Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
ছেঁড়া পাতার কান্না-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

ছেঁড়া পাতার কান্না-সুলেখা আক্তার শান্তা

স্বাধীন চেতা মানুষ জামিল। কারো কোন কথার ধার ধারে না। যেটা ভালো মনে করে তাই করে। পিতা সিরাজ আহমেদ বড় ছেলের এমন আচরণে ভীষণ চিন্তিত। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, বড় ছেলে বেড়ায়া হলেও ছোট ছেলেটা মানুষ হয়েছে। তার যত আশা ভরসা ছোট ছেলে রশিদকে নিয়ে। জামিল হঠাৎ বাবার কাছে এসে বলে, বাবা চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। সিরাজ আহমেদ অবাক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ডাক্তারের কাছে কেন? তোমার শরীরটাতো খারাপ তাই।‌ আমার শরীর খারাপ তোকে কে বললো? আমি তোমার ছেলে আমি বুঝি না। না আমার শরীর ঠিক আছে। এখন বয়স হয়েছে একটু আধটু শরীর খারাপ হয়, এটা তেমন কিছু না। আমি তোমার ছেলে আর ছেলে থাকতে তুমি কষ্ট করবে কেন? তোর হঠাৎ হলো কি? তোমার কুশলাদি জানাটা সমস্যা হবে কেন? বাবা বেশি দোষ খুঁজো না তো। ঠিক আছে তুই বলেছিস তাতে আমি খুশি হয়েছি। আমার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। শোনো কষ্ট করবে তারা যাদের ছেলে সন্তান নাই, টাকা পয়সা নাই। তোমার সবকিছু থাকতে তুমি কেন কষ্ট করবা? সিরাজ বলেন, বাবা আমার কিছু লাগবে না তুই ভালো হইয়া চল তাতেই আমি খুশি। আমি কি করলাম? না তুই কিছু করিস নি। জামিল বলে, বাবা তুমি ঝটপট রেডি হও আমি তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। বড় ছেলে জামিলের পিড়াপিড়িতে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হয় সিরাজ আহমেদের।

ডাক্তার সিরাজ আহমেদকে দেখে বলেন, অতিমাত্রায় চিন্তার কারণে উনার শরীরটা এমন, আর এমনিতেও বয়স হয়েছে। ঠিক আছে আমি ওষুধ দিচ্ছি এটা খাওয়ান। জামিল বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনে দেয়, বাবাকে মিষ্টি খাওয়ায়। অনেক ফল কিনে দেয়। সিরাজ আহমেদ খুশি হয় ছেলের কান্ড দেখে। খুশিতে ছেলে যা বলে তাই করেন।
বাবা তোমাকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাব। পাসপোর্ট করতে হবে। কিছু কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে, এখানে এখানে সই দাও। সিরাজ আহমেদ স্বাক্ষর করে দেন। স্ত্রী আজিজাকে বলেন, বড় ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম তার অবসান হয়েছে বুঝলা জামিলের মা?  মানুষের পরিবর্তন হতে দেরি লাগে না। জামিল যে আমার এত ভাল হবে তা কখনো ভাবেনি! আজিজা স্বামীর মুখে কথাগুলো শুনে খুব খুশি হয়। যাক ভালো হলেই ভালো। সন্তান খারাপ হলে বাবা-মার কোন সুখ থাকে না। জামিলের মা, ছেলে তো আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতে চায়, আমার চিকিৎসা করাবে। যাও, ছেলে যখন নিয়ে যেতে চায়। এরপর বেশ কয়েক মাস গত হয়। জামিল তার বাবাকে চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া নিয়ে যায় না। সিরাজ আহমেদ তা নিয়ে ছেলেকে কিছু বলেন না। জামিল হঠৎ একটা জমি বিক্রি করে। সিরাজ আহমেদ বলেন, তুই আমার জমি বিক্রি করলি আমাকে জিজ্ঞেস না করে? তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন?
আমার জমি আমাকে জিজ্ঞেস করবি না?
জামিল রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে, জমি তোমার? তোমার নামে আছে কিনা তা কি তুমি দেখছো?
জমির তো তোর না। আমি তো তোদের দুই ভাইকে ভাগ বাটোয়ারা করে দেইনি! আর জমি আমার নামে আছে।
কদিন পর একই কাজ জামিল আবারও করে। সিরাজ আহমেদ এবার ভীষণ ক্ষিপ্ত হয় ‌ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে। আমার জমি বিক্রি করছিস আর আমি জানিনা! আমার কোন সই স্বাক্ষর ছাড়াই কি করে জমি বিক্রি হয়?
এটা কি মগের মুল্লুক? রশিদ বলে জামিলকে উদ্দেশ্য করে। বাবা, মা জীবিত থাকতে তাদের পারমিশন না নিয়ে তুমি একের পর এক জমি বিক্রি করে যাচ্ছ। তুই থাম এর মধ্যে তোকে ডাকছে কে? আমাকে ডাকবে কে? বাবা-মাকে কোন কিছু না জানিয়ে তুমি এরকম করবা আর আমি বুঝি চুপ থাকব! সম্পত্তি বাবা-মার না সম্পত্তি হচ্ছে আমার। আমারটা যা ইচ্ছা আমি তাই করবো। বাবা মার না মানে? বাবা তার সয়-সম্পত্তি সব আমার নামে করে দিছে। আজিজা চিৎকার করে ওঠে, এটা তুই বলোস কি?
যা সত্যি তাই বলছি।
আজিজা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, শুনছো তোমার ছেলে বলে কি? সিরাজ আহমেদ জানতে পারেন, তার ছেলে পাসপোর্ট বানানোর নাম করে যেসব কাগজপত্রের সই নিয়েছিল সেগুলি দিয়ে তার বিষয় সম্পত্তি সব লিখে নিছে। শুধু বসতবাড়িটা বাদে। জামিল তার সম্পত্তি নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। বাবা, মার দায়িত্বভার কোন কিছু নেয় না। ছোট ছেলে রশিদ তার বাবা মাকে দেখে। রশিদ বিয়ে করে, বউ অপূর্ব সুন্দরী। বাবা-মা নিয়ে রশিদের সংসার। দীপা শ্বশুর, শাশুড়ির খুব খেদমত করে। শ্বশুর, শাশুড়ি ও তাকে খুব ভালোবাসে। অর্থ সম্পদ না থাকলেও তাদের মনে সুখ আছে। সিরাজ আহমেদ আর আজিজা ভুলেও বড় ছেলে জামিলের কথা মনে করেন না। তারা মনে করেন একমাত্র রশিদই তাদের সন্তান। রশিদও বাবা-মার প্রতি খুবই দায়িত্বশীল। দীপা শ্বশুর, শাশুড়ি প্রতি খুব যত্নশীল। কখন কি লাগে না লাগে সে বিষয়ে খুব সচেতন। আজিজা খুশি হয়ে বলেন, বৌমা সবসময় আমাদের খেদমত করলে কি চলবে তোমার নিজের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আপনারা ভাল থাকলেই আমি ভাল থাকবো। আজিজা দীপার মাথার উপর হাত দিয়ে বলেন পাগলি মেয়ে আমার। আজিজা বউয়ের কাছে মনোবাসনা ব্যক্ত করেন। বৌমা সবকিছু দিয়ে মনটা ভরিয়ে রেখেছো। আরেকটু ভালো লাগবে যদি আমাদের মনের আশা পূর্ণ করো। মা বলেন? নাতি, নাতনির মুখটা আমাদের এবার দেখাও।
মা কি যে বলেন আপনি?
বৌমা এটা শরমের কথা নয়। শোনো নাতি, নাতনি না থাকলে কি ঘর পূর্ণ হয়? হবে মা হবে আপনাদের সব আশাই পূর্ণ হবে।
আল্লাহর অশেষ মহিমা। শাশুড়ি কথা বলতে না বলতেই নতুন অতিথির আশার আগমনে বার্তা পেল। অর্থ সম্পদ কম থাকলেও যেন সংসারে সুখের কমতি নেই। রশিদ বেজায় খুশি এমন সংবাদ পেয়ে। আল্লাহ অশেষ মেহেরবান দিন মাস পাড়ি দিয়ে পৃথিবীতে আসে নতুন অতিথি। দাদা, দাদি খুশি হয়ে নাতির নাম রাখেন সুজন। রশিদ তার সংসারের খরচ মিটিয়ে একটু একটু সঞ্চায় জমা করেছিল। সেই টাকা দিয়ে সে ছেলের জন্য একটা স্বর্ণের চেইন কিনে আনে। ছেলের গলায় পরিয়ে দেয়। আমার বাবা সোনা কে কত সুন্দর লাগছে। আমার সাত রাজার ধন। তুই বেঁচে থাক তাই আমি চাই।

একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। রশিদ বাড়ি থেকে বের হয়ে আর বাড়ি ফিরে না। চারিদিকে খোঁজ খবর করে, অনেক তল্লাশি করেও তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। প্রতিদিনের আশায় বুক বাঁধা ব্যর্থ হতে থাকে। কোথায় গেছে কোথায় আছে তার পরিবার কোন সন্ধান পায় না। এমন করে মাস পেরিয়ে বছরে গড়ায়। সংসারে খরচে চলে না। সিরাজ আর আজিজা ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন আর তাদের কান্না আসে না। শুধু অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা তাদের ছেলে কখন বাড়ি ফিরে আসবে। জামিল অবস্থা সম্পন্ন মানুষ কিন্তু সে তার বাবা-মার খোঁজ নেয় না। বাবা-মাও ছেলের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করে না।
দীপার প্রতি বরাবরই জামিলের দৃষ্টি ছিল। জামিল একদিন সরাসরি দীপাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। দীপা রাগান্বিত হয়ে বলে, আপনি এসব কি বলছেন? আমি আপনার ভাইয়ের বউ।
এখন তো তুমি কারো বউ না। এবার আমার বউ হয়ে যাও। দীপা নিজেকে সংযত করতে পারে না। সে ঝাড়ু হাতে নিয়ে বলে, এখান থেকে না গেলে ঝাড়ু পেটা করব। কথা কাটাকাটি শুনে আজিজা ঘর থেকে বের হয়। জামিলের এমন কর্মকাণ্ড শুনে জামিলকে বলে, তুই আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় আর আসবি না। কথা না বাড়িয়ে সে নীরবে প্রস্থান করে। কিন্তু জামিলের উৎপাত দিন দিন বাড়তেই থাকে। ‌এমন জ্বালা দীপা বেশ কয়েক বছর সহ্য করে।
এদিকে ছেলেটা বড় হয়েছে, তার সামনে তার মায়ের সঙ্গে চাচা অশোভন আচরণ করে। দীপা লজ্জায় ক্ষোভে জর্জরিত হয়। সংসারে টানাটানি। দীপার মাথায় নানা জ্বালা, শ্বশুর, শাশুড়ির সামনে খেতে দিতে পারে না। ছোট ছেলেটারও চাওয়া পাওয়া মিটাতে পারে না। এদিকে জামিল লেগে আছে তার পিছনে। দীপার বাবা-মা মেয়ের এমন জ্বালা, যন্ত্রণা পোহাতে দেখে দীপাকে বিয়ে দিতে চায়। বিয়ে করতে না চাইলেও বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে দিয়ে দেয়। স্থির হয় স্বামী আলিম দীপার আগের ছেলের কোন ভরণ পোষণ দেবে না।
সিরাজ আর আজিজা প্রায় অনাহারে দিন পার করতে থাকে। নাতিটার জন্য তাদের ভীষণ চিন্তা, নাতিটার মুখে কোন ভালো-মন্দ খাবার দিতে পারে না। দীপা থাকতে তাও এখানে সেখানে কাজ করে সংসার চালাত। এখন তো দীপা নাই সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। সুজন তার মাকে দেখতে চায়। বারবার দাদিকে বলে, মার কাছে যাব। নাতির এমন কথা শুনে কষ্ট করে লাঠিতে ভর দিয়ে নাতিকে নিয়ে দীপার বাড়ি যায়। দীপা ছেলেকে আর শাশুড়িকে পেয়ে খুব খুশি। দু’জনকে খেতে দেয়। এমন সময় আলিমের আগমন ঘটে। আলিম ঝাঁজালো কন্ঠে বলে ওঠে, আমি কি লঙ্গরখানা বসাইছি? যে কেউ এসে এখানে খেতে বসবো। আজিজার মুখে আর ভাত যায় না, সে হাত ধুয়ে ফেলে। নাতি সুজনের হাত ধরে বলে, ঠিক আছে বৌমা আমরা আসি। বৌমা, বৌমা করেন কেন? এখনও কি সে আপনাদের বউমা আছে? আজিজার গায়ে শক্তি নেই, তার গা থরথর করে কাঁপতে থাকে। ওই অবস্থায় আজিজা নাতিকে নিয়ে চলে যায়। দীপা কিছুই বলে না। বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে দু’চোখ বেয়ে তার অশ্রু নেমে আসে। আলিম ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, আর যদি দেখি ওই ছেলে তোর কাছে আসছে আর তুই যদি ওকে খেতে দিস তাহলে তোকে আমি তালাক দেবো। দীপার মুখে কথা নাই।
সুজন দাদা দাদির কাছে কান্নাকাটি করে মায়ের কাছে যাব বলে। সিরাজ আহমেদ নাতিকে বোঝাতে চেষ্টা করে। দাদুভাই মায়ের কাছে যেতে হবে না। সেখানে গেলে অশান্তি হয়। সুজন দাদা-দাদির বারণ মানে না। দাদা, দিদির কাছে কিছু না বলেই মায়ের কাছে যায়। সুজন মায়ের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। তারপর জানালার কাছে গিয়ে মাকে ডাকে। দীপা মা ডাক শুনতে পেয়ে জানলার কাছে আসে। ছেলেকে দেখতে পেয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে, বাবা তুই আছিস। মুখটা শুকিয়ে আছে। দাঁড়া আমি তোর জন্য ভাত নিয়ে আসি। প্লেট হাতে নিয়ে জানলা দিয়ে ছেলের মুখে খাবার তুলে দেয় দীপা। আজও আলিম দেখে ফেলে। ভাতের থালা কেড়ে নিয়ে বকাঝকা করে। আলিম এক পর্যায়ে সুজনকে কয়েকটা থাপ্পড় মারে। ছেলেকে থাপ্পড় মারা দেখে দীপা ঘর থেকে দৌড় ছুটে আসে। তুমি আমার ছেলেকে মারলা? আলিম বলে, তুই আমার কথা অমান্য করে এই ছেলেকে খাইতে দিছস কেন? তোকে আমি তালাক দিলাম। একটা তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক! দীপা একথা শুনে কোন প্রতি উত্তর করে না, কোন কান্নাকাটিও করে না। সে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে। সে আলিমকে কিছু না বলে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ভাবতে থাকে, শুধুমাত্র একটু আশ্রয়ের জন্য মেয়েদের যে বঞ্চনা গঞ্জনা সইতে হয় এর কি কোন শেষ নাই! অজানা গন্তব্যে ছেলেকে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। জানেনা কোথায় গিয়ে থামবে সে পথ।