আজ ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুলেখা আক্তার শান্তার ছোটগল্প-পিতা পুত্র

সেলিনার বিয়ে হয় রফিকের সঙ্গে। বিয়ের সময় কথাবার্তা সবকিছু পাকা করে নিয়েছে। সেলিনার ছেলে রাহুলের দায়িত্ব নিতে হবে। রফিক তা মেনে নেয়। সেলিনার প্রথম স্বামী ছেলে রাহুলের জন্মের আগেই মারা যায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে সেলিনা বাবা-মার কাছেই থাকে। সেলিনা বিয়ে করতে চায়নি। ছেলেকে নিয়েই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সেলিনার বাবা-মায়ের মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। ছোট ছেলেকে নিয়ে কিভাবে পাড়ি দিবে জীবন! এছাড়া রয়েছে সমাজ। স্বামীহীন নারীর সীমাহীন বিপত্তি। স্বামী ছাড়া একা চলতে গেলে নানা জনে নানা কথা বলে জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলবে। সব ভেবে সেলিনার বাবা-মা মেয়েকে বিয়ের জন্য রাজি করায় এবং বিয়ে দেয়। নাতিটার জন্য দুশ্চিন্তা ছিল। তারা মারা গেলে কি হবে! সবকিছুর সুষ্ঠু সমাধান করতে পেরে সুস্থির হয় তারা।
রফিক স্নেহপ্রবন মানুষ। রাহুলকে নিজ সন্তানের মতো ভালবাসে। সেলিনা স্বামীর প্রতি খুব কৃতজ্ঞ। রাহুল রফিককে বাবা বলে ডাকে। বাবা ছেলের চলাফেরায় কখনো বুঝা যায় না তাদের রক্তের সম্পর্ক এক না। রফিক পুকুর ঘাটে গোসল করতে গেলে রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। একসঙ্গে খাবে, একসঙ্গে ঘুমাবে। সন্তানের প্রতি এমন দায়িত্ববোধ দেখে সেলিনা আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করে, আল্লাহ তুমি বাবা ছেলের এমন বন্ধন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বজায় রেখো।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রফিক স্ত্রীকে ডাকে, কই ওঠো বেলা হয়েছে। ডাকে কোন সাড়া পায় না। রফিক ধরে দেখে তার স্ত্রী আর জীবিত নেই। ঘুমের মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে। সুখ যেন কপালে আর সইলো না সেলিনার। রফিক ছেলেকে ধরে কাঁদে, বাবা একি হলো! বাপ ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
সেলিনার দাফন কাফন শেষ হয়। বাপ ছেলে দু’জনে ঘরের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে উদাস ভাবে বসে থাকে। সেলিনার বাবা-মা খুব ভেঙ্গে পড়ে। তারা রাহুল আর রফিককে বলেন, তোমরা আমাদের বাড়ি চলো। এখানে থাকলে তোমাদের খারাপ লাগবে। রফিক বলে, না মা আমি কোথাও যাবো না। নাতিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। রাহুল বলে, না নানি আমি বাবাকে রেখে যাব না। আনোয়ারা আর আজিজ বাড়ি ফিরে যায়।
বাবা ছেলে সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকে। বাবা রান্না করে ছেলে পাশে বসে জোগাড় দেয়। এভাবে কি সংসার চলে! লোকজন বুঝায় রফিককে, বিয়ে কর তাহলে আর সংসারে এই রকম ঝামেলা পোহাতে হবে না। মেয়ে মানুষের কাজ কি ছেলে মানুষের দ্বারা হয়? এই যে রান্নাবান্না নিজেদের করে খেতে হয়। পাড়া প্রতিবেশীকে রফিক বলে, তোমরা তো আমাকে বুঝাও বিয়ের জন্য, আমি বিয়ে করলে আমার ছেলেটার কি উপায় হবে? উত্তর আসে, ছেলেটা তোর নিজের না। তার জন্য তুই নিজের বিয়ের ঠেকাইয়া রাখবি?
রফিক মুখ গোমড়া করে, তোমরা এতক্ষণ যে যা বলছো ভালো বলছো আর কিছু বোলো না। আমার ভালো তোমাদের দেখতে হবে না। আর কখনো বলবা না রাহুল আমার নিজের ছেলে না। প্রতিবেশীরা বলে, তোর অল্প বয়স, আমরা যা বলি তোর ভালোর জন্যই বলি। তোর নাই নিজের সন্তান। নিজের সন্তান ছাড়া পরের সন্তান দিয়ে সুখ করা যায়? রফিক বিরক্ত হয়ে বলে, যাও যাও সবাই বাড়ি যাও। যা বলছো ভালোই বলছ। নিজের ভালো বোকাও বোঝে আর তুই কেন তোর ভালো বুঝস না! রফিক আর কথা না বাড়াইয়া মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসে।
আনোয়ারা নাতি আর জামাইকে দেখতে আসে। এসে দেখে বাড়ি ঘর অগোছালো। জামাইকে রান্না করতে দেখে মনে তার খুব কষ্ট হয়। সে রফিককে বুঝায়, এভাবে কি সংসার চলে? বুঝেশুনিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করায়। রফিক শেফালীকে বিয়ে করে। বিয়ের পর রাহুলকে সামনে এনে রফিক বলে, এই আমার ছেলে এরে কোনদিন উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখবা না। নিজের ছেলের মতো লালন পালন করবা। আমার ছেলে যদি হাজার অন্যায় করে তাকে কিছু বলতে পারবা না। তোমাকে আমি ছোট করছি না। তোমাদের সাধ আহ্লাদের মধ্যেই আমার জীবনের আনন্দ। তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো। শেফালি বলে, আপনি যেভাবে চান সেভাবেই চলবে সবকিছু। আপনি যেমন সকলের ভালো চান। আমাদেরও তেমনি আপনার ভালো চাওয়া উচিত। রফিক আবার বলে, রাহুলকে তোমার নিজের ছেলে মনে করবা। শেফালি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। রফিকের সঙ্গে শেফালির বিয়ে দিতে পেরে নিশ্চিন্ত আনোয়ারা। সে বলে, আমার সন্তান নাই কে বলে! তুমিই আমার সন্তান। তোমার মাঝেই যেন আমার সেলিনার ছায়া পাই। রাহুলকে বলে, নানুভাই তুমি চলো আমার সঙ্গে। কয়েকটা দিন বেড়াইয়া আইসো।
নানি তুমি তো জানো আমি বাবাকে ছাড়া থাকতে পারিনা, রাহুলের আপত্তি।
ঠিক আছে নানুভাই থাকো।
রফিক যা কিছু করে ছেলেকে নিয়ে করে। শেফালি একদিন মৃদু আপত্তি জানায়। বলে, খাওয়া-দাওয়া ওঠাবসা সব ছেলেকে নিয়ে। তাহলে আমি আছি কি করতে?
কি হলো তোমার?
আমাকে দেখার সময় আছে তোমার। ছেলে ছাড়া তো কিছুই বোঝনা।
হঠাৎ রাহুল খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে রাহুলের একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। রফিকের আকাশ ভেঙে পড়ে। ডাক্তারকে বলে, আমার কিডনি পরীক্ষা করে দেখেন। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে দুইজনের কিডনি ম্যাচ হয়। রফিক কিডনি দেয় রাহুলকে। রাহুল সুস্থ হয়। তা দেখে রফিক আনন্দিত। রফিকের কিডনি দানের কথা তখন বউকে না জানালেও কিছুদিন পর জেনে যায়। রাহুলের প্রতি রফিকের অতিরিক্ত স্নেহ শেফালিকে ক্রমেই ক্ষুব্ধ করে তোলে। সুযোগ পেলেই সে এর প্রতিবাদ জানায়। এই সংসারের আমি কি কেউ? আমার কি কোন মূল্য আছে? আমারে আনছে দাসি গিরি করতে।
রফিক বউকে বুঝায় তুমি খামোখা এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।
আমি বাড়াবাড়ি করি?
চোখের সামনে আমি বাবা বেঁচে থাকতে। সন্তানের কিছু একটা হোক এটা কি কোন বাবা চায়?
এক গাছের আঠা আরেক গাছে কখনো লাগে না। পরের সন্তানকে নিজের সন্তান বলেই নিজের হয় না।
রাহুলকে আমি জন্ম দেই নাই ঠিকই কিন্তু কখনো ভাবি না ও আমার নিজের সন্তান না।
নানা, নানি আছে ওকে তাদের কাছে দিয়ে দাও।
রফিক আহত হয়ে বলে, এ কথা বলোনা।
রাহুল শেফালিকে মা বলে ডাকে। তাতে শেফালির মন ভেজেনা। এই ছেলে বাপ খাইছে, মা খাইছে, এখন আবার না জানি কারে খায়। রাহুল কোন কথার প্রতি উত্তর করে না। সে জানে তার বাবা তাকে খুব ভালোবাসে। সে আর কারো ভালোবাসা চায় না।
শেফালি সন্তান সম্ভবা। তার যমজ ছেলে মেয়ে হয়। ছেলে নাম রাখা হয় রাতুল আর মেয়ের নাম রাখা নুপুর। ছেলে মেয়েকে সামাল দিতে গিয়ে সংসারে কাজকর্ম করতে পারে না। রাহুল এগিয়ে আসে বলে, মা আপনার কাজ করতে হবে না। রাতুল আর নুপুর রাহুলের লালন পালনেই বেড়ে ওঠে।
রফিকের বয়স হয়েছে সে এখন আর কাজকর্ম করতে পারে না। রাহুল সংসারের খরচ চালায়। রাহুল মেট্রিক পাস করছে এরপর আর পড়ালেখা করতে পারেনি। একটা ডিলার কোম্পানিতে চাকরি করে। রাহুল কোন ব্যাপারে হতাশ হয় না, নানা, নানি ছিল তারাও পরকালে চলে গেছেন। এখন আপন বলতে তার বাবা একমাত্র আপন। রাতুল আর নুপুর এখন বুঝতে শিখেছে। কে আপন কে পর। জন্মের পর ভালো-মন্দ বোঝার পর থেকেই মার কাছে শুনে এসেছে রাহুল তারা আপন ভাই না। সবসময় দেখে আসছে মা বড় ভাই রাহুলকে বকাঝকা করে। কিন্তু দেখতো বাবা তাদের চেয়ে রাহুলকে খুব ভালোবাসে। অসুস্থ রফিক বিছানায় শুয়ে কাশতে কাশতে বলে, বাবা রাহুল সংসারের জন্য আর কম করলি না। এবার বিয়ে কর। নিজে সংসারী হ। রাহুলে কথা, বাবা আমি বিয়ে করলে এই সংসারের কি হবে?
তা নিয়ে তুই ভাবিস না। হইবেই এক ব্যবস্থা।
শেফালির রাগের কন্ঠে বলে, বিয়ে করলে সংসার চলবে কিভাবে? যাকে বিয়ে করতে বলছো তার জন্য নিজের জীবন কইরা রাখছে তো পঙ্গু! যদি এই কিডনি না দিতা তোমার শরিরের এই অবস্থা হইত? এখন থাকো বিছনায় পইড়া।
রফিক বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলে, ছেলেটার সঙ্গে এরকম কইরো না। ছেলেটা যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকে সংসারে হাল টানতাছে। যে যাই বলুক আমি আমার ছেলেকে বিয়ে করাবই। রফিক ভাবে পৃথিবীতে রাহুলের আপন বলতে কেউ নাই। বিয়ে হলে একজন সঙ্গী হবে। সুখের সংসার হবে। একটা পাত্রীর খোঁজ করে বিয়ে দিয়ে দেয়। রাহুলের বউ দীপাকে একদম সহ্য করতে পারে না শেফালি। দীপাও কম না শাশুড়ি কিছু বললে, মুখের উপর কথা শুনিয়ে দেয়। রাহুল বলে দিপাকে, আমার মাকে কখনো কিছু বলো না যাতে সে মনে কষ্ট পায়।
তুমি যাকে মা বলো সে তোমাকে ছেলে ভাবে কিনা সেটা একবার ভেবে দেখেছো?
আমার কোন কিছু দেখতে জানতে হবে না।
শেফালি অহংকারের সুরে বলে, দু’দিনেই স্বামীর বাড়ি এসে স্বামীওলী হয়ে গেছে। স্বামীকে খাওয়াইছে পড়াইছে কে? জায়গা দিছে কে? সেইটা তো আর দেখেনা। দীপাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার স্বামীর এটা নিজের বাপ দাদার বাড়ি না। হুশ করে কথা বলো!
রাহুল দিপাকে থামিয়ে মাকে বলে, আমাকে তোমরা পর ভেবো না আমি তোমাদের আপন বলেই জানি।
তোর বউ আসতে না আসতেই কি বলে শুনিস না তার কথা!
রফিক শেফালিকে বলে সংসারে যদি শান্তি চাও আর কথা বাড়িও না।
শেফালির ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। ছেলেকে বিয়ে করেছে। শেফালির সংসার এখন আর রাহুল নির্ভর না। রাহুলকে আলাদা করে দেয়। রাহুল অসুস্থ হয়ে কয়েক মাস বিছনায় পড়া। সংসার আর চলে না। শেফালি বকবক করে। সেই পুরনো কথা। জন্মের আগে বাবারে খাইছে, তারপর মাকে খাইছে, নানা, নানি খাইছে। এখন না জানি ওর কারণে কার কি অবস্থা হয়! একটা পাপী। পাপে নিজেও পুইড়া মরে অন্যকেও পুরাইয়া মারে।
দীপা সহ্য না করতে পেরে ঘরে থেকে বের হয়ে। আপনি কখন থেকে আমার স্বামীকে পাপী বলেই যাচ্ছেন! আমার স্বামী কি পাপ করছে? আপনি কি পাপী না?
শেফালি পুরো বাড়ি মাথায় করে তুলে। আমার ছেলে রাতুল আসুক। এর একটা বোঝাপড়া হবে। আমার বাড়ি থাইকা আমাকেই বলে পাপী!
আপনার ছেলেকে আমি ভয় পাই নাকি? দেখি আপনার ছেলে এসে কি করে?
রফিক দীপাকে ডাকে, বৌমা এদিকে আসো। তুমি তোমার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলোনা। ওর সঙ্গে কথা বলে পারবা না।
শেফালি স্বামীর উপর চেতে উঠে, এই বুড়ায় আবার কয় কি? বুড়া সবসময় ওই ছেলে আর ছেলের বউয়ের পক্ষ হইয়া কথা কয়! শেফালি হাত ঝুলিয়ে বলে, আমার বাড়িতে কেউ থাকতে পারবেনা। যার যেখানে জায়গা আছে সেখানে চলে যাক। এইখানে আর না।
দীপা কাঁদতে কাঁদতে বলে, হ্যাঁ এইখানে আর না। এত জ্বালা এত অপমান আর সহ্য হয় না।
রাহুল বলে দীপাকে, তুমি মায়ের কথা রাগ করো কেন? বাবা তো আর আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেনি।
শেফালি চিৎকার করে রাহুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ও আমি বলছি তাতে হয় না। ওই বুড়া বাড়ি থেকে তোমাদের যাইতে বলবে কখনো? বুড়ারে তো যাদু করছো। তোমাগো কোন দোষ অন্যায় তার চোখে পড়ে না।
রাহুল অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছনা থেকে উঠে বসে। মা তোমারে কোনদিন অসম্মান করছি? তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনদিন কথা বলি নাই। আমার কে আছে, তোমরাই তো আমার সব।
শেফালি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ওই মিষ্টি কথা আর বলতে হবে না। বুড়ারে জাদুটোনা করছো, এখন আমারে এসে জাদু-টোনা করতে। যদি ভালো চাও বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।
রাহুল কি এক ভাগ্য নিয়ে এসেছিল পৃথিবীতে বাড়ি ছেড়ে যাবে কি সে-ই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। স্বামীর মৃত্যুতে দীপা স্বামীকে জড়িয়ে কান্নাকাটি করে। রফিক বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। বাবা তোকে আমার বাড়িতে এনেছিলাম ঠিকই কিন্তু তোকে শান্তিতে রাখতে পারলাম না। পরকালে ভালো থাকিস বাবা।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ