Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
রক্তাক্ত বীর-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

রক্তাক্ত বীর-সুলেখা আক্তার শান্তা

কাজকাম বাদ দিয়া হাঁটতে থাকি এই মাথা থাইকা ওই মাথা। আমার ছেলেরে খুঁজি। ছেলেটা আমারে শান্তি দিলো না। একটা মাত্র ছেলে আমার। আল্লাহর কাছে কাঁদাকাটি কইরা চাইয়া আনছি। কী আর কমু দুঃখের কথা। বিয়া হইয়া স্বামীর বাড়ি আসার পর কেউ আমার মুখটা পর্যন্ত দেখে নাই। বাপের বাড়ি থিকা স্বামীর বাড়ি পর্যন্ত মানুষ। বাড়ির বাইর হই নাই কোন সময়। এখন বাইর হইতে হয় ছেলেটার লাইগা। এপাড়ার ওপাড়ার কেউ আমারে চিনতে বাকি রাখে নাই। সবাই আমারে চেনে পাগলের মা বইলা! তাতে আমার কোন আফসোস নাই।

রাহেলা বলেন নুরনাহারকে, তোমার কথা আমরা তোমার আড়ালে বলি। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেরে বুকে জড়াইয়া স্বামীর ভিটায় রইলা। বাপের বাড়ির মানুষ নিয়ে যাইতে চাইলো, বিয়া দিতে চাইল, তার কিছুই করলা না। ছেলেটারে মাইনা নিয়া কতজনে বিয়া করতে চাইলো তাও করলা না।
নুরনাহার বলেন, ভাবলাম, বিয়ার আগে মুখে যাই বলুক পরে যদি পোলাটারে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, তয় মনে দুঃখ পাইব।
মনে কত চিন্তা তোমার। ছেলেটারে নিয়াও তোমার কোন ভবিষ্যৎ দেখি না! পাগল ছেলে তোমার। যাক সেই কথা আর কইতে চাই না তোমার আবার বুক ফাইটা যায়।
নুরনাহার রাহেলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে, কোন কথা বলে না।
রাহেলা বলেন, এইভাবে তাকায়ে আছ কেন?
নুরনাহার বলেন, কী কমু কওনে মতোন কী কিছু আছে? যাই বু, পোলাটারে খুঁজি। ছেলেটারে খোঁজাখুঁজিতে সারাদিন পার হইয়া যায়। নুরনাহার কথার মাঝেই দেখে ছেলে আবিদ মাথায় এক বোঝা ঘাস নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বাবা তুমি ঘাস মাথা নিছস কেন?
আবিদ বলে, ঘাস আমাগো গরু খাইবো।
বাবা আমাগো তো গরু নাই। কিসে খাইবে এই ঘাস!
মা গরু কিনবা।
আরে আমার ছেলে কয় কী! গরু কিনবো পালবে কে?
আমি পালবো।
বাবা তোমার পিছে সারাদিন ছুটতে ছুটতে যায় আমার। আর গরু পালবা তুমি?
আবিদ নাছোড়বান্দ বায়না তার গরু চাই ই চাই। নুরনাহার ছেলেকে এত বুঝায় তাতে কাজ হয় না। ছেলে খাওয়া বন্ধ করে দেয়, গরু কিনে না দিলে খাবে না। না খেয়ে ছেলে তার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মা হয়ে ছেলের কষ্ট সহ্য হয়না। ছেলেকে বলেন, বাবা ভাত খাও তোমাকে গরু কিনে দেবো।
আবিদের দাবি আগে আমার গরু কিনে দাও তারপর ভাত খাব। ছেলেকে নিয়ে তার পছন্দের গরু কিনে দিলে তারপর ভাত খায়। গরু আনার পর থেকে আবিদ সারাক্ষণ গরুর পিছনেই কাটায়। রাতে ঘুমাইতে যাওয়ার আগে গরু দেখে তারপর ঘুমাতে যায়। ভোর হওয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠে গরুর কাছে যায়। নুরনাহার ছেলের কান্ড দেখে হতাশ। ছেলেকে বলেন, বাবা গরুর পিছনে এত লেগে থাকার দরকার নেই।
আবিদ বলে, গরুর কাছে না থাকলে কখন ঘাস খাবে কখন পানি খাবে বুঝবো কী ভাবে?
বাবা গরুর জন্য যখন যা দরকার তখন তা আমি করে দেবো।
মা তুমি এসব পারবা না।
আমি পারবো না তুমি পারবা?
আমি পারবো বলেই তো আমি করি।
নুরনাহার ছেলের কান্ড দেখা হাসে।

আবির শখ করে গরুর নাম রেখেছে বীর। অবলা জন্তু ভালোবাসা বোঝে। বীর বলে ডাকলে, গরু হাম্বা বলে সাড়া দেয়! আবিদ একটু দূরে থাকলে দেখা মাত্রই গরু তার কাছে দৌড়ে ছুটে আসে। গরুর প্রভু ভক্তির প্রকাশ দেখে অনেকেই অবাক হয়!
আবিদের স্বভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছে গরুর কারণে। যে পাগলামি করে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াত সে গরু পেয়ে অনেক শান্ত হয়েছে। এখন আর সে পাগলামি করে না। তা দেখে চাচা জয়নাল হিংসায় মরে। সে চাইতো আবিদ পাগল আছে পাগল হয়েই থাক। দেখে এখন ঘটছে তার বিপরীত ঘটনা। আবিদকে কী করা যায় সেই চিন্তা করে।
আবিদের চাচা জয়নাল একদিন দেখতে পায় তার মরিচ ক্ষেতের পাশে বাঁধা আবিদের গরু। সে দ্রুত সুযোগটা কাজে লাগায়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে, হায় হায়রে আমার সব মরিচ গাছ খেয়ে ফেলল গরুতে। গরুটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে বেঁধে রাখে উঠানে। বিনা অপরাধে শাস্তি গরুটা হয়তো বুঝতে পারে। হাম্বা হাম্বা বলে ডাকতে থাকে করুন আর্তনাদে। ডাক শুনে সবার মায়া হবে। আবিদ ছুটে যায়। শুনে বীরকে তার চাচা খোয়াড়ে আটকিয়ে রেখেছে, চাচার কাছে যেয়ে বলে, আপনি আমার বীরকে খোয়াড়ে রেখেছেন কেন?
তোর গরু আমার মরিচ ক্ষেত খাইছে।
অবোলা পশু ক্ষেতে মুখ দিতে পারে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়া বড় কথা বলতে নাই এরা বোবা জিনিস। তারপরও আমি আমার গরু নিয়ে বলতে পারি আমার গরু এরকম কাজ করে না। আমার গরু আপনার ক্ষেত খায় নাই। ঠিক আছে আপনার ক্ষেতের যদি কিছু ক্ষতি হয়ে থাকে আমি আপনারে ক্ষতিপূরণ দেবো। চলেন ক্ষেতে যাই দেখি আপনার ক্ষেত কতটা খাইছে আমার বীর। আবিদ মরিচ ক্ষেতের কাছে যায়। দেখে ক্ষেতের কোন ফসল বীর নষ্ট করে নাই। যেমন ক্ষেত তেমন আছে। আমার বীর আপনার কোন কিছু নষ্ট করে নাই। বীরকে ছাইড়া দেন।
জয়নাল ভেঙ্গিয়ে বলে, গরু তার নাম রাখছে আবার বীর! না, গরু ছাড়া যাবে না।
ছাড়া যাবে না মানে, আমার গুরু আমি নিয়ে যাচ্ছি। আবিদ গরুর দড়ি খুলে। জয়নাল ছুটে এসে আবিদকে ধাক্কা দেয়। আবিদ ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তখন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বীর জয়নালকে শিং দিয়ে গুতা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে থাকে বীর। বীর এক পা জয়নালের বুকের উপর তুলে দিয়ে মাথার শিং দিয়ে ঠেসে ধরে আছে। আতঙ্কিত জয়নাল মিনতি করতে থাকে। বাবা আবিদ আমারে বাঁচা। তোর গরু তুই নিয়ে যা। আবিদ চেষ্টা করেও বীরের আক্রোশ থামাতে পারে না। শেষে অনেক চেষ্টায় বীরকে নিবৃত করে বীরকে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। আবিদের মা নুরনাহার রাগত কন্ঠে বলেন, এই বীর বীর কইরা তুই মানুষের সাথে একটা ঝগড়াঝাঁটি বাজাবি।
আবিদ বলে, মা আমি কী কারো সাথে ঝগড়া করতে যাই? চাচা আমার বীরকে নিয়ে আটকাইল ক্যান?
তোর চাচাতো তোর চাচাই। সে কোন দিন তোদের ভালো চাইছে?
আমিও ছাইড়া দিমু না।
কোন কিছু করার কাম নাই। তুই নিজেরটা নিজে বুঝে চল। তাতেই চলবে।

গরুটা এতই ভালো সবাই গরুটাকে ভাগ্য লক্ষী বলে। বীর আসার পর আবিদের আশ্চর্য জনক পরিবর্তন হয়েছে। কোথাও ছুটে যায় না, এখন আর পাগলামিও নাই, বেশ ধীর স্থির হয়েছে। বীরটা ওর অবস্থাও ভালো করে দিয়েছে। একটা গরুতে আবিদের আরো দুইটা গরু হয়েছে। আবিরের চাচা প্রতিহিংসায় মরে যায়। আবিদের জীবনে ঘটে যায় মর্মান্তিক এক ঘটনা। জয়নাল এক রাতে বীরকে জবাই করে ওদের ঘরের সামনে ফেলে যায়। সকালে বীরের ঘরে দেখা যায় ছোট দুই বীর আছে বড় বীর নাই। বীরের রক্তাক্ত গলাকাটা অবস্থায় দেখে আবিদ মা বলে চিৎকার দিয়ে ওইখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
নুরনাহার আকস্মিক এই ঘটনায় চিৎকার করে পাড়া প্রতিবেশী জড় করে। কে কোথায় আছো দেখে যাও কী সর্বনাশ হইল আমার। সবাই আবিদের মাথায় পানি দেয়। আবিদের জ্ঞান ফেরে। অনেকক্ষন র্নিবাক বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। বীরের ঘর থেকে একটা লাঠি নিয়ে চাচার বাড়ী যায়। কিছু বুঝার আগেই চাচার মাথায় দেয় একটা বাড়ি। জয়নাল মাথায় হাত দিয়ে রক্ত দেখে চিৎকার করে উঠে। একি করলি তুই! আমার গায়ে হাত তুললি? আমি তোর নামে মামলা করব। চাচী জলি চিৎকার করে বলে, আমার স্বামীরে খুন করছে তোমরা দেখে যাও। স্বামীকে বলে, তুমি এখনো কেন বসে আছো, তাড়াতাড়ি যাইয়া মামলা করো।
নুরনাহার এসে দেখে ছেলে কাঁদছে। তার দেবর যাবে ছেলের নামে মামলা করতে। সে মিনতি করে জয়নাল ভাই ওতো তোমার ভাইয়ের ছেলে। রাগের মাথায় ভুল করছে। অরে মাপ কইরা দাও।
জলি বলে, না এই ভুলের ক্ষমা নাই। স্বামীকে বলে তুমি তাড়াতাড়ি যাইয়া মামলা করো। জয়নাল চলে যায় মামলা করতে। সে মামলা করে বাড়িতে পুলিশ নিয়ে আসে। নুরনাহার পুলিশ দেখে ছেলেকে বলেন, বাবা তুই পালা। বীরের শোকে আবিদ তখন চেতনাহীন। মা কী বলছে সে কথা কানে ঢুকে না তার। শুধু বিড় বিড় করে বলতে থাকে, আমার বীর কই? আবিদের হাতে পুলিশ হ্যান্ডকাপ পড়ায়। নুরনাহার জয়নালের পাঁ জড়িয়ে ধরে। ভাই জয়নাল তোমার তো তেমন একটা কিছু হয় নাই। চিকিৎসায় যা লাগে আমি সমস্ত খরচ বহন করবো। তুমি আমার ছেলেটাকে ছেড়ে দাও। আমার পাগল ছেলেটা কেমন করে দেখো, ওর কোন দিক বিক নাই।
পুলিশ আবিদকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে, মা আমার বীরের গোস্তো কোন কিছুই করবা না। আমার বীরকে মাটি দেবা। বীরের গায়ে হাত দিয়ে আবিদ চিৎকার করে বলে, বীররে তোরে ছাড়া আমি এই পৃথিবীতে ভালো থাকবো না। পুলিশের সঙ্গে আবিদ যাওয়ার সময় সবাই বুঝতে পারে আবিদ আবার পাগল হয়ে গেছে। তার মাথা ঠিক নেই। আবিদ যাওয়ার সময় পাগলামি করতে করতে যায়। আর অপলক দৃষ্টিতে বীরের দিকে মায়ের দিকে তাকায়। পশুর চেষ্টায় মানুষ ভালো হলেও মানুষের পশুত্ব শেষ হয়না।