Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
সুলেখা আক্তার শান্তার ছোটগল্প “অনন্ত সমাপ্তি” – Pratidin Sangbad

সুলেখা আক্তার শান্তার ছোটগল্প “অনন্ত সমাপ্তি”

সুলেখা আক্তার শান্তা:বেলা কই গেছে এখনো ঘুম থেকে উঠে না, কিরে মা ঘুম থেকে ওঠ। খাওন দাওন নাই তবুও শরীরে একখান হইছে আমার! মোটা শরীর নড়াচড়া খুব কষ্ট। কোন কাজ দৌড়ে দাপড়ে করতে পারিনা এই শরীর লইয়া। গরিব মানুষ নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সবকিছু লইয়া হিসাবের মধ্যে দিন কাটে। অসুস্থ স্বামীকে চিকিৎসা করাব তাও পারিনা। সম্বল বলতে কিছুই নাই। কারো উপর ভরসা করুম এমন কেউ নাই। তুলির মা আপন মনে কথাগুলো বলছিলেন। বিছানায় শুয়ে আসাদ মিয়া তাগাদা দেন। কিগো তুলির মা, আমারে খাওন দাও। রুনা গোবর দিয়ে উঠান লেপা দিচ্ছিল। বেলা বাড়ার আগে শেষ করতে চায় কাজটা। কলসের পানি, গোবর, ঝাড়ুর নাড়ায় ঢেউ আয়ত্তে রাখতে চান। গোবর পানি যেদিকে যায় রুনা ও ঝাড়ু নিয়ে সেই দিকে ছুটেন। এর মধ্যেই স্বামীর কথার জবাব দেন। এইতো কাজ শেষ হইছে, আসছি। কাজ শেষ করে হাত পা ধুয়ে রুনা ভাত নিয়ে স্বামীর কাছে যান। শুধু ভাত দেখে আসাদ মিয়া বলেন, ভাত আনছো? কী আর আনব ভাত, কাঁচামরিচ, পিঁয়াজ। দেও তাই খাই। কপালে যা জোটে তাইতো খাইতে হইবে। ভালো খাইতে পারলাম কী পারলাম না এটা নিয়ে আমি আফসোস করি না। তুলিরে ডাক দাও ও আমার সাথে খাইয়া যাক। রুনা মেয়েকে ডাকেন, তুলি মা আয় তোর বাবা ডাকে। এক সাথে বইসা খাইয়ে নে। তুলি এসে বাবার সাথে খেতে বসে। বাবার সাথে খেতে বসা তুলির ছোটবেলার অভ্যাস। বাবা সেই অভ্যাসটি সযত্নে বহাল রেখেছেন। বাবা তুমি আমারে ছাড়া খাও না কেন? তোরে ছাড়া যে আমার খাইতে ভালো লাগে না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তুলির মা তুমিও খাও আমাগো সঙ্গে। রুনা ইতস্তত করেন। পাতিলে আর ভাত নাই এটা বুঝতে দিতে চান না। স্বামীকে বুঝ দিতে বলেন, বাপ বেটি খেয়ে নেন আমি পরে খাবো। বুঝছি তুমি খাইতে চাও না কেন? ভাত নাই। বিষাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রুনা হেসে দেন। হইছে আর ওস্তাদি করতে হইব না। খাওয়া শেষে আসাদ মিয়া পান মুখে দেন। তখনই মাহিয়া এসে হাজির। চাচা কেমন আছেন? এইতো মা ভালো, বসো। মাহিয়া দূর সম্পর্কের ভাতিজি হলেও নৈকট্য আপনের চেয়ে বেশি। বিয়ে হয়েছে ঢাকায়, সচ্ছল পরিবারের। আদরে ভালোবাসায় ভালই আছে। রুনা জিজ্ঞেস করলেন, মা তুমি আসলে কবে? আমার আসা, যখন মন চায় তখনই চইলা আসি। রুনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। খাওন পরনে কোনো দিক দিয়া কোন কিছুর কমতি নাই। একটা দিকে আল্লাহ মুখ তুলে চাইলে সোনায় সোহাগা হইতো। মাহিয়ার হাস্যজ্জল মুখের হাসি দপ করে নিভে যায়। হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে চেহারায়। এখনো তার সন্তানাদি হয়নি! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাহিয়া। হ্যাঁ চাচি সন্তান সন্তান কইরা তো আর কম করলাম না। আল্লাহ এখনো সন্তানের মুখ দেখাইলো না। সন্তানের জন্য সে অস্থির। কোথাও তার ভালো লাগেনা। যখন যেখানে মন চায় ছুটে ছুটে বেড়ায়। নারীর একাকীত্ব কোনদিন কেউ বোঝেনি আর বুঝবেও না। পুরুষের সংসার আছে তারপরেও আছে স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণের বহির্জগৎ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারী জীবনের সঙ্গী অন্তঃপুরবাসিনী একাকীত্বের গভীর নিঃসঙ্গতা। বিয়ের পর স্ত্রী হয়ে ওঠে সংসারের অংশ আর দশটা জড়ো বস্তুর মতো। যেমন ঘরে থাকা আসবাবপত্রকে প্রতিদিন যত্ন না করলেও সেটা সংসারেরই থাকবে। স্ত্রী হলো সেই রকম যত্ন না করলে তেমনি থাকবে। মাহিয়ার মনে তখন একটি কথা ঘুরেফিরে আসছে।
চাচি আপনারে একটা কথা কইতে চাই কিন্তু সাহস পাই না। রুনা প্রশ্রয়ের কন্ঠে বলেন, বলো মা কী বলতে চাও। আপনি তুলিরে আমারে দিবেন। রুনা কথাটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলেন, ওতো মা আমাদের একমাত্র সন্তান। ওরে দিলে আমরা কিভাবে থাকবো! মাহিয়া বলতে থাকে, আপনার জামাই যায় সকালে ফিরতে ফিরতে রাত হয়। অত বড় বাড়িটার মধ্যে আমি একা। প্রাণটা আনচান করে। নিজের কোন ভাই বোন নাই যাদের নিয়া রাখতে পারি। তুলির সব দায়িত্ব আমার। আপনের যা যখন লাগবে আমি সব করে দেব। চাচি আপনে আপত্তি কইরেন না। আমি মাঝে মাঝে তুলিরে এখানেও নিয়া আসব।‌ মাহিয়ার আবদারের কাছে রুনা হার মানে। না বলার মতো উপায় থাকে না। নিজেও চিন্তা করে দেখে তাঁর অভাবের সংসার। মেয়ের কোন সাধ আহ্লাদই বা পূরণ করতে পারে। মেয়ে মাহিয়ার কাছে ভালো থাকবে। ভাল খাবে পড়বে। তুলি প্রথমে একটু আপত্তি করলেও মা-বাবার আগ্রহ দেখে মেনে নেয়।
মাহিয়ার বাসায় আসার পর সুস্থির হতে তুলির ক’দিন সময় লাগে। একটু থিতু হলে মাহিয়া বলে, তোর দুলাভাইয়ের যখন যা লাগে তাই তুই দিবি। বুবু আমি দুলাভাইয়ের সামনে যেতে পারব না। আমার শরম করে। আরে বোকা কিসের শরম? সে তোর দুলাভাই। মাহিয়ার স্বামী আবিদ হাসান ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। তুলি নতুন এসেছে এখনো সংকোচ কাটেনি। ফাই ফরমায়েশের জন্য ওকে না পাঠানো ভালো। আবিদ হাসান বলে, মাহিয়া তুমি দূরে থাকো কেন? আমাকে কি পর করে দিচ্ছ। যা কিছু লাগবে তুমি এসে দিও। আমার চোখের সামনে তুমি থাকবা। মাহিয়া‌ বলে, আমি কি তোমার চোখের থেকে দূরে আছি? না তারপরও মনে হয় তুমি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে।
মাহিয়ার সন্তান না হওয়া নিয়ে স্বামীর গুরুতর কোন অভিযোগ নাই। তবুও মাহিয়া শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন নিয়ে শঙ্কিত। তার আশঙ্কা তারা আবিদের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগতে পারে। তখন মাহিয়ার এ বাড়িতে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। এটা তো সত্যি তার স্বামী আজও সন্তানের মুখ দেখতে পেল না। আকাশ পাতাল নানা কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। একটা কাজ করলে কেমন হয়। তুলিকে আবিদের সঙ্গে বিয়ে দিলে কেমন হয়! তুলি তো আপন জনের মধ্যেই একজন। যে কথা সেই কাজ। কথাটা স্বামীকে প্রথম বলে। আদিব দৃঢ় স্বরে প্রতিবাদ করে। তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে! সন্তান নিয়ে তোমাকে কোন কথা বলেছি কখনো? আর ওইটুকু মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? শোনো গরিবের মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে তার মর্যাদা রাখবে। আমি তোমার স্বামী, তুমি স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নেও কিভাবে? মাহিয়া বলে, আমি পারলাম দেখেই তো তোমাকে বললাম। আমি সংসারে একটা সন্তান চাই। প্রথম স্ত্রীর উদ্যোগে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে বিস্মিত করে সবাইকে। মাহিয়ার নিরলস চেষ্টায় সব পক্ষকে রাজি করিয়ে বিরল ঘটনাটি সংগঠিত হয়।
বছর দুয়েক মধ্যে তুলির গর্ভে সন্তান আসে। মাহিয়া খুব আনন্দিত। এবার সন্তানের মুখ দেখবে। তুলিকে বেশ যত্নে রাখে। তার স্বপ্ন পূরণ হবে সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে। সন্তানের কত নাম ঠিক করে রাখে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সে নাম ধরে ডাকবে। পুত্র সন্তান এবং কন্যা সন্তানের জন্য আলাদা নাম ঠিক করে। সন্তানের মুখ দেখার জন্য তার উদগ্রীব অপেক্ষা। নিয়তির বিচিত্র খেলা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছু আগে মাহিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়। ডাক্তার জানায় কঠিন নিউমোনিয়া। জ্বর কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসে না। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মাহিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তুলি কান্নাকাটি করে। বুবু তুমি চলে গেলে। স্বামীর অধিকারে স্ত্রী কোনদিন কাউকে অংশীদার করে না। সন্তান লাভের আশায় তুমি স্বেচ্ছায় দেখিয়েছিলে সেই মহানুভবতা। সে সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারলে না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আবিদ হাসান আর তুলি সন্তানকে নিয়ে যায় কবরের পাশে। মাহিয়ার স্বপ্ন মিশে যায় মৃত্যুর অনন্ত সমাপ্তিতে। মাহিয়া তুমি পরকালে ভালো থাকো শান্তিতে থাকো।