আজ ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৭ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মন কাঁদে-সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক:পরিশ্রমী মেয়ে সাথী। মহিলা পুরুষের গতানুগতিক অসমতার ধারণা সে মানতে নারাজ। কাজে ভেদাভেদের বিভক্ত দেখতে চায় না। সে কাজকে কাজ হিসেবে দেখে। তার কথা, ছেলে হোক মেয়ে হোক কাজ করার সামর্থ্য উভয়েরই আছে। নারী জীবনের বাস্তবতা শুরুতেই সে বুঝতে পারে। সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষায় অপরিহার্য নারী। সীমাহীন আত্ম উৎসর্গের পর বিস্ময়করভাবে সমাজ সংসার তাদের জীবন করে রেখেছে অস্থিতিশীল। নারীর পায়ের নিচে মাটি নেই, নিজের কোন বাড়ি নেই। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, অন্তিম সময় ছেলের বাড়িতে পার হয়ে যায় তাদের জীবন। সাথী পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে উদ্যোগী হয়। নিজের সামর্থ্য আর যেটুকু দক্ষতা আছে তাই কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। সাথীর রান্নার হাত খুব ভালো। সেটুকু অবলম্বন করে সে কাজে লেগে যায়। একটা খাবারের রেস্টুরেন্ট শুরু করে। প্রথমে কিছুদিন মন্দা গেলেও দিনে দিনে ব্যবসায় ভালো পসার ঘটে। পুরো পরিবারের দায়িত্ব বহনে সক্ষম হয়ে ওঠে সে। তার উপার্জিত টাকা খরচ হয়ে যায় তাতে তার আফসোস নেই পরিবার সুখে শান্তিতে আছে তাতেই তার স্বস্তি।
একদিন পাশের ফ্ল্যাটে কান্নাকাটির শব্দ শুনতে পায় সাথী। সেখানে গিয়ে দেখে পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটি কাঁদছে। সাথী জানতে চায় ছেলেটি কাঁদছে কেন? ছেলেটির মা বলেন, অভাব অনটনের সংসার সন্তানের কোন কিছুই পূর্ণ করতে পারিনা। ছেলেটি আমার পড়ালেখা করতে চায়। সেই সামর্থ্য আমাদের নাই। অভাবের সংসার, যেখানে দুবেলা ভাত জোটে না সেখানে পড়ালেখা করাবো কিভাবে! উচ্ছল প্রাণবন্ত ছেলেটি। সাথী ছেলেটিকে আগেও লক্ষ্য করেছে।
তুমি পড়ালেখা করতে চাও? সাথী জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ।
ঠিক আছে পড়ালেখা করাবো।
ছেলেটি যেন আশ্বাস পায়। আপনি আমাকে পড়ালেখা করাবেন?
হ্যাঁ। তুমি যত দূর পড়ালেখা করতে চাও আমি তোমাকে পড়ালেখা করাবো। তোমার খরচ বহন করবো আমি আর পড়ালেখা করবা তুমি। আজ থেকে তোমার সমস্ত দায়িত্ব আমার। তুমি আমার আরেকটা ছোট ভাই। মুহূর্তে অচিন্তনীয় সমাধান সাধিত হলো। জাহানারার বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি বলেন, মা সত্যি তুমি আমার ছেলের দায়িত্ব নিতে চাও?
হ্যাঁ আজ থেকে ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার। জাহানারা বলেন, মা তুমি অবিবাহিত মেয়ে, এখন তো তোমারই জীবন গড়ার সময়। তার ওপর তুমি ওর দায়িত্ব নিবা? খালাম্মা আপনি এ নিয়ে ভাববেন না। আজ থেকে রুবেল আমার কাছে থাকবে। সাথী রুবেলকে বাসায় নিয়ে আসে। মানুষের আবেগ এবং চেতনা অনেক সময় তাকে সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে উদ্বুদ্ধ করে। পরিতৃপ্ত হয় অসাধ্য সাধন করে। রুবেলকে কাপড়-চোপড়সহ যা যা প্রয়োজন সমস্ত কিছু কিনে দেয়। রুবেল পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়। কখনো রেস্টুরেন্টে গেলে সাথী বলে ভাইয়া তুমি বাসায় যাও পড়ালেখা করো। আপু তুমি এখানে কাজে কত ব্যস্ত থাকো আমি তোমার একটু সাহায্য করি? না ভাই, আমার কোন কাজ করতে হবে না আমি একাই সব সামলাতে পারি।
সময়ের স্রোতে এগিয়ে চলে। সাথী এক এক করে বোনদের বিয়ে দেয়। রুবেল লেখাপড়া শেষ করে একটা কিছু করতে চায়। সাথী বলে, ভাই তুমি দেখো কী করতে চাও। যদি ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাও সেটাও ভেবে দেখো। রুবেল বলে, ঠিক আছে আপু কদিন ভেবে দেখি কী করলে ভালো হয়। একদিন দোকান থেকে ফিরতে সাথীর অনেক রাত হয়ে যায়। কিছু বখাটে ছেলে তাকে উত্যক্ত করতে থাকে। তাদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সেই সময় নাদিম গাড়ি নিয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। জটলা দেখতে পেয়ে পরিস্থিতি বুঝতে পারে। সামনে এগিয়ে গিয়ে সাথীকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। দ্রুত ঘটে যাওয়া উদ্ধার পর্বটিতে সাথী চমকৃত হয়। বলে, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো। মহা সর্বনাশ এর হাত থেকে বাঁচালেন আমাকে। সময় মতো আপনি না এলে কী যে হতো। এরকম ঘটনা ছবিতে বহুবার দেখেছি, এটা যে বাস্তবে আমার জীবনে ঘটবে সেটা ভাবি নি। নাদিম বলে, ঠিক আছে আপনি শান্ত হোন। আমি আপনাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। সাথীকে বাসায় নামিয়ে দেয় নাদিম। যথারীতি দু’জনের ফোন নাম্বার বিনিময় হয়। এরপর নাদিম তথা রীতি সাথীকে ফোন দেয়। দু’জন কথা বলে দীর্ঘ সময়। নাদিম দেখা করার আবদার জানায়। সাথীও রাজি হয়ে যায়। দু’জনের দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে। প্রেমের নদীতে বান ডাকে। নাদিম বলে, সাথী তোমাকে আমার জীবনসঙ্গী করতে চাই। সাথী কিছু বলে না। কিছু বলছো না যে? ঠিক আছে, কয়েকটা দিন যাক তারপর আমার মতামত জানাবো। কয়েকটা দিন কেন? এখন জানানো যায় না? সাথী হেসে বলে, এত তাড়াহুড়ো কিসের? সাথী, আমার যে মত সেই মতের সঙ্গে তোমার মত এক হলে আমার ভালো লাগতো। নাদিম তোমার মতই আমার মত, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
নাদিম সাথীকে বলে, চলো আমরা বিয়ে করি। সাথী বলে, বিয়ে করবো একটু সময় দাও। আমার কিছু দায়িত্ব অসম্পূর্ণ রয়েছে। রুবেলকে একটা ব্যবসা-বাণিজ্য ধরিয়ে দেই তারপর। বিয়ে করেও তো সেই দায়িত্ব পালন করতে পারো। সাথী বলে, আমি আমার পারিবারিক দায়িত্ব তোমার সংসারে যাওয়ার আগে শেষ করে যেতে চাই।
নাদিম জানতে পারে রুবেল সাথীর আপন ভাই না। এটা জেনে সাথীকে জিজ্ঞেস করে, রুবেল তো তোমার আপন ভাই না তাহলে কেন ওকে নিয়ে একসঙ্গে থাকছো? নাদিমের প্রশ্নে ক্ষুন্ন হয় সাথী। বলে, তোমার এ কথায় আমি অবাক হলাম। ভালোবাসার মানুষের প্রতি যদি অটল বিশ্বাস না থাকে তাহলে তাকে নিয়ে ঘর সংসার করবে কিভাবে? রুবেল তোমার নিজের মায়ের পেটের ভাই না তার জন্য তুমি এত কিছু করবা কেন? নাদিম এ কথা তুমি বলোনা রুবেল আমার ভাই না। এ কথা আমাকে আহত করে। ও আমার ভাই, ওকে ছোটবেলা থেকে আমি লালন-পালন করেছি। নাদিমের মনে সন্দেহ জাগে। তারা একই বাসায় থাকে, না জানি তাদের মধ্যে সম্পর্ক কী রূপ নিয়েছে। নাদিমের কথায় তার মনোভাব প্রকাশ পায়। সাথীর সহ্য হয় না সে কথা। বলে, ঠিক আছে তোমার যদি আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক করো না। নাদিম বলে, আমি তো বলিনি তোমার সাথে সম্পর্ক করবো না। আমি ওই ছেলেটাকে সহ্য করতে পারছি না তাই বললাম। তুমি ওকে বাসা থেকে বিদায় করো। সাথী বলে, না নাদিম আমি এ কাজ করতে পারবো না। পৃথিবীতে রক্ত দিয়ে সব সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমি আমার ভাইকে তাড়াতে পারবো না। এতে যদি তুমি থাকো, থাকো, আর না হয় চলে যেতে পারো। নাদিম বলে, একটা বাইরের ছেলের জন্য তুমি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাও! সাথী বলে, সম্পর্ক আমি নষ্ট করতে চাইনি সম্পর্ক নষ্ট করতে চাচ্ছ তুমি। কারণ তোমার ভেতর সন্দেহ রোগ ঢুকে গেছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না।
নাদিম এবং সাথীর যোগাযোগ বন্ধ। সাথী খুবই ভেঙে পড়ে, কান্নাকাটি করে নাদিমের জন্য। রুবেল তা লক্ষ্য করে। রুবেল ভাবে আমাকে নিয়ে এত দ্বন্দ্ব আপু আর নাদিম ভাইয়ের সঙ্গে। ঠিক আছে আমি এখানে আর থাকবো না। রুবেল চলে যায় সাথীকে না বলে। যাওয়ার সময় একটি চিঠি লিখে যায়।
প্রিয় আপু
তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। এ জনমে তোমার আর আমার দেখা হবে না। আমি জানি আপু তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না আর আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। কষ্ট হবে তারপরও মেনে নিতে হবে। সময়ের পরিস্থিতির জন্য। আপু তুমি আমাকে তোমার স্নেহের ছায়ায় লালন পালন করেছ। কোনদিন বুঝতে পারিনি এক মিনিটের জন্য তুমি আমার আপন বোন না। আপু যেখানেই থাকি তুমি থাকবা আমার অন্তরজুড়ে। তোমাকে ভুলতে পারবো না কোনদিন। তোমার আর নাদিম ভাইয়ের বিয়ের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। আমি নিজেই তোমাদের ওখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। তোমাদের মাঝে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। তুমি আপু নাদিম ভাইকে ভুল বুঝনা। তার মনে আমাকে নিয়ে যে সন্দেহ বাসা বেধেছে তা সে প্রকাশ করেছে। তুমি নাদিম ভাইকে বিয়ে করে সুখী হও। আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য দোয়া করি, তিনি যেন তোমাদের ভালো রাখেন। ভালো থাকো আপু, ভালো থাকো আপু।
ইতি
তোমার স্নেহের ছোট ভাই রুবেল।
চিঠিটি পড়ে আর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। ভাই তুই কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। তোকে লালন পালন করেছি কি তোর চলে যাওয়ার জন্য। সাথী অনেক খোঁজাখুঁজি করে রুবেলকে কোথাও পায়না। নাদিম অনুতপ্ত হয় সাথীর কাছে। সাথী তুমি আমাকে ভুল বুঝনা। আমার মাথা ঠিক ছিল না। তাই ভুল সন্দেহ করেছি তোমাকে নিয়ে। তোমাদের ভাই বোনের সম্পর্ক ভাগ হয়ে গেল আমার কারণে। রুবেলকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে নাদিম তাকে কোথাও খুঁজে পায় না। সে অনুশোচনায় ভোগে। কালের প্রবাহে কত কথা কত স্মৃতি ম্লান হয়ে আসে। নাদিম আর সাথী দু’জনে বিয়ে করে সংসারী হয়। রুবেলের কথা মনে পড়ে সাথীর। ভাই তোর জন্য মন কাঁদে। যেখানে থাকিস ভালো থাকিস ভাই। ভালো থাকিস ভাই।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ