আজ ১৩ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ২৭শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

অযাচিত আমন্ত্রণ-সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক:

প্রতিদিন কাজ শেষ করে আশিকের বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। শীতের রাত। রাস্তাঘাট সব নিঝুম। শীতে আশিকের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আশিক সিগারেট খায় না কিন্তু বন্ধুদের জন্য সবসময় পকেটে এক প্যাকেট করে সিগারেট রাখে। আজ আশিকের মনে হলো একটা সিগারেট ধরাবে। সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। এরই মাঝে আশিকের কানে শব্দ এলো, সাহস থাকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আয়। আশিক এমন কোথায় আতঙ্কিত হয়ে যায়। একটি বাড়িতে কয়েকজন কালো পোশাকধারী লোক বন্দুক হাতে খুব হইচই করে। আশিক একটু দূরে থেকেই দৃশ্যটি দেখে। ঘর থেকে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা বের হয়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। পুরুষ এবং মহিলা ওইখানে ঢলে পড়ে। ঘর থেকে একটি মেয়ে চিৎকার করে বেরিয়ে আসলে তাকেও গুলি করে। এরপর লোকগুলি জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুত চলে যায়। আশিকের মনে হলো বাড়িতে যেয়ে দেখি, সে এসে দেখে দু’জন লোকের মৃত্যু। পাশেই দেখে একটি মেয়ের হাতের পাজরে গুলি। তবে মেয়েটি জীবিত আছে। আশিক ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে যায়। ভাবে কি করবে। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলার মৃত্যু হলেও মেয়েটি বেঁচে আছে। মেয়েটির পাজরে গুলি লেগেছে। চারিদিকে তাকিয়ে সাহায্য পাওয়ার মতো কাউকে দেখতে পেল না। আশিক রক্তাক্ত মেয়েটিকে দু’হাতে তুলে দ্রুত হাঁটা শুরু করে। অনেক কষ্টে সে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। মেয়েটির চিকিৎসা চলতে থাকে। উদ্বিগ্ন আশিক একটু পর পর ডাক্তারের কাছে রোগীর অবস্থা জানতে চায়।
ডাক্তার বলেন, রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে! রোগীকে রক্ত দিতে হবে। রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ।
ডাক্তার আমার রক্ত বি পজেটিভ। এরপর আশিকের শরীর থেকে রক্ত নেওয়া হয়। মেয়েটির চেতনা ফিরে আসে। সে বাবা মাকে খুঁজে করে।
ডাক্তার মেয়েটির সম্বন্ধে আশিকের কাছে জানতে চায়?
আশিক ডাক্তারকে সব কথা খুলে বলে। ঘটনা স্থলে মারা যাওয়া দু’জন বোধ করি ওর বাবা-মা। এ কথা শুনে ডাক্তার খুবই মর্মাহত হন। চিন্তা করবেন না মেয়েটি এখন বিপদমুক্ত। দ্রুত ভালো হয়ে উঠবে আশা করি। এদিকে রাত শেষে তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আশিকের বাসায় যাওয়া হয়নি। বাসার জন্য উদ্বেগ হয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি বাসার দিকে রওনা দেয় সে। আশিক বাসায় আসে। আশিকের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে স্ত্রী নাহার জিজ্ঞেস করে, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? সারারাত তুমি কোথায় ছিলে?
তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। শোনো গতরাতে একটি ঘটনা ঘটেছে। আশিক স্ত্রীকে বিস্তারিত জানায়।
সারারাত তোমাকে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম, দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। তোমারও তো বিপদ আপদ ঘটতে পারত।
কেমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ছিলাম চিন্তা করতে পারো। দিগ্বিদিক কোন জ্ঞান ছিল না। ভুল করে ফেলেছি তোমাকে না জানিয়ে। আরিয়ান দৌড়ে বাবার কোলে বসে জড়িয়ে ধরে।
আশিক বলে, আব্বু আমি গোসল করে আসি তারপর সবাই একসঙ্গে নাস্তা করব। নাহার নাস্তা রেডি করে। একসঙ্গে তিনজনে নাস্তা করে। আশিক বলে, আমি এখন হাসপাতালে যাব ওখান থেকে অফিসে যাব। এমন মর্মান্তিক ঘটনা শোনার পর নাহারের মনে মায়া হয়। মেয়েটির কি পরিস্থিতি হয় জানিও আমাকে।
বাবা বাবা তুমি আমার জন্য গাড়ি নিয়ে আসবে।
হ্যাঁ বাবা তোমার জন্য গাড়ি নিয়ে আসবো। আশিক বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতলে যায়। ডাক্তারের দেখা পেয়ে মেয়েটির অবস্থা জানতে চায়।
ডাক্তার বলে, আপনার রোগী ভালো আছে। এখন আশঙ্কা মুক্ত। মেয়েটির দিকে তাকায়। কষ্ট পীড়িত উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সে বলে, আমার বাবা-মা কোথায়?
আশিক বলে, আপনি সুস্থ হয়ে ওঠেন পরে সব জানতে পারবেন।
আপনিকে?
নার্স বলে, সে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
আমার নাম আশিক। আপনার নামটা জানা হয়নি।
ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আমার নাম আসমা।
আসমা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। আসমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়ার সময় হয়। বিপদ বাধে তখনই। বাবা-মায়ের মর্মান্তিক মৃত্যুতে সে একা অসহায় হয়ে পড়েছে। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আশিক উপায়ন্তর না দেখে তাকে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। নাহার বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে চেষ্টা করে। আসমা তখনো বেশ দুর্বল। কিছু সেবা-যত্নের প্রয়োজন হয় তার। কখনো আসমার কোনো প্রয়োজনে আশিক এগিয়ে এলে সহ্য হয় না স্ত্রী নাহারের। কোন সেবা-যত্নে হাত বাড়ালে হিংসার জ্বলে ওঠে মনে সে। স্বামীকে বলে, আমি সেবা-যত্ন করছি তাতে হচ্ছে না। তোমার করা কি দরকার?
আশিক সাফাই দেয়। আহা তুমি চটছো কেন। একটা অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করা। এটাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছ কেন? মেয়েটি অসহায় আমাদের এখানে আছে। তাই।
ওর যা করার আমি তো করছি?
ঠিক আছে, তুমি এ নিয়ে কথা আর বাড়িয়ো না।

আসমা মাথার উপর কোন ছায়া নেই। নিজেকে সে অসহায় ভাবে। স্বাবলম্বী হবার জন্য সে সিদ্ধান্ত নেয় পড়ালেখা করবে। আশিকে বলে, আমাকে কয়টা টিউশনি যোগাড় করে দিতে পারবেন?
টিউশনি করতে হবে কেন?
আমি পড়ালেখা করতে চাই। পড়ালেখার একটা খরচ তো আছে।
পড়ালেখা করতে চাও বেশ ভালো। আমি তোমাকে সেই ব্যবস্থা করে দিব।
এমনি আপনাদের বোঝা হয়ে আছি। বোঝার আর ভারী করতে চাই না।
ঠিক আছে, এসব নিয়ে কথা আর না বাড়াই। আশিক এরপর আসমাকে কলেজে ভর্তি করে দেয়।
সময়ের গতিতে আশিক আর আসমার হৃদয় অদৃশ্য এক মায়ার বাঁধনে আটকা পড়তে থাকে। কেউ কারো চোখের আড়াল হলে, দু’জন দু’জনার জন্য নিরবে উত্তাল হয়ে য়ায়। দু’জনে ভালোলাগা শুধু চোখে চোখেই। এটুকুতেই তারা ছিল পরিতৃপ্তি। কখনো কোন স্থানে ঘুরতে যাওয়া তাদের হয়নি। এমনকি মুখ ফুটে কখনো কেউ কাউকে ভালো লাগার কথাও বলতে পারিনি।
আসমা স্নাতক পাস করে। এরপর মাস্টার্সে ভর্তি হয়।
নাহারের বোন নেই। নাহার হয়তো অলক্ষ্যে আত্মীয়তার সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে। আশিকের ছেলে আরিয়ানের সঙ্গে আসমার বেশ ভালো সম্পর্ক। আরিয়ানও আন্টি কে ছাড়া কিছু বোঝেনা। নাহার ছেলের আনন্দ সঙ্গ দেখে নিজেও খুব আনন্দ পায়।
নাহার নিজের দায়িত্ববোধ থেকে চিন্তা করে, আসমাকে তাদের বিয়ে দেওয়া উচিত। স্বামীকে বলে, আসমা পড়ালেখা যা করেছে যথেষ্ট। এবার ওকে ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করো। এ কথা শুনে আশিকের হৃদয় হঠাৎ যেন বেদনার ঢেউ মেরে উঠলো।
কি ব্যাপার তুমি কোন কথা বলছো না। আশিক স্ত্রী কথার উত্তর দেয়, হ্যাঁ বিয়েতো দেওয়া উচিত। এই কথা শোনার পরে রাতে আশিকের ঘুম আসে না, পায়চারি করে। বারবার আশিকের চোখের সামনে ভেসে উঠে আসমা মুখ। মনে হলো রুমে গিয়ে আসমার মুখখানা একবার দেখে আসবে। আসমার রুমে যায়। দেখে সে ঘুমিয়ে আছে। তার গায়ের চাদরটি টেনে ঠিক করে দেয়।
তোর মায়ার জালে পড়েছি আমি,
তোরে না হৃদয়ে ধরে রাখতে পারছি আমি।
আসমা দিকে একটু চেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার সামনে আসতেই দেখে নাহার দাঁড়িয়ে আছে। আশিক ভয়ে আঁতকে ওঠে।
প্রেমের মায়াজালে পড়েছ?
হৃদয়ে ধরে রাখতে পারছনা তাকে তুমি?
দেখো ছেলে জেগে উঠবে।
এতক্ষণ তোমার ছেলের কথা মনে ছিল না? তোমার কি স্ত্রী ছেলের কথা মনে আছে? মনে থাকলে তো, অন্যের হাওয়ায় দুলতে না তুমি!
দেখো তুমি, খারাপ কোন কিছু করেছি?
খারাপ কিছু না। তুমি এই রুমে আসার সময় আমিও তোমার পিছনে আসি।কি মায়া হয় ওর জন্য?
তুমি এভাবে বলছ কেন?
কিভাবে কথা বলবো তোমার সঙ্গে? তুমি সকাল হলে ওকে বের করে দেবে।
দেখো এসব তোমার বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
আসমা জেগে ওঠে এসব কথা শুনে। তার কিছু বলার মত ভাষা থাকেনা।
যদি বলো বাড়াবাড়ি তাহলে বাড়াবাড়ি। তুমি কথা মতো কাজ করবে কিনা বলো? নাহার চাপাস্বরে চিৎকার শুরু করে।
তুমি যা বলো তাই হবে, এখন ঘুমিয়ে পড়ো।
নাহার আসমাকে বলে, তুমি কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখো। আশিক তোমাকে সকাল হলে কোথাও রেখে আসবে।
আসমা ভয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি জানায়।
সকালে নাহার আশিককে বলে, আমি ঘরে শান্তি চাই। তুমি ওকে কোথাও রেখে আসো। আশিকও অশান্তি থেকে মুক্তি চায়। আসমাকে নিয়ে কি করবে তার কূল-কিনারা খুঁজে পায়না। মেয়ে মানুষ তাকে যে কোন জায়গায় চাইলেও তো রাখা যায়না। হঠাৎ তার মনে পড়ে বন্ধু সাব্বিরের কথা। আসমা বিষয় বন্ধুর সাথে সব কথা খুলে বলে। সাব্বিরের কাছে সমাধান খুঁজে পায়। সাব্বিরের বাসাতেই রাখা যাবে আসমানকে। আশিক বন্ধু সাব্বিরের বাসায় আসমা নিয়ে আসে। বন্ধু তুই আমাকে বাঁচালি। তোর দাঁড়ায় আমার বড় উপকার হলো। সাব্বির তোকে তো সব কথা খুলে বললাম। আমি আমার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাব তখনি যখন আসমাকে ভালো একটি ছেলে দেখে বিয়ে দিতে পারব।
আশিক শোন, আমার শালা ফয়সাল জন্য তো মেয়ে দেখছি। আসমা ও তো দেখতে বেশ ভালো। ফয়সালে জন্য আসমাকে ভেবে দেখা যায়।
আশিক তাতে স্বস্তি বোধ করে। বন্ধু আমার বড় উপকার হবে বিবেকের দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তি পাবো। সাব্বির তুই আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু তোকে না বলে পারছি না। আসমা প্রতি কখন আমার হৃদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে আমি নিজেও জানিনা। ওকে আমি বিয়ে দিব ঠিকই কিন্তু ওর জন্য আমার হৃদয় ক্ষত হয়ে থাকবে। জানিনা পারবো কিনা সমাল দিতে এই অনুভূতি।
এ বিষয় কি আসমা জানে?
না ও কিছুই জানেনা।
জানলেই বা এর সমাধান কি?
হ্যাঁ যেহেতু আমার স্ত্রী সন্তান আছে। আর ওকে বললে হয়তো ভাবতে পারে আমি স্বার্থবাদী। প্রতিদানে প্রতিদান চাচ্ছি। তাই নিজের মনের কথা মনেই রেখে দিয়েছি।
এটা ঠিক ওকে না জানানোই ভালো। এদিকে আসমা আড়াল থেকে সব কথা শুনে। আসমা মনে মনে বলে, তোমার জন্য আমারও তো হৃদয় ক্ষত হয়ে যাচ্ছে। আর তোমাকে আমার ভুল বোঝার কোন কারণ নেই। তুমি তো আমার প্রতি কোন জোর খাটাওনি।
সাব্বিরের শালা ফয়সালের সঙ্গে আসমার বিয়ে হয়। বধু বেশে আসমাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।
আশিক বলে, কি অপরুপ দেখতে তুমি।
দু’চোখের দৃষ্টি দিয়ে, শুধু তোমার দিকে, চেয়ে থাকি।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাবে তুমি।
বধু বেশে আসমা আশিকের হাত ধরে, চলেন আমরা পালিয়ে যাই।
আশিক তাতে চমকে যায়! কি বলছো এসব তুমি?
অস্বীকার করতে পারবেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?
না।
আমি সব জানি। সেদিন আপনি যখন আপনার বন্ধু সাব্বিরকে আমার বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, আমি সব শুনছি।
আশিকের মুখ থেকে বের হয়, হ্যাঁ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তাহলে কেন দ্বিধাবোধ করছেন আপনি?
এরমাঝে সবাই এসে বরযাত্রীর গাড়িতে তুলে দেয় আসমাকে। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে। দু’জনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। গাড়ি ছেড়ে দেয়। আশিকের বুক ফাটা দীর্ঘশ্বাস দমকা বাতাসে মিলিয়ে যায়। ভাবতে থাকে এমন ভালোবাসা মানুষের জীবনে কেন আসে।

 

লেখক- সুলেখা আক্তার শান্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category