আজ ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অনুভবে ঈদ-সুলেখা আক্তার শান্তা

 

পুরো বাড়িতে প্রাণবন্ত হইচই। এ যেন বাড়িতে কোন আনন্দের দিনক্ষণ। এমন প্রতিদিনই। এ বাড়িটা যেন মাতিয়ে রাখে
অর্ক, আবির, দীপা, দোলা, মলি, নাদিম, রনি, অর্পা। এদের কারণে বাড়িতে বুঝা যায় প্রতিদিনই আনন্দঘন দিন। বাড়িটি
বেশ বড় মানুষেও বেশ ভরপুর। বলা যায় গ্রামের মধ্যে এটি একটি বড় বাড়ি। সবার সঙ্গে সবাই খুব আনুকূল্য। অর্ক,
আবির, দীপা, দোলা, মলি, নাদিম, রনি, অর্পা এদের কারণে পুকুর হোক, বা খাল সব জায়গাতেই তাদের অবাধ
পদচারণা। যখন সবাই একত্র হয়ে পুকুরে গোসল করতে নামে পুরো পুকুর জুড়ে থাকে তারা। তাদের দাপাদাপিতে পুরো
পুকুরের পানি ঘোলাটে হয়ে যায়। পুকুরে রাখা আছে দীর্ঘ লম্বা বাঁশ, কলাগাছ। তার উপরে উঠে লাফালাফি করে, সাঁতার
কাটে। নানান দস্যি পনায় যোগ দেয় সবাই। বাড়ির গুরুজনরা পুকুর থেকে ওঠার জন্য শত চেষ্টা করেও কাজ হয় না।
জমির ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধানে ভরপুর বাড়ি। সবাই কাজকর্ম সেরে পুকুরে যায় গোসল করতে। পোলাপানের জ্বালায়
তারা গোসলে ছাড় পায় না। কারণ তারা পানি ঘোলাটে করে রাখে। বাড়ির মুরুব্বী আঙ্গুরী। তাকে ভয় পায়না বাড়ির
এমন কোন মানুষ নাই। আঙ্গুরীকে দেখে সবাই পুকুরে থেকে উঠে দৌড়ে পালায়। পুরো বাড়িটা আঙ্গুরীর দাপটেই চলে।
গ্রামে যে কোন ফসল জিরাতের সময় দই, মিষ্টির বিক্রেতা মন্টুর আগমন ঘটে। সে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যাবে বাখারি
কাঁধে করে। অনেক ওজনের কাঁধের দুইপাশে দুই বোঝা টেনে। শরীরে তার বেশ শক্তিও ছিল, বোঝাটা টানা তার জন্য
কোন ব্যাপার ছিল না। কেউ জিজ্ঞেস করে, ও মন্টু এই দই, মিষ্টি, ছানার হাড়ি এগুলো ওজন তো অনেক তুমি টানো
কিভাবে! ভারী কন্ঠে বলেন মন্টু, এটা আমার জন্য কোন ব্যাপার না! অভ্যাস হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই কাঁধে বাখারি
নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরি। পোলাপান দেখলে মন্টু আদর করে জিজ্ঞাসা করে, দই, মিষ্টি, সন্দেশ খাবি? মন্টুর ছানা খুব
নামকরা। কেউ একবার খেলে বার বার খেতে চায়। মন্টু পোলাপানদের হাত পাততে বলেন। চামচে ছানা তুলে সবার
হাতে একটু করে দিয়ে লোভ লাগায়। খেয়ে দেখ কেমন লাগে! মন্টু বাচ্চাদের শিখিয়ে দেয়, মাকে ডেকে নিয়ে আয়। যা
মায়ের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি কর! মন্টু ভঙ্গিমা সুরে বলেন, বাড়িতে বাড়িতে নতুন ধান উঠেছে। নতুন ধানের বেশ গন্ধ।
ধানের বদলে দই, মিষ্টি। সবাই মার কাছে এসে কান্না শুরু করে, মা দই, ছানা খাব। মা ও সন্তানের বায়না মিটাতে প্রস্তুত।
নতুন ধান আছে উঠানে তা থেকে কুলা ভরে ধান এনে দেয় মন্টুকে। তার বদলে মন্টু তাদের দই, মিষ্টি, ছানা যে যেইটা
নেয় তাকে সেটাই দেয়। সবাই মন্টুর ঝাঁকার পাশে বসেই আনন্দ উল্লাস করে খেতে থাকে। বাচ্চাদের সঙ্গে বাড়ির বউঝি,
মেয়ে এমনকি গুরুজনরাও যোগ দেয় তাতে। বাড়ির বড় কোন অনুষ্ঠান ছাড়াও এসবও ছিল আনন্দে ভরপুর উপলক্ষ।
রোজার মাস পড়ে গেছে, সবাই কাজকাম নিয়ে ব্যস্ত, অর্পা মাকে বলে, মা আমি রোজা রাখব। অবাক হয়ে রাফিয়া বলেন,
না মা তোমার রোজা রাখতে হবে না। রোজা রাখার বয়স তোমার এখনও হয়নি। অর্পা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। দেখে
কান্নাকাটিতে কোন কাজ হচ্ছে না। তখন এক বুদ্ধি করে। মায়ের আঁচলের সঙ্গে নিজের জামা গিরো দিয়ে রাখে। মা সেহরি
খেতে উঠলে টান লাগলে সেও সেহরি খেতে উঠতে পারবে। ব্যাপারটা অর্পার পরিকল্পনা মাফিক হয় না। মা ঘুম থেকে
উঠতে গিয়ে দেখে মেয়ে জামার সঙ্গে তারপর পরনের কাপড় গিরো দিয়ে রেখেছে। ব্যাপারটা দেখে মনে মনে হাসে। গভীর
ঘুমে অচেতন অর্পার মাথায় হাত বুলিয়ে গিরো খুলে উঠে সেহরি খাওয়া শেষ করেন রাফিয়া। সকালে অর্পা ঘুম থেকে উঠে
দেখে তার মা তাকে সেহরি খেতে ডাকেনি। তার সঙ্গীরা কেউ কেউ বলে রোজা রেখেছে, তা শুনে অর্পার মনটা আরো
খারাপ হয়। অভিমানে সে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে মাটিতে গড়াগড়ি শুরু করে। আবির, দীপা, দোলা বলে,
কান্দিস না কাল রোজা রাখিস। আজকের রোজাটা তো চলে গেল। সবার থেকে আমি পিছিয়ে পড়লাম না? রাফিয়া
মেয়েকে বুঝায় ঠিক আছে মা কালকে তুমি রোজা রেখো।‌ মেয়েকে অনেক বুঝটুঝ দিয়ে শান্ত করেন।
রোজার মাস স্কুল ছুটি তাই সবার হাতে অনেক সময়। সবাই মিলে কলাপাতা, তালপাতা দিয়ে ছোট ঘর বানায়। একত্রে
ঘর কন্যা, পুতুল বিয়ে, রান্নাবাড়ি খেলে। বাচ্চাদের সবার পরনে বিভিন্ন কালারের প্যান্ট গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। দেখতে
চমৎকার লাগে। অনেকক্ষণ খেলার পর মায়েদের ডাক শুনতে পায়। কইরে সবাই, খেতে আয়। ডাক শুনে সবাই খেলা
ছেড়ে উঠে পড়ে। উচ্চস্বরে মায়েদের জানিয়ে দেয় গোসল করে আসি তারপর খাব। সবাই মিলে দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে

পুকুরে। পুকুরে একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটায়। খুব হাসি উল্লাস হয়। পুকুরে গোসল করার সময় আরো মজা হয়
তার মাঝে হঠাৎ করে বৃষ্টি আসায়। পুকুরে বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ পানিতে সবাই ডুব দেয়।
হঠাৎ বৃষ্টি আসায় বাড়ির কাজ বাড়িয়ে দেয়। বাড়ির সবাই ধান, যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আঙ্গুরী বলে উঠে,
মরার বৃষ্টি আর সময় পাইলো না। তৎক্ষণে বৃষ্টি আবার থেকে যায়, থেমে তো গেলি বৃষ্টি মাঝখান থেকে সবাইরে কষ্ট
করালি! বাড়িতে কোন কিছু হলে আঙ্গুরী খুব চিল্লাচিল্লা করে। বাড়ির মেয়ে, বউ-ঝিরা সবাই কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। কাজে
সবাই পারদর্শী, কেউ কারো চেয়ে কম না। তারপরও আঙ্গুরী উৎকণ্ঠে বলেন, তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে কাজ করো। তার
চেঁচামেচিতে একটা জমজমাট ভাব হয় বাড়িতে। সে চিল্লাচিল্লা যাই করুক বাড়ির সবাই তাঁকে মান্য করে।


অর্পা রোজা রাখে। রোজা রাখার বয়স না হলেও বায়না ধরার জন্য তাকে রোজা রাখতে দিতে হয়। রাফিয়া মেয়ের ক্লান্ত
মুখ দেখে বুঝতে পারে মেয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। মায়ের মন, মেয়েকে সে ভিন্ন কথা বলে কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করে। মা তুমি
দুপুর বেলা ভাত খাবা, আবার সন্ধ্যাবেলা আমাদের সঙ্গে ইফতারি করবা দেখবা তাহলে তোমার একদিনে দুইটা রোজা
হয়েছে। অর্পা কথাটা বুঝে উঠতে না পারলেও এটুকু বোঝে সবার হবে একটা রোজা তার হবে দুইটা রোজা! মায়ের
কথামতো দুপুরে ভাত খায়। সঙ্গীদের সঙ্গে বলে, আমার আজকে দুইটা রোজা হবে! অর্পার দেখা দেখি অর্ক, আবির, দীপা,
দোলা, মলি, নাদিম, রনি তারাও তাই করে।
এক এক করে রোজা প্রায় শেষের দিকে সপ্তাহখানেক আছে ঈদের বাকি। স্বাধীন অর্পার বাবা, মেয়েকে নিয়ে হাটে যায়।
মেয়ের চোখে যেটাই ভালো লাগে তাকে তাই কিনে দেন। জামা কাপড়ের পর হাতের চুড়ি, ফিতা, লিপিস্টিক, টিপ,
নেলপালিশ, কাজল, মাথার ক্যাপ, জুতা আরো যা লাগে তার সবই কেনা হয়। স্বাধীন সেই সঙ্গে ঈদের বাজারঘাটও করে
নিয়ে আসেন। সবার জামাকাপড় নিয়ে হৈ চৈ নতুন জামা বানানো হয়েছে। দর্জির কাছ থেকে জামা আনা হয়েছে। বাড়িতে
জামা দেখা দেখির পালা, কার জামা কত সুন্দর হয়েছে। অর্পার জামা লুকিয়ে রাখে কাউকে সে দেখতে দেয় না। ‌দেখতে
চাইলে বলে, দর্জির কাছে থেকে জামা এখনো আনা হয়নি, আশঙ্কা কেউ দেখে ফেলে। যদি আবার তার মতো সেরকম জামা
কেউ বানিয়ে ফেলে। বাড়ির সঙ্গীদের সবার চেয়ে অর্পার জামাটাই বেশি সুন্দর হয়।
ঈদের কয়দিন আগে থেকেই রাফিয়ার ব্যস্ততার শেষ নাই। ঘর দুয়ার ঝাড়া পোছা। ঘর মাটি দিয়ে লেপা। গোবর দিয়ে
উঠান আঙ্গিনা লেপে ঝকঝকে করা। সব বাড়িতেই এসব কাজের ব্যস্ততা। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা নিয়ে
সবার আকুলতা। অর্ক, আবির, দীপা, দোলা, মলি, নাদিম, রনি, অর্পা সবাই একত্রে উঠানে দাঁড়ায় আকাশে চাঁদ দেখতে।
কে আগে চাঁদ দেখতে পাবে তাই নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। কিন্তু চাঁদের দেখা মেলে না। চাঁদ ওঠেনি অর্থাৎ আগামীকাল ঈদ
হচ্ছে না। সামান্য আশাভঙ্গ হলেও তার মাঝেই আনন্দ। পরদিন পশ্চিম আকাশ জুড়ে দৃশ্যমান হয় ঈদের চাঁদ। সবাই চাঁদ
দেখে যে যার মতো উল্লাস প্রকাশ করে। কেউ হাত তুলে আঙ্গুল দিয়ে চাঁদ দেখেয়া। বাচ্চাদের কাল কাকলিতে মুখর হয়ে
ওঠে পরিবেশ। চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে। আগামীকালের ঈদের স্বপ্ন নিয়ে সবাই ঘুমাতে যায়।
ঈদের দিন। রাফিয়া আযানের সময় উঠে নামাজ সেরে উঠান বাড়ি ঘর ঝাড়ু দিয়ে মাটির চুলা লেপে শুরু করে ঈদের
রান্না। শিন্নি, সেমাই, খিচুড়ি রান্না শেষ করে। শুরু করে দুপুরে রান্নার আয়োজন। মাংস পোলাও রান্না হবে। বাড়ির পুরুষ
সদস্যরা সবাই গোসল সারে। নতুন জামা পড়ে ঈদগাহ মাঠে যায় নামাজ পড়তে। রাফিয়ার সবার আগে রান্না হয়ে যায়।
নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে কেউ কেউ মিষ্টিমুখ করে যায়। পুরুষ সদস্যরা নামাজ পড়তে গেলে শুরু হয় বাচ্চাদের
সাজগোজ। অর্পাকে তার মা গোসল করিয়ে নতুন জামা পরিয়ে দেয়। সঙ্গীরা সবাই নতুন জামা পড়ে এ বাড়ি ও বাড়ি
ঘুরেফিরে বেড়ানো। সঙ্গে থাকে মিষ্টি মিষ্টান্ন খাওয়া। বাড়তি পাওনা থাকে আত্মীয়-স্বজন বাবা-মা দেওয়া সালামি। অর্পা
ও সঙ্গিদের ঈদ অনেক হাসিখুশিতে কাটে।


অর্পা বড় হয়েছে। তার পড়া লেখা শেষ করেছে। আবির অর্ক, নাদিম, রনি বিয়ে করেছে। দীপা, দোলা, মলিরও বিয়ে
হয়েছে। স্বাধীন মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র দেখছে। ঘটককে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। ঘটকপাত্র পেয়ে যায়। দুই
পরিবারের কথা এক হওয়ায় বিয়ে হয়ে যায়। ‌অর্পা স্বামী পল্লবকে নিয়ে বেশ সুখে আছে। এখন সে এক ছেলে এক মেয়ের
মা। ঈদ আসলে সংসারের কাজ, স্বামী বাচ্চাদের কেনাকাটা, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ভাসুর, ননদ, জাল, পরিবারের
সবাইকে কিভাবে ভালো রাখা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ঈদের রাতের ভোর হতেই শুরু হয় কাজ করা শেষ হয় ঘুমাতে
যাওয়ার আগে। এখন অর্পার জীবনে অনেক ঈদ আসে অনেক ঈদ যায়, কিন্তু ছোটবেলার ঈদের মতো সেই আনন্দ পায়

না।‌ বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পর সংসার ব্যস্ততার কারণে ঈদ আর আগের মতো উপভোগ করা হয়ে ওঠে না। সেই শৈশবে স্বল্প
টাকায় কেনা জামা যে সুখ ছিল আজ অনেক টাকার দামী গহনা কাপড় পরলেও সেই সুখ পায় না। দুচোখ কল্পনার সীমানা
ছাড়িয়ে চলে যায় সেই শৈশব সঙ্গীদের কাছে। তাদের কথা মনে পড়ে। পুতুল খেলা, তালপাতা, কলাপাতা দিয়ে ঘর
বানানো। বৃষ্টিতে, পুকুরে খেলা, গোসল করা, ঈদের জামা কাপড় নিয়ে দুষ্টামি। এ বাড়ি ও বাড়ি যাওয়া। উদাস করা
শৈশব স্মৃতি এখনো তাকে আটকে রেখেছে। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের বাবার বাড়ি আর আপন থাকে না। বিয়ের পর
কারো হয়তো কয়েকটা ঈদ বাবার বাড়ি যাওয়া আসা হয়। ‌তাও হয়তো সব ঈদে না। বাবার বাড়ির শৈশব কি যে মধুময়
দিন তা আর ফিরে পাবার নয়।
ঈদের মধুর স্মৃতি সবার কাছে আজীবন সঞ্চিত রোমাঞ্চকর এক আলেখ্য বাল্যকালের স্মৃতির ভান্ডার। অনন্তকাল ধরে সেই
অনুভূতি বিমূর্ত হয়ে আজও অম্লান।‌

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ