Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the insert-headers-and-footers domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/pratidinsangbad2/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
অপবাদের উত্তরাধিকার-সুলেখা আক্তার শান্তা – Pratidin Sangbad

অপবাদের উত্তরাধিকার-সুলেখা আক্তার শান্তা

শরিফ সবার কাছে ভালো ছেলে হিসাবে পরিচিত। ভাবমূর্তিটি রক্ষায় নিজেও সর্বদা সচেষ্ট। শরিফ উঁচু গলায় বলে থাকে, মিথ্যা আমি বলি না, সত্য কথা বলি, সত্য পথে চলি। আমি হচ্ছি আদর্শবান মানুষ। গরিব হয়েছি তাতে কী? তার জন্য কী ন্যায়নীতি থাকবে না? সবসময় পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে, মাথায় থাকে টুপি। শরিফের বেশভূষা চলা ফিরায় সবাই তাকে ভালো মানুষ বলে জানে। গ্রামে কোন ঘটনা ঘটলে আর সেখানে যদি শরীফ উপস্থিত থাকে অবলীলায় তাকেই সাক্ষী মানা হয়। সেও সাক্ষী দিতে খুব আগ্রহী। শরিফের মা জাহানারা পার্শ্বের বাড়ির মেয়ে লিলিকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনেন। বিয়ের পর দুই পরিবারের মধ্যে খুব আসা-যাওয়া, আনন্দ, উল্লাস চলে বেশ। শরিফ নিজের বংশ গৌরবের দম্ভ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্রকাশ করে। শ্বশুরবাড়ির বংশ তেমন প্রভাবশালী নামকরা না হলেও মোটামুটি। দুই বংশের ভাব প্রভাব তার মনের মধ্যে শক্তিতে পরিণত হয়। পেশা হিসেবে শরিফ অটোচালক। সেবা করা সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শে থাকার উত্তম উপায়। লিলি স্বামী সেবায় নিবেদিত প্রাণ। কখন কি প্রয়োজন সতর্ক দৃষ্টি তার। লিলি স্বামী কাজে বের হলে সঙ্গে গিয়ে কিছু দূরে এগিয়ে দিয়ে আসে। আবার স্বামী আসার শব্দ পেলে দৌড় পেরে গিয়ে নিয়ে আসে। স্বামীর হাতের বোঝাটি নিজের হাতে নেয়। হাতমুখ ধোয়ার জন্য পানি দেয়। মুখ মোছার জন্য গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেগুলি শেষ হলে দ্রুত স্বামীকে খেতে দেয়।
এলাকায় শরিফের সাক্ষীতে কিছু মানুষ বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। তা জেনে লিলি স্বামীকে বলে, আপনি আর কারো কোন ব্যাপারে সাক্ষী দিবেন না।
শরিফ বলে, কেন আমি কী করবো না করবো তা তোকে বলে কয়ে করব?
লিলি বলে, না আপনি যেটাই করবেন আপনার ইচ্ছাতেই করবেন কিন্তু তাতে যেন মানুষ কষ্ট না পায়।
কে কী বলল সেটা নিয়ে আমি ভাবি না। আমি কী করবো তা আমি জানি। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ বুঝে ফেলে শরিফ কোন কথাই সত্যি বলে না। সে মিথ্যা বলে মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়। শরিফের মিথ্যা বলার কারণে কেউ কেউ শরীফের সঙ্গে গন্ডগোলও করে। গন্ডগোলের কারণে লিলি স্বামীকে বলে, নিজের খেয়ে নিজের পড়ে সাক্ষী দেওয়া নিয়ে মানুষের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ হবে! আপনি কারো কোন ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন না।
মানুষ আমাকে মানে তাই আমি বলি। তোর কিছু বলতে হবে না তুই চুপ করে থাক। বউয়ের সঙ্গে বাদানুবাদ দিনে দিনে নির্যাতন পর্যন্ত গড়ায়। ক্রমেই তা বাড়তে থাকে। শরীফের নির্যাতনের কারণে সংসার টিকে না। ভেঙ্গে যায় শরিফ আর লিলির সংসার।
শরীফ দ্বিতীয় বিয়ে করে শীলাকে। শরীফের আগের স্ত্রীর চেয়ে শীলার বাপের বাড়ির অবস্থা ভালো। অবস্থা ভালো হলেও মেয়েকে তারা বিয়ে দিছে কারণ মেয়ের আগে দুটি বিয়ে আছে। এ বিষয়টা শরীফের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় না। সেভাবে তারও তো আগে একটি হলেও বিয়ে আছে। তাছাড়া শিলার হাতে বেশ ভালো টাকা পয়সা আছে। প্রথম স্ত্রী লিলি যেমন স্বামীর সেবা যত্নে নিবেদিত ছিল শিলা তেমন না। শরীফ একদিন বলে, তোমার টাকা পয়সা আছে, ওগুলো জমিয়ে রেখে লাভ কী? আমাকে দাও আমি আমার কাজে খাটাই।
শিলা বলে, কেন আমি তোমাকে টাকা দেবো? আমার টাকা সেটা আমারই থাকবে। বললেই টাকা দিয়ে দিবে এটা তুমি কী ভাবলে করে!
শরীফও নাছোড়বান্দা টাকার জন্য বউয়ের সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকে। শিলার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে। সে একটা শিক্ষা দিতে চায়। তোর সংসারে বসে তোকে শায়েস্তা করব। শিলা যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মামলা দেয় শরিফের নামে। শরিফ গ্রামে গিরিঙ্গিবাজী করে যত বাহাদুরি দেখায় কিন্তু থানা পুলিশে সে খুব ভীতু। শরীফ বলে শীলাকে, তুই যখন আমার নামের মামলা করলি আমি তোকে নিয়ে সংসার করবো না। শিলা স্বভাবে উগ্র, কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তার ঝাঁঝালো উত্তর, আমি তোকে শায়েস্তাও করব তোর ভাতও খাব। শিলার সঙ্গে শরিফ পেরে ওঠে না। গ্রামের কয়েকজন ভাবে শরিফ তো গ্রামেরই ছেলে, বউয়ের সঙ্গে কথা বলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিটমাট করে দেওয়া যাক। দুজনে একসঙ্গে যাতে সংসার করতে পারে সবাই মিলে তেমন ফয়সালা করে দেয়। শরীফ মামলা থেকে অব্যাহতি পায়। গ্রামের অনেকে বলে শরীফ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে অন্যকে বিপদে ফেলতো। আজ নিজের ঘরের আগুনে নিজেই পুড়িয়েছে বাইরের কাউকে আগুন দিতে হয় নাই। স্বামী-স্ত্রীর সংঘাত একসময় প্রশমিত হয়।
শিলা উসকে দেয় স্বামীর পুরনো স্বভাবকে। গ্রামে কারো কোন দ্বন্দ্ব থাকলে সমাধান তো দূরের কথা সেখানে স্বামী স্ত্রী মিলে দ্বন্দ্ব আরও জটিল করে দেয়। তারপর এক পক্ষকে বলে, কিছু টাকা দাও তোমার পক্ষ হয়ে কথা বলবো। সে যদি টাকা না দিতে চায় তাহলে তার বিপক্ষে কথা বলে নতুন ফ্যাসাদ তৈরি করে দেয়। কারো দ্বন্দ্ব দেখলে শরীর আর শেফালী খুব আনন্দ পায়। কুটিল মানসিকতায় তারা যেন এককে অপরের পরিপূরক। কোন ছেলে মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে তাদের নামে নানা কথা রটিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। সব ব্যাপার যেন কেমন করে তাদেরই সামনে পড়ে যায়। কারো কোন ক্ষতি করার চেষ্টা শরিফ আর শিলা কুটনামিতে সফল হয়।
দুলাল শরীফকে বলে, তুই মানুষের যে ক্ষতিগুলো করিস? তাতে কী তুই সুখ পাস? শরীফ প্রতিবাদ করে, এমন কথা কেউ বলতে পারবেনা আমি কারো ক্ষতি করি। জোর গলায় বলতে পারি আমি মানুষের উপকার করি কারো কোনো ক্ষতি করি না।
দুলাল বলে, এই অঞ্চলের সবাই জানে তুই আর তোর বউ কেমন? আর তোর পাঞ্জাবি, পায়জামা, মাথার টুপির কোন দোষ না। দোষ ভিতরে মানুষটার।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা মানুষ বলতে পারবে কারো কোন ক্ষতি করেছি? শরিফ দুলালের কথায় রাগে চিৎকার করে মানুষ জড়ো করে ফেলে। সঙ্গে শিলাও যোগ দেয়। সমস্বরে বলতে থাকে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনের মতো এই তল্লাটে কয়জন মানুষ আছে? কারো কোন বিপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করি। আর দুলাল বলে কী? এটা তো আমি মেনে নিতে পারি না! না এদের সঙ্গে কথায় পারা যাবে না, যেমন স্বামী তেমন বউ! দুলাল কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। তাদের সম্মিলিত আক্রমণের ভয়ে কেউ আর তেমন কিছু বলতে আগ্রহী হয় না।
শরিফ আর শিলার দুই মেয়ে। বড় মেয়ের রিতা ছোট মেয়ে লতা। রিতা চুপচাপ স্বভাবের আর লতা পেয়েছে বাবা-মা স্বভাব এমন কী আগ বাড়িয়ে কথা বলে। রিতা আর আরিফের ভালোবাসার সম্পর্ক প্রায় দুই বছরের। রিতা আরিফকে বলে, তুমি এবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও। এমন কথা শুনে আরিফ চমকে ওঠে।
রিতা বলে, কী ব্যাপার তুমি আমার কথা শুনে মনে হয় ভয় পেয়ে গেলে!
আরিফ বলে, দেখো আমি তোমাকে বিষয়টা বলিনি। তোমার আমার সম্পর্কটা আমার বাবা মা জেনে গেছে। এমন কী তারা আমাকে বলেছে তোমার সঙ্গে যাতে আমি সম্পর্ক না রাখি। তার কারণও তারা আমাকে বলেছে। কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি বলে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারিনি।
রিতা বলে, কেন আমি কী তোমার যোগ্য নই?
ভালোবাসা যোগ্য ও অযোগ্য দেখে হয় না, ভালোবাসা হয় মনের ভালো লাগা থেকে।
ভালোই যদি বাসো তাহলে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাচ্ছ কেন?
আমার বাবা-মা তোমার বাবা মাকে চেনে জানে, তোমার বাবা মা মানুষকে অশান্তিতে রাখে। আমার বাবা মার ধারণা যার বাবা-মা এমন তখন তাদের সন্তানও তেমনই হবে! তাই তাদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে অমত। রিতা কান্নাকাটি করে। একজনের শাস্তি আরেকজনকে পেতে হবে কেন? যে অপরাধী তার শাস্তি তার উপর পড়ে না কেন? বাবা মায়ের অশান্তির শাস্তি কী তাহলে আমাকে ভোগ করতে হবে? আরিফ বলে, দেখো আমি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু আমার এমন সাহস নেই যে বাবা-মার অমতে তোমাকে বিয়ে করি।
রিতা বাড়ি যায়, শুধু কান্নাকাটি করে। খাওয়া-দাওয়া করে না। শিলা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে কী হয়েছে জানতে চায়। কিন্তু রিতা বলে না। মায়ের অনেক পীড়াপীড়িতে রিতা মায়ের কাছে বলে।
শিলা বলে, তুই কান্নাকাটি করিস কেন? ওই ছেলে তোকে বিয়ে না করে কিভাবে দেখি। ওই ছেলের নামে আমি মামলা ঠুকে দেবো না!
মা সব ব্যাপার জোর করে হয় না। আর মামলা দিতে চাচ্ছো এতে কী তোমার মান সম্মান বাঁচবে? থানা পুলিশ করে জানাতে চাচ্ছো তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না?
এখানে মান-সম্মান যাওয়ার কী দেখলি? কোর্ট কাচারি খুলে বসছে মানুষ তাহলে কিসের জন্য?
শিলা আরিফের বাড়ি যায়। আরিফের বাবা মনসুর আহমেদের সঙ্গে শিলা কথা বলে, আপনার ছেলে আমার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে এখন বিয়ে করতে চায় না! আমি জানাতে এসেছি ছেলে বিয়ে করবে কিনা না হয় আমি মামলা করব। মামলার কথা শুনে মনসুর আহমেদ ভয় পায়। সে বলে, ঠিক আছে আপনার কিছু করতে হবে না। আপনার মেয়েকে ছেলের বউ করে আনব।
আনবেন ভালো কথা, একটা কথা আছে। বিয়েতে যে খরচ খরচা হবে সেটা বহন করে মেয়েকে বউ করে আনতে হবে। মনসুর আহমেদ তাতেও রাজি হয়। ক্ষীণ আশা, মা বাবা যেমনই হোক মেয়ে তো তেমন নাও হতে পারে। মনসুর আহমেদ রিতাকে ছেলের বউ করে আনে। রিতা শ্বশুরবাড়ি থাকে।
শরিফ আর শিলার ছোট মেয়ে লতার জন্য বিয়ে ঠিক করে একই বাড়ির একই এলাকার ছেলে নাদিমের সঙ্গে। মেয়ের বিয়ের জন্য শরিফের পক্ষ থেকে প্রস্তাব যায় নাদিমের বাবা মার কাছে। নাদিমের বাবা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। শিলার রাগ হয়। সে নিজের জেদ আর আক্রোশ মিটাতে নাদিমের নামে অপবাদ রটাতে থাকে। তার ছোট মেয়ে লতার সঙ্গে নাদিম সম্পর্ক করছে এখন বিয়ে করতে চায় না। এমন কথা শিলা নিজেই গ্রামের লোকের কাছে বলে বেড়ায়। তার পুরনো কৌশল। এমন কথা বললে, নাদিমের বাবা মা বাধ্য হবে ছেলেকে বিয়ে করাবে। এই পরিস্থিতিতে নাদিমের বাবা ফয়সাল আহমেদ ছেলেকে দ্রুত বিদেশ পাঠিয়ে দেয়। এদিকে গ্রামের লোকজন লতাকে নানান বিষয়ে খোটা দেয়। অপবাদের পর অপবাদ রটাতে থাকে। লতার সঙ্গে সম্পর্ক করে নাদিম বিয়ে না করে বিদেশ চলে গেছে। গুজবের ডালপালা দ্রুত গজাতে থাকে। সে গর্ভবতী এমন কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। লতা লজ্জায় ঘৃণায় স্তম্ভিত। বাবা মা ভালো করতে গিয়ে একি সর্বনাশ করলো তার। কারো মুখে যেন কথা থামে না। লতাকে নিয়ে চলতে থাকে অবিরাম কথা। মানুষের সামনে মুখ দেখানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। লতা সইতে না পেরে অবশেষে আত্মহত্যা করে। শরিফ আর শিলা পরের সর্বনাশ করতে গিয়ে আজ তাদের ঘরেই সর্বনাশ হলো। লোকজন সবাই একজোট হয়ে মেয়ের মৃত্যুর জন্য শরীফ আর শিলাকে দায়ী করে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেয়। পুলিশ ধরে নিয়ে যায় শরিফ আর শিলাকে। দুজনের সাজা হওয়ায় জেল হাজতেই কাটে দিন। কোন কোন পাপের শাস্তি দুনিয়াতেই দৃশ্যমান হয়। সম্পত্তির মতো অপবাদের উত্তরাধিকারও বহন করতে হয় উত্তরাধিকারীদেরই।