দিয়ে হবে। কোনো মামলা করা যাবে না। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য হোসনারা সই দিয়ে তাড়াতাড়ি মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঈশানা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। আবার পড়ালেখা শুরু করে।
ঈশানা পড়ালেখা শেষ করে জজ হয়। মাসুদ ব্যাংকে চাকরি পায়। খুব ভালো জীবন যাপন শুরু হয়। জজ হিসাবে ঈশানার খুব সুনাম হয়।
একদিন এক বৃদ্ধ লোক ঈশানার কাছে যাওয়ার জন্য খুবই কান্নাকাটি করে। পাহারাদার তাকে যেতে দেয় না ঈশানার কাছে। বিচারক আসনে বসে ঈশানা তা লক্ষ্য করে। কোট শেষে বের হবার সময় ঈশানা দেখে বৃদ্ধ লোক দরজার পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ঈশানা বলে, আপনি এখানে বসে আছেন কেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ আজিজ বলে, আমি আপনার জন্য বসে আছি।
কেন?
হাউমাউ করে কেঁদে আমি হতভাগী মেয়ের বাবা। দ্বারে দ্বারে ঘুরছি আমার মেয়ে হত্যার বিচারের জন্য কিন্তু আমি বিচার পাচ্ছিনা মাগো।
বিচার পান না!
ছেলের বাবার টাকা আর ক্ষমতার কাছে আমার সত্যি বিচার বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে।
আপনি যদি আমার মেয়ের মামলাটা দেখতে? তাহলে আমি পরম শান্তি পেতাম।
আপনি আমার বাবার মতো। আমাকে আপনি তুমি করে বলেন, আপনার বেদনার কথা শুনবো। আজিজ মেয়ে নাদিয়াকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার সমস্ত কথা খুলে বলে, জজ ঈশানের কাছে।
চমকে ওঠে ঈশানা। তার জীবনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আপনার যে প্রমাণ দিয়েছেন এগুলি যদি সত্যি হয় অবশ্যই আপনি বিচার পাবেন। ঈশানা জজের আসন ছেড়ে উকিল হয়ে নিজেই মামলায় লড়ে। বিবাদী দেখে মামলায় তার অবস্থা ভালো না। তখন ঈশানের মুখোমুখি হয়ে বলে, তুমি কত টাকা চাও? তত টাকাই আমি দেবো তোমাকে কিন্তু বিনিময়ে তোমার এই মামলা থেকে সরে যেতে হবে।
চিনতে পেরেছেন আমাকে চেয়ারম্যান সাহেব? ইদ্রিস একটু চিন্তিত। আমি ঈশানা যাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন!
ও তুমি তাহলে মরণি?
আল্লাহ যাকে রাখে মানুষ কি তাকে মারতে পারে?
ইরান বলে, দেখো আমি তোমার স্বামী তুমি এই মামলা থেকে আমাকে বাঁচাও। আমার সঙ্গে তোমার ডিভোর্স তো হয়নি?
স্ত্রী বলার ধৃষ্টতা দেখে ক্ষুব্ধ হয় ঈশানা, এত বড় পাপিষ্ঠকে ছেড়ে দিলে তো আমি ন্যায়-নীতির কাছে হেরে যাবো। একদিন বলেছিলাম আমার কাঠগড়ায় তোমার বিচার হবে। আজ তা সফল হতে যাচ্ছে! ইরান হুমকি দেয়। যদি তুমি আদালতে যেতে না পারো কিভাবে তুমি বিচার করবে? জীবনের মায়া করো?
জীবনের মায়া করি বলেই ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে চলতে চাই। আর সত্যকে সত্য বলে জানি মিথ্যাকে মিথ্যা বলে জানি। তোমার হুমকিতে আমি পরোয়া করিনা। সুবিধা করতে না পেরে বাপ-বেটার দু’জনেই চলে যায়। মামলায় বিচারের রায় ইরানের ফাঁসি কার্যকর হয়। ইদ্রিস ছেলের মৃত্যুতে পাগল হয়ে যায়। আজিজ কন্যা হত্যার বিচার পেয়ে খুশি হয়ে ঈশানাকে প্রাণ খুলে দোয়া করে। সকল কাজেই তুমি জয়ী হও মা। মেয়ে হত্যার বিচার পেয়ে যাক এইবার একটু শান্তি পেলাম। হোসনারা মেয়েকে বলে, মা তুই এবার বিয়ে কর। না মা, আমি বিয়ে করবো না। আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম দুঃখী মানুষের চোখের পানি, যদি আমার সততা ন্যায়-নিষ্ঠার বিচারে লোকজন একটু শান্তি পায় এখানেই হবে আমার পরম শান্তি। ফুটবে প্রতীক্ষার আলো।

কবি- সুলেখা আক্তার শান্তা

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ