আজ ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ায় স্ত্রীকে তালাক

 

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে তালাকের শিকার হয়েছেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের এক হতভাগ্য মা আফরোজা আক্তারের। বিয়ের মাত্র পৌনে দুই বছরের মাথাতেই সংসার ভাঙলো । সালিশ, দেন-দরবার, হাতে-পায়ে ধরা কোনো
কিছুতেই টেকাতে পারেননি সংসার। রুহুল আমিন বলছে ‘মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি একথা ঠিক না।
জানা গেছে, আফরোজা আক্তার (২২) কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কামারহাটিয়া গ্রামের আবুল হাশেমের মেয়ে আফরোজার ২০২০ সালের ৩রা জানুয়ারি পারিবারিকভাবে পার্শ্ববর্তী নোয়াবাদ ইউনিয়নের
সিন্দ্রিপ গ্রামের সাবেক মেম্বার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে রুহুল আমিনের সঙ্গে বিয়ে হয়। রুহুল আমিন (৩০) একজন আনসার সদস্য।

বর্তমানে তিনি জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় কর্মরত। তার স্বপ্ন ছিল প্রথম সন্তান হবে ছেলে। কিন্তু
স্ত্রীর কোলজুড়ে এসেছে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। এ ‘অপরাধে’ স্ত্রী আফরোজা আক্তারের ওপর নেমে আসে অমানুসিক নির্যাতন। অবশেষে তাকে তালাক দেন স্বামী রুহুল আমিন। স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ছোট শিশুটিকে নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন এখন অসহায় ওই নারী। বিষয়টি নিয়ে কয়েক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে
সালিশ বৈঠক হলেও মন গলেনি স্বামী রুহুল আমিনের। তিনি কন্যা সন্তানের মুখ থেকে ‘বাবা’ ডাক শুনতে চান না বলে সালিশে সাফ জানিয়ে দেন। সালিশে তাকে চরমভাবে ধিক্কার জানানো হলেও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

এ ঘটনায় সালিশকারীরা হতভম্ব হয়ে যান। এলাকার লোকজন বিস্মিত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে এখন চলছে তোলপাড়। ২০২০ সালের ৩রা জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রুহুল-আফরোজার বিয়েতে যৌতুক হিসেবে রুহুলকে একটি মোটরসাইকেল এবং প্রায় ২ লাখ টাকার ফার্নিচার দেয়া হয়। বিয়ের পর ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার। কিছুদিন পরই গর্ভধারণ
করেন আফরোজা। আফরোজা অভিযোগ করে বলেন, ‘বাচ্চা যখন পেটে আসে তখন অসুস্থ হয়ে যাই। ৮ মাসের সময় আমি বাবার বাড়িতে চলে আসি। স্বামী আলট্রাসনোগ্রাম করাতে বলে। আলট্রাসনোগ্রাম করাতে গিয়ে জানা গেল, আমার মেয়ে বাচ্চা হবে। এ খবর শুনেই বদলে যায় রুহুল। সে এরপর থেকে আমার সঙ্গে মোবাইলে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে।

আমাকে এক নজর দেখতে আসেনি। জানিয়ে দেয়, মেয়ে হলে তার মুখও দেখতে আসবে না। এ পরিস্থিতিতে গত ২৫শে জানুয়ারি জন্ম নেয় আমার মেয়ে সন্তান। নাম রাখি নুসরাত’। যার অর্থ ‘সমর্থন’ বা ‘প্রতিরক্ষা’।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে আফরোজা বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, নুসরাতের মুখ দেখে ওর বাবার মন পাল্টে যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। নুসরাত হওয়ার একমাস পর, স্বামী রুহুল মোবাইল ফোনে আমার সঙ্গে আর ঘর করবে না বলে মৌখিকভাবে তালাক দিয়ে দেয়। নুসরাত আমাকে ‘প্রতিরক্ষা’ দিতে পারেনি।’ আফরোজার বড় ভাই আব্দুল হালিম বলেন, বিয়েতে রুহুলকে একটি মোটরসাইকেল ও প্রায় ২ লাখ টাকার ফার্নিচার দেয়া হয়। মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়ায় রুহুলের মন খারাপ হলে আমরা প্রস্তাব দেই, শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনে আরো ২ লাখ টাকা দেবো। তারপরও আমার বোনের সংসার টিকাতে পারিনি। আফরোজার মেয়ে নুসরাতের বয়স এখন ৮ মাস। শিশুটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিষয়টি মীমাংসার উদ্যোগ নেন এলাকাবাসী।

গত ২৮শে আগস্ট জয়কা ইউনিয়ন পরিষদে এ ব্যাপারে সালিশের আয়োজন করা হয়। এতে জয়কা ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন, পাশের ইউনিয়ন গুনধরের চেয়ারম্যান নাজমুল শাকির ন‚রু শিকদারসহ অন্তত ৩ ইউনিয়নের গণ্যমান্য লোকজন উপস্থিত ছিলেন। ওই সালিশেও কোনো কাজ হয়নি। সালিশ শেষে লিখিতভাবে তালাক পান আফরোজা। সালিশে উপস্থিত জাতীয় পার্টির নেতা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এমদাদুল হক বলেন, ‘রুহুল আমিন কন্যা সন্তান হওয়ার কারণে ক্ষিপ্ত হন। তিনি ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। আর এ কারণে তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দেন বলে সালিশে প্রমাণ হয়।’ তিনি আরও বলেন, সালিশে উপস্থিত প্রায় সবাই রুহুলকে বুঝিয়ে ব্যর্থ হয়।

পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে লিখিত তালাকের ব্যবস্থা করা হয়। জয়কা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি মীর হুসেন বলেন্য়ঁড়ঃ; শালিশে রুহুল স্পষ্ট ভাষায় বলেন মেয়ে সন্তান আমি চাই না,আমি তাকে নিয়ে কিছুতেই সংসার করতে ইচ্ছুক না।তার কথায় শালিশে উপস্থিত জনতা হতভম্ব হয়ে যায়।কিছুতেই তাকে বুঝানো যায়নি।আমরা সংসারটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি,রুহুলের একগুয়েমির জন্য সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে জয়কা ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সালিশে আফরোজার অন্য কোনো দোষত্রুটি দেখাতে পারেনি রহুল। কেবল মেয়ে বাচ্চা হওয়ার কারণে তালাকের ঘটনা ঘটেনি এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে।

গুনধর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাজমুল শাকির নুরু শিকদার বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি, যেহেতু তাদের একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে। সংসারটি যেন টিকে থাকে। কিন্তু রুহুলের একগুঁয়েমির কারণে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে রুহুল আমিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি একথা ঠিক না। সে (আফরোজা) আমার কথা শুনতো না। মেয়ে হওয়ার পর সে আমার সঙ্গে আরো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ
শুরু করে। আমি কল দিলে প্রায় সময় তার নাম্বার বিজি থাকে। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করলে আমার মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করে। আরো নানাবিধ কারণে তাকে তালাক দিয়েছি আমি।’

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ