Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
ক্রান্তি লগ্নসুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

ক্রান্তি লগ্ন<>সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক:
তোমার কান্ডজ্ঞান দেখে আর বাঁচি না। মনোরা অবাক হয়। নিজের সংসার চলে না। তার মধ্যে আবার ঝামেলা সঙ্গে নিয়ে আসছো।
এমন বলছো কেন? বাচ্চাটা পথের ধারে কাঁদতে দেখে মায়া লাগলো। এদিক সেদিক তাকালাম কাউকে দেখলাম না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে যখন লোকজন দেখলাম বাচ্চাটির কথা অনেককে জিজ্ঞেস করলাম সবাই কিছু না বলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। বাচ্চাটির জন্য মায়া হওয়ায় তাই সাথে করে নিয়ে আসলাম।
নিজের পাঁচ মেয়ে এক ছেলে তাদের মুখের খাবার জোটাতে পারো না! তার মধ্যে এই বাচ্চাকে নিয়া আসছো।
তাহের বউকে বলে। সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। তিনি আহার যোগার করে দিবেন।
আমি বলি যেখান থেকে বাচ্চা আনছো সেখানেই রেখে আসো।
মনোরা আমি তা পারবো না। আর যদি আমার বাচ্চাদের খাওয়াতে পারি তাহলে এই বাচ্চাকেও খাওয়াতে পারব।
কার না কার বাচ্চা কান্নাকাটি করছে, তা দেখে অমনি ধরে নিয়ে এসেছে। দয়ার সাগর। অভাবের সংসার। নিজের বাচ্চাদের মুখে খাবার দিতে পারি না তার উপর আবার অন্যের বাচ্চা নিয়াছে।
তুমি আর চিল্লাইও না। বাচ্চাটারে কিছু খাইতে দাও। পরে তাহের নিজেই বাচ্চাটাকে গোসল, খাওয়া-দাওয়া করায়। ও সোনা বাবু, বলতো তোকে কি নামে ডাকি। আজ থেকে তোর নাম ফুলি। ফুলি নামেই ডাকবো তোকে।
তাহের ভীষণ ভালোবাসে ফুলিকে। নিজে না খেয়ে ফুলিকে খাওয়ায়। তা দেখে মনোরা চেঁচামেচি করে। আদিখ্যেতা দেখে গা জ্বলে যায় তার, ফুলিকে একদম সহ্য করতে পারে না সে। তাহের কাজের জন্য ক্ষেত খামারে, হাট বাজারে গেলে মনোরা তখন ফুলিকে ধরে মারধর করে। নিজে সন্তানদের শিখিয়ে দেয় ওর সঙ্গে মিশবি না। ও তোদের নিজের বোন না। ফুলি বেরে উঠায় সাথে সংসারের যাবতীয় কাজের ভার তার উপর পরে। কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়। ছোট শরীরের অনেক ভারী কাজ ফুলি পেটে বাজিয়ে করে। তবুও ফুলি মা মনোরার আদর ভালোবাসা পায় না। ফুলি খাবারে সময় পাশে থাকলে মনোরা বলে, তুই এখান থেকে যা আমাদের খাওয়া শেষ হলে পরে তুই খাবি। তাদের সকলের খাও শেষ হলে ফুলির জন্য প্রায়ই কোন খাবার থাকে না। পাতিল খালি পরে থাকে। মনোরা শাসিয়ে ফুলিকে বলে, একথা যদি তোর বাবাকে বলিস তাহলে মেরে তোর হাড্ডি ভেঙ্গে দিব। ফুলি ভয়ে বাবাকে কিছুই বলেনা। পেটে ক্ষুধা নিয়ে ফুলি চুপ করে থাকে।
তাহের ভাত খবর সময় ফুলিকে জিজ্ঞাস করে, ভাত খেয়েছিস?
ফুলি মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ খেয়েছি। কিন্তু ফুলি ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদে আড়ালে। কাঁদাই ছিলো ফুলির ভাগ্যের লিখন।
মনোরা পাঁচ মেয়ের মধ্যে চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। বিয়ের উপযুক্ত ফুলির বিয়ে নিয়ে কেউ ভাবেনা। ফুলিকে দিয়ে সংসারের সমস্ত কাজ করায় তাও মনোরার মন পেত না ফুলি। শত জ্বালা যন্ত্রণা নিরবে ভোগ করে ফুলি এখানেই থাকে। কারণ তার তো যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আশে পাশেরর লোকজন ফুলিকে বলে এতকষ্ট সহ্য করে এখানে থাকিস কেন? তার চেয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে কাজ করে জীবনের একটা গতি কর। ফুলিও ভাবে এখানে অনাহারে অনাদরে আর কত থাকবো।
ফুলি ঢাকায় এসে মানুষের বাসায় কাজ করে, কিন্তু ফুলি জীবনে কারো ভালোবাসা পায়নেই। এক পালিত বাবাই তাকে ভালোবাসতো। তাই বাবার কথা তার খুব মনে পড়ে। কাজ করে যে টাকা পায় বাবার কথা মনে করে সে টাকা বাড়ী পাঠিয়ে দেয়। ফুলি টাকা মনোরা সংসারে খরচ করে। ফুলির ভবিষ্যতের কথা ভাবে না। তবে এই টাকা উসিলায় মনোরা এখন ফুলিকে ভালোবাসে। মনোরা এখন ফুলিকে মনে না হলেও মুখে ভালোবাসে। যে মা ফুলিকে অহনিশি বকাঝকা ও মারত, এখন সেই মায়ের কাছ থেকে ফুলি ভালোবাসা পায়। ফুলির সান্তনা, উপার্জনের সব টাকা খরচ করলেও তো মায়ের ভালোবাসা পাচ্ছি। এইটুকুতেই তার আনন্দ। যে সংসারে সে বড় হয়েছে একে একে তাদের সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। এপরেও মনোরা ফুলির বিয়ে বা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন কিছু ভাবে না।
সময় কারো জন্য আটকে থাকে না। ফুলির বিয়ে হয় লতিবের সঙ্গে। স্বামী লতিবকে নিয়ে ছোট একটি বাসা ভাড়া নেয়। দু’জনের সংসার শুরু হয় কিন্তু দ্রুতই দেখা দেয় অশান্তি। লতিব ভাবে ফুলির কাছে অনেক টাকা আছে। যেহেতু অনেকদিন ধরে সে কাজ করেছে জমা টাকা না থেকেই পারেনা। সেই লোভেই ফুলিকে বিয়ে করেছে সে। তা না হলে যার কোনো পিতৃপরিচয় নেই তাকে কেউ বিয়ে করে! লতিব ফুলির কছে টাকা চায়।
ফুলি অবাক হয়ে বলে, আমার কছে তো টাকা নাই! লতিব বড় চোখ করে ফুলির দিকে তাকিয়ে বলে, কি বলিস। তুই এত বছর কাজ করেছিস আর এখন বলসিছ টাকা নাই! আমি ভাবছি তোর কাছে অনেক টাকা আছে। হায় হায় তোরে বিয়ে করে আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি তোরে নিয়ে সংসার করতে পারুম না।
দেখো আমি তো কাজ করি, সেই টাকাতো তোমার হাতেই দিমু।
কাজ করে টাকা পাবি তারপর টাকা দিবি। আমার চাই নগদ টাকা। কাজ করে বেতন পেয়েই ফুলি স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেয়। সে টাকাতে লতিবের মন ওঠে না। অল্পতে সে সন্তুষ্ট নয়। ফুলিকে নিয়ে সংসার করবে না। ফুলি তখন গর্ভবতী। সেই অবস্থায় ফুলিকে ফেলে লতিব চলে যায়। পেটে সন্তান নিয়ে ফুলি লোকের বাসায় কাজ করে। সে বুঝতে পারে এই সংকটের সময় তার একটা অবলম্বন দরকার। ফুলি কিছু টাকা জমিয়ে সন্তান প্রসবের জন্য বাবা-মার কাছে যায়। সব টাকা ফুমি মা মনোরার হাতে তুলে দেয়। রূঢ় বাস্তবতা থেকে সে পরিত্রাণ পায়না। যতদিন টাকা থাকে ততদিন ফুলির জন্য মনোরার ভালোবাসা থাকে, টাকা শেষ ভালোবাসাও শেষ হয়। পরে ফুলিকে আর দেখতে পারে না। মনোরা ফুলিকে বলে, তুই এখান থেকে চলে যায়। ফুলি মায়ের কথা শুনে কাঁদে।
তাহেরের বয়স হয়েছে শরীর এবং মনের শক্তি কমে গেছে। স্ত্রীকে বলে, মেয়ের টাকা কমতো আর খাও নাই। এখন মেয়ে নিদান কাল এই অবস্থায় মেয়েটার সাথে এমন বিদ্বেষপূর্ণ ব্যবাহর না করলে হয় না। তাছাড়া তোমার ছোট মেয়ের বিয়ের সমস্ত টাকা তো ওই দিয়েছে। সেই কথা ভেবে মেয়েটার দিকে একটু তাকাও।
মনোরা কিছুতেই ফুলিকে সহ্য করতে পারে না। কখনোই সে ফুলিকে আপন ভাবতে পারেনি। দু’চোখের বিষ মনে করে ফুলিকে। এত বৈরিতার মাঝে ফুলির সন্তান পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখে। ফুলি এইটুকু বাচ্চা রেখে ঢাকা যাওয়া সিদ্ধান্ত নেয়। মা মনোরাকে বলে, মা আমি তো সন্তান নিয়ে যেতে পারবো না। কারণ সন্তান নিয়ে কেউ আমাকে কাজে নিবেনা। মা মাসে মাসে তোমার কাছে টাকা পাঠাবো। মনোরা টাকা পাওয়ার আশায় ফুলির ছেলেকে রাখতে রাজি হয়। ফুলি সন্তানকে আদর করে কপালে মুখে চুমু খায়। অশ্রুসজল চোখে সন্তানকে মায়ের কোলে তুলে দিয়ে ঢাকার উদ্যেশে রওনা দেয়। ফুলি আবার বাসাবাড়িতে কাজ শুরু করে। চোখের সামনে সারাক্ষণ সন্তানের কচি মুখটা ভাসতে থাকে। দুমড়ে মুচড়ে হাহাকারে চৌচির হয়ে যায় মায়ের বুক। লুকিয়ে রাখে মনে মনের আর্তনাদ চোখের অশ্রু।
কাজের ফাঁকে দ্রুত সময় চলে যায়। আজ কাল করে বছর খানেক হয়ে গেছে ফুলি সন্তানকে দেখতে যেতে পারেনি। কাজ থেকে ছুটি নিয়ে সন্তানের জন্য সাধ্যমত কেনাকাটা করে বাড়িতে রওয়ানা হয়। সারা পথ সন্তানের কচি মুখটা ভাসতে থাকে। ভাবে অনেক ভালবাসবে ছেলেকে। এক বছরের আদর ভালোবাসা এক দিনে পুষিয়ে দেবে। ছেলের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢোকে। বাবা নয়ন আমি এসেছি। মনোরাকে জিজ্ঞেস করে মা আমার নয়ন কই?
ওই তো তোর ছেলে শোয়া। দেখে উঠানে মাদুরে বাচ্চাটাকে শুয়ে রেখেছে। ফুলি দৌড়ে ছেলের দেখে চমকে উঠে। বাচ্চাকে পিঁপড়ার জড়িয়ে ধরেছে। বাচ্চার পুরো শরীর ভর্তি ঘা। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করে, মা আমার বাবারে এভাবে ফেলে রেখেছে? মনোরাকে বলে, আমার ছেলের এই অবস্থা ডাক্তার দেখও নাই!
তাহের কান্না চেপে বলে, মা তোর ছেলেকে যদি বাঁচাতে চাস তাহলে এখান থেকে নিয়ে যা। ফুলি ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বাহির হয়।
মনোরা পিছন থেকে ডাকে, তুই আসিছ থাকবি না। ফুলি আর পিছন ফিরে তাকায় না। কাঁদতে কাঁদতে ওই অবস্থায় ছেলেকে নিয়ে সে ঢাকায় চলে আসে। চিকিৎসায় ফুলির ছেলে সুস্থ হলেও দেখা দেয় আরেক সমস্যা। যে বাসায় কাজে ছিল তারা বলেদিল কাজে রাখা যাবে না। সারাক্ষণ ছেলের পিছনে ব্যয় করলে কাজ করবে কখন? ফুলি চোখে অন্ধকার দেখে। কাজ হারাবে খাবে কি থাকবে কোথায়। এখন তো আবার দুই পেটের সংস্থান করতে হবে।
ফুলি কয়েক জায়গায় কাজের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সীমাহীন দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে সে। বস্তবতা তাকে মরিয়া করে তোলে। হঠাৎ একটা বিষয় তার মনে আসে। এই পাড়াতেই একটি নিঃসন্তান দম্পতি থাকে। সন্তান লাভের জন্য তাদের সীমাহীন চেষ্টার কথা সে জানত। স্বপ্নেও ভাবেনি সেই পরিবার তার কষ্ট লাঘবের কান্ডারী হবে। ছেলেকে তাদের কাছে দিয়ে আসতে গেলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এমনকি রাখতেও অস্বীকার করতে পারে। একদিন ফুলি বুকে পাষাণ বেঁধে তাদের দরজায় নিজের সন্তাকে রেখে আসে। আড়াল থেকে ফুলি দেখতে থাকে। ওই দম্পতি দরজা খুলে বাচ্চা দেখে এমন অদ্ভুত ঘটনায় তাঁরা ইতঃস্তত করলেও কিছুক্ষণ পর ছেলেকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে যায়। আল্লাহ যেন কোন উছিলায় আমাদের জন্য বাচ্চা পাঠিয়েছে। ফুলি পাড়া ছেড়ে কাজের সন্ধানে অন্য জায়গায় চলে যায়। ফুলি মাঝেমধ্যে এসে আড়াল থেকে দেখে বুঝতে পারে তার ছেলে ভালো আছে, আদরে আছে। দুঃখে আনন্দে সে চোখের পানি মুছে। হঠাৎ একদিন বাড়ির দরজায় তালা দেখতে পায়। আশেপাশের লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তাঁরা বিদেশে চলে গেছে। একথা শুনে মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরল সে।
ফুলি পাগল প্রায় বিশ বছর। পাগল অবস্থা ফুলি এদিক সেদিক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎ ফুলি একদিন হাঁটতে হাঁটতে যে বাড়িটি সামনে ছেলেকে রেখে হারিয়ে ছিল সেখানে সে হাজির। গেট থেকে তখন একটি ছেলে গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছিল। গেটের সামনে পাগলটা থাকার কারণে গেট খোলা সম্ভব হচ্ছিল না।
দারোয়ান পাগলকে সরাতে চেষ্টা করে ছেলেটিও গাড়ির হর্ন দেয়। পাগল অনড় কিছুইতে সরে না। পাগলের চোখে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে ছেলেটি। চেতনায় একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। আপনজনের মত এমন আবেগময় দৃষ্টি সে আগে কখনও দেখেনি। ফুলিও ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর ফুলি প্রায় প্রায় বাড়ির সমনে এসে দাঁড়ায়। একদিন ফুলের শারীরিক অবস্থা ভালো অনুভব করায়। দারোয়ান জিজ্ঞাস করে ছেলেটির কথা।
দারোয়ান বলে, সাহেব তো বিদেশ চলে গেছে। ফুলির চেতনায় বিশ বছর আগের সেই বজ্রাঘাত অনুভব করে। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর কোনদিন সেই স্বাভাবিক চেতনা ফিরে আসে না। পাগল অবস্থায় ফুলির দিন রাত বছর পর বছর পেরিয়ে যায়।
কবি সাহিত্যিক সুলেখা আক্তার শান্তা