আজ ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুলেখা আক্তার শান্তা’র-খেলাঘর

শিপন নিজেকে অনেক সুদর্শন মনে করে। ভাবে দশ বিশ জন তার কাছে কিছুই না। কিন্তু শিপনের গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ। তারপরও তার ভাবের শেষ নেই। সে সবসময় নিজেকে হিরোর মতো ফিটফাট রাখে। মাথায় চুল একটু লম্বা। নতুন শার্ট জিন্সের প্যান্ট, হাতে দামি ঘড়ি, গলায় সোনার চেইন।

চোখে ব্রান্ডের সানগ্লাস। বন্ধু নাহিদকে জিজ্ঞেস করে, আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? নাহিদ বলার ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক। খানিকক্ষণ দেখে বলে, খুব ভালো লাগছে দেখতে। বন্ধু যদি কখনো বলে, দেখতে ভালো লাগছে না। তাহলে তার বারোটা বাজিয়ে দেয়। তাই শিপনকে দেখতে ভালো না লাগলোও তাদের মুখস্ত উত্তর, ভালো লাগছে। মন্তব্য থেকে কারো নিস্তার নাই। জোর করে হলেও সে বলিয়ে ছাড়ে তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। শিপন দেখতে কালো হওয়ায় কারো দৃষ্টি কাড়তে পারে না। ব্যাপারটা সে বুঝে। সেটা নিয়ে তার মেজাজ খুব চটে থাকে।

শিপন ভাবে তাকে যে মেয়ে ভালোবাসবে, সেই মেয়েকে সে ফুল দিবে, সুন্দর সুন্দর গিফট করবে। দুজনে ভালোবাসার মিষ্টি মধুর আলাপ করবে। এমন আগ্রহী কেউ ভালবাসার ডালি নিয়ে এগিয়ে আসে না। জেসমিন এলাকার মেয়ে। জেসমিনকে শিপনের ভালো লাগে কিন্তু জেসমিন শিপনকে ভয় পায়। পারোতো পক্ষে শিপনের সমনে আসে না আড়ালে থাকে। শিপনের চোখ দুটো অনেক বড় বড়। জেসমিন তা দেখে ভয় পায়। জেসমিনের বাড়ির সামনে বন্ধু নাহিদের কাঁধে হাত রেখে শিপন বলে, আমার ময়না পাখিটাকে দেখতে পাচ্ছি না। ময়না পাখিটাকে না দেখলে বুকটা আমার শুকিয়ে যায়। নাহিদ বলে, ময়না পাখির পিছনে না ছুটে এবার কাজ কর্মে মন দে। শিপন রেগে বলে, আমাকে উপদেশ দিতে আসছিস? আমাকে কখনো উপদেশ দিবিনা। কী মনে থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে।

জেসমিন বাসা থেকে বের হয়। শিপন এগিয়ে গিয়ে বলে, ময়না পাখি শুধু তোমাকে দেখার জন্য কখন থেকে রৌদ্রে দাঁড়িয়ে আছি। জেসমিন ভয় কিছু বলে না। কী ব্যাপার ময়না পাখি তুমি কিছু বলছো না যে?
আপনাকে আমার ভয় লাগে! আপনাকে দেখলে আমার আত্মায় পানি থাকে না!
কেন তুমি আমাকে ভয় পাও? আমি বাঘ না ভাল্লুক! সবাই ভয় করলেও তুমি আমাকে ভয় করবা না।
আপনি আমাকে এরকম উৎপাত করতে থাকলে আমি বাবা-মাকে বলে দেবো।

কী বলো তুমি আমি তোমাকে উৎপাত করি? শিপন শান্ত গলায় বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। শিপন জেসমিনের পিছনে আঠার মতো লেগে থাকার কারণে জেসমিন সবসময় ভয়ে অস্বস্তিতে থাকে। সে তার বাবা মাকে বিষয়টা জানায়। উদ্বিগ্ন বাবা-মা বিষয়টি লক্ষ্য করে, দেখে শিপন মেয়েকে উৎপাত করছে। পিতামাতার চিন্তা বাড়ে। সমাধান হিসাবে ভেবে নেয় শিপনের কাছ থেকে মেয়েকে বাঁচাতে হলে একটাই উপায় মেয়েকে বিয়ে দেওয়া। হোসনারা মেয়েকে বোনের বাসায় রেখে বিয়ে দেয়। তা জেনে শিপন পাগলের মতো হয়ে যায়। শিপনের বাবা মাইনুদ্দিন ছেলের অবস্থা দেখে ছেলেকে কাজে কামে মন দিতে বলে। বলে, মেয়েরা বেকার ছেলেকে পছন্দ করে না আর তুমি তো বাদরামি করে বেড়াও।

সব কিছুরই একটা নিয়মমাফিক আছে। শিপন বাবার কথা শুনে একটি কোম্পানিতে চাকরি নেয়। কিছুদিন পর তার চাকরি আর ভালো লাগেনা। সময় বেঁধে অফিসে যাওয়া আসার নিয়মটা তার ভালো লাগে না স্বভাবের পরিপন্থী। মনে হয় বন্দি জীবন। সে ভাবে, বাবা যতদিন আছে ছেলেকে বকাঝকা দিবে, ফেলে তো দিবেনা। মাইনুদ্দিন ছেলের উশৃংখল জীবন দেখে ভাবে, ছেলেকে বিয়ে করারে সবকিছু নিয়মের মধ্যে থাকবে। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেয়। শিপনের বউ দীপা খুব নম্র ভদ্র মেয়ে। কিন্তু শিপনের এত ভালো মানুষি ভালো লাগে না। বলে, সারাক্ষণ হুতুম প্যাঁচার মতো থাকে, কথা বলতে জানে না। শিপন স্ত্রীকে বলে, আমাকে যদি স্বামী হিসেবে পেতে চাস আমি যেভাবে বলি সেভাবেই চলবি। তুই স্মার্ট মডেলের মতো চলবি।

শিপন দেখে স্ত্রী দীপা তার কথা মতো করে চলে না। সে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাসায় আড্ডাবাজি করে। সেখানে দীপাকে চা-নাস্তা নিয়ে আসতে বললে আসে না। সে দিপাকে মারধর করে। দিপাকে মর্ডান হতে বলে, শার্ট প্যান্ট পড়তে বলে, দীপা এসব কিছুই করে না। শিপন বলে, আমার দরকার মডেল বউ। আমার মন মতো না চললে বাপের বাড়ি চলে যা। মাইনুদ্দিন ছেলেকে কোন ভাবেই বউ নির্যাতন থেকে ফেরাতে পারে না। শিপন একদিন খেতে বসে দেখে তরকারিতে একটু লবণ বেশি হয়েছে। খাবারের পেলেট ছুড়ে মারে দীপার গায়ে। রান্না করতে বসে কই মন রাখিস? শিপন রাগে বেসামাল হয়ে দীপার শাড়ির আঁচল দীপার গলায় পেচিয়ে সজোরে টান মার। দীপা আচমকা আঘাতে ধরাশায়ী হয়। প্রাণবায়ু বেরিয়ে লুটিয়ে পড়ে।

শিপন ঘটনার আকস্মিকতা সামলে নিজের স্থির করে ফেলে। চিৎকার করে বলতে থাকে, দীপা তুমি কেন চলে গেলা! আমি তো তোমাকে কোন কষ্টতে রাখিনি। তুমি কেন গলায় ফাঁসি দিলা। আমি আমার এত সুন্দর লক্ষী বউটাকে হারালাম। দীপার বাবা মা ছুটে আসে। মেয়ের মৃত্যুতে তারা হতবিহবল। কৌশলী শিপন তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। আমি আপনার মেয়েকে কত ভালবেসেছি। কেন দীপা গলায় ফাঁসি দিয়ে চলে গেল! কিসের অভাব ছিল ওর। আপনারা মেয়ের জন্য মামলা করবেন? করতে পারেন। কিন্তু তাতে আপনার মেয়ের আত্মা কী শান্তি পাবে? আপনার মেয়ে সঙ্গে করে কিছুই নিয়ে যেতে পারবে না। পুলিশ ওর পোস্টমর্টেম করাবে। কাটা ছেঁড়ায় শরীরের কিছুই সে নিয়ে যেতে পারবে না। এবার ভেবে দেখেন আপনারা কী করবেন? তোফায়েল আহমেদ আর মনোয়ারা ভেবে দেখে জামাই যা বলেছে ঠিকই তো বলেছে। তারা বলেন, না আমরা মামলা করব না। শিপন বলে, মামলা করতে পারেন যেখানে যা করার দরকার আমি সবই করে দেবো।

মনোয়ারা কেঁদে বলেন, আমরা মামলা করব কিসের জন্য? যেখানে আমার মেয়ের জামাই এত ভালো মানুষ। সেখানে আমাদের মামলা করার কোন দরকার নেই। আর আমার মেয়েটার শরীর কাটা ছেঁড়া হবে এটা আমি সহ্য করতে পারবো না! মেয়েকে মাটি দিয়ে তোফায়েল আহমেদ আর মনোয়ারা নিজেদের বাড়ি চলে যায়।

শিপন একদিন শ্বশুর বাড়িতে অনেক কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে হাজির হয়। তোফায়েল আহমেদ আর মনোয়ারা বলেন, বাবা তুমি এত কিছু নিয়ে আসছো কেন?

শিপন বলে, আপনার মেয়ে নাই তাতে কী? আপনারা তো আমাকে ধুয়ে মুছে দেননি। আমি আমার শ্বশুর বাড়ি আসব, বেড়াবো। আসা যাওয়া না থাকলে কী আত্মীয়ের সম্পর্ক থাকে? আমি আপনার মেয়েকে কত সুখে রেখেছিলাম। সুখ ফেলে দীপা আত্মহত্যা করে চলে গেল। মনোয়ার বিষন্ন শিপনের দিকে তাকিয়ে বলেন, যাক বাবা তুমি এসব নিয়ে দুঃখ করো না।
মা দিপার জন্য আমার আত্মাটা জ্বলে পুড়ে যায়। আপনাদের সান্তনায় বড় শান্তি পাই। শিপন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, দীপা তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলা?

মনোয়ারা বলেন, জামাইটা আমার বড় ভালো মানুষ। আমার মেয়ে মারা যাওয়া জামাই আমার কেমন হয়ে গেছে। জামাইকে আদর যত্ন করে, রান্নাবান্না করে খেতে দেয়।
শিপন বলে, না মা, আমি খাব না। আমার অন্তরে খাওয়া আসেনা।
শ্বশুর শাশুড়ির জন্য যে রাজ্যের বাজার আনছো তা তুমি একটু খেয়ে গেলে মনে আমরা শান্তি পাবো না।
মা আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম?
কী বলবা বাবা বলো?

এই পথে আসা যাওয়ার জন্য সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চাইছিলাম।
বাবা মেয়ে নাই তাতে কী তুমি আমাদের বাড়ি আসবা যাবা।
যাতে আসতে পারি সেই ব্যবস্থা আমি করতে চাচ্ছি। আপনার ছোট মেয়ে নিপাকে আমি বিয়ে করতে চাই।
কী বলো বাবা নিপা তো অনেক ছোট!

মা মেয়ে মানুষ বড় হতে কদিন লাগে! আর আমাকে তো আপনারা চেনেনই ও আমার কাছে থাকবে আদর যত্নে। আমি ওকে স্কুলে দিয়ে আসব নিয়ে আসব।
নিপা একথা শুনে বলে, না মা এ প্রস্তাবে তুমি রাজি হইয়ো না। সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি কলেজে ভর্তি হব পড়ালেখা করব।

শিপন বলে, মেয়েরা পড়ালেখা করলেও চুলার কাজে থাকতে হয় না পড়লেও চুলার কাজ থাকতে হয়। তুমি আমার কাছে থেকেই পড়ালেখা করবা। শিপনের বিয়ের প্রস্তাবে তোফায়েল আহমেদ আর মনোয়ার মেয়ে নিপাকে বিয়ে দিতে রাজি হয়। নিপা আর শিপনের বিয়ে হয়।

শিপনের বাবা মইনুদ্দিন ছেলেকে বলেন, এখন তুই তোর সংসারের হাল ধর। আমি তোকে দোকান করে দিচ্ছি তুই ব্যবসা-বাণিজ্য কর। মইনুদ্দিন ছেলেকে দোকান করে দেয়। শিপন দোকানে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ একদিন শিপন দেখে নিপা কলেজের একটি ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। নিপাকে ধরে বাসায় এনে নিজের ইচ্ছা মতো মারে। বই খাতা ছিড়ে বলে, তোর আর পড়তে হবে না, আজ থেকে তোর কলেজে যাওয়া বন্ধ। নিপা মার খেয়েও কলেজ বন্ধ করে না। শিপনের মনে তাতে আগুন জ্বলে, ভাবে, না জানি কলেজের কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক করে। নিপা কলেজ থেকে ফিরে এলে শিপন বলে, তুই আমার কথা শুনছিস না কেন? নিপাকে জাপটে ধরে পায়ে রগ কেটে দেয়।

নিপা ব্যথায় চিৎকার করে, তা দেখে শিপন আনন্দ পায়। বলে, তুই এবার কলেজে যাবি? যা। তোর বোন আমার কথা শুনতো না তাই ওকে আমি মেরে ফেলছি! নিপা ভয় পায়। বড় বোনের মৃত্যু নিয়ে তার সন্দেহ সত্য হয়। ভাবে না জানি তাকেও মেরে ফেলে। বলে, তোর এই মুখোশধারী মুখ সবার কাছে আমি খোলাসা করে দেবো। তাহলে তুই তো এপারে থাকতে পারবি না তোকেও যেতে হবে ওইপারে। নিপার শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরছে। সে দুর্বলতার কারণে দাঁড়াতে পারে না। কোনভাবে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। বাবা মার কাছে সব কথা বলে। নিপা পুলিশের কাছে বোনকে হত্যার কথা জানায়। তদন্তে শিপনের অপরাধ প্রমাণিত হয়। বিচারে তার সাজা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নিপা শিপনের কাছ থেকে রক্ষা পেয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বন্দী জীবন থেকে সে মুক্ত।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ