জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোট গ্রহণে ইভিএম তথা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে যে ‘কারসাজি’ করা সম্ভব- সেটা এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাই বুক ফুলিয়ে বলছেন। এমন ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতির জের ধরে সর্বশেষ পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নাজিরপুর-তাঁতেরকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচনই স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
এর আগে গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ইভিএম নিয়ে যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে ইভিএমে গৃহীত ওই নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। গত দুই মেয়াদে সেখানে বিএনপি মনোনীত মেয়র এবং এবার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করায় বিএনপি থেকে বহিস্কৃত মনিরুল হক সাক্কু অল্প ব্যবধানে হারেন। কুমিল্লার নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, যা খতিয়ে দেখা দরকার। বিশেষত ইভিএম নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলো।
প্রথমত, কুমিল্লার নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহূত হয়েছিল ৬টি আসনে, বাকি ২৯৪টি আসনে নির্বাচন হয় ব্যালট পেপারে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২৯৪ আসনে, যেখানে ব্যালট পেপারে ভোট হয়েছে, ভোট পড়েছিল ৮১ শতাংশ। অন্যদিকে যে ৬ আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছে, সেখানে ভোট পড়েছিল প্রায় ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ পার্থক্য। তার মানে, যেখানে ব্যালট পেপারে ভোট হয়েছে সেখানে কারসাজি করা হয়েছে; না হয় যেখানে ইভিএমে ভোট হয়েছে, সেখানে মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
২০১২ সালে কুমিল্লা নির্বাচনে, যেখানে একটি ভিন্ন মডেলের ইভিএম ব্যবহূত হয়েছিল, যাতে বয়োমেট্রিক্স ছিল না; ভোট পড়েছিল প্রায় ৭৫ শতাংশ। পরে ২০১৭ সালে ব্যালট পেপারে ভোট পড়েছিল ৬৪ শতাংশ। এবারে বায়োমেট্রিক্স-ভিত্তিক ইভিএম ব্যবহারের কারণে সেখানে ভোট পড়েছে ৫৯ শতাংশ। ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে, বায়োমেট্রিক্স-ভিত্তিক ইভিএম কর্তৃক শনাক্ত না হতে পেরে অনেকে বিরক্ত হয়ে ভোট না দিয়ে ফিরে গেছেন। ফলে এটি সুস্পষ্ট- কুমিল্লায় ইভিএম মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। যে ইভিএম নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করে, সে যন্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
কুমিল্লা সিটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু ইভিএম এখানে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। বলা হয়, ইভিএমে সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল আসার কথা। কিন্তু চারটি কেন্দ্রে চার ঘণ্টা পরে কেন ফলাফল এলো? নির্বাচন কমিশনকে এর সুষ্ঠু তদন্ত করে সন্দেহের অবসান ঘটাতে হবে। ইভিএম নিয়ে অনেক আগেই কথা উঠেছে- এটি যথোপযুক্ত নয়। কারণ, এখানে ভোট পুনর্গণনার সুযোগ নেই। ভোট নিয়ে ইসি যে তথ্য দেবে, সেটাই মেনে নিতে হবে। প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী, যিনি ইসির কারিগরি কমিটির প্রধান ছিলেন, এসব দুর্বলতার কারণে তিনি বর্তমান ইভিএম কেনার সুপারিশে সই করেননি। এ ছাড়া অনেক দেশই ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে এসেছে। যদিও এখন পর্যন্ত ইসি কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা আসেনি, কিন্তু নির্বাচন কমিশনারদের মরিয়া হয়ে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের প্রচেষ্টা সন্দেহের উদ্রেক না করে পারে না। সন্দেহের মূল কারণ হলো, সরকার চাচ্ছে ইভিএম ব্যবহূত হোক।
এ ছাড়া কুমিল্লার নির্বাচনের প্রথম পরীক্ষায়ই নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কমিশনের দায়বদ্ধতা কেবল জনগণের কাছে। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংগঠিত করাই কমিশনের কাজ। নির্বাচন কমিশন তার সক্ষমতা প্রদর্শন করে বিদ্যমান বিধিবিধান প্রয়োগের মাধ্যমে। কুমিল্লাতে তারা সে সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। কিছু চুনোপুঁটির ক্ষেত্রে সক্ষমতা দেখালেও কুমিল্লায় রাঘববোয়ালের ক্ষেত্রে কমিশন তা দেখাতে পারেনি। ফলে কমিশনাররা তাঁদের শপথ অনুযায়ী কর্তব্য পালন করছেন কিনা- প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
কুমিল্লা নির্বাচনে এটি সুস্পষ্ট- ইসি আইনকানুন, বিশেষত আচরণবিধির ৩১ ও ৩২ ধারা কঠোরভাবে প্রয়োগ করেনি। স্থানীয় আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহারের ক্ষেত্রে কমিশন অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। সংসদ সদস্য অবশ্য আচরণবিধির বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যমান আচরণবিধি তো এখনও বহাল। তা ছাড়া বাহাউদ্দিনের বিষয়ে প্রথমে তাঁরা এক রকম কথা বলেছেন, পরে বলেছেন সম্পূর্ণ বিপরীত কথা- সংসদ সদস্য আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি, কমিশনও ব্যর্থ হয়নি। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এমন অসংলগ্ন কথা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নির্বাচন কমিশন যদি কুমিল্লায় একজন জাতীয় সংসদ সদস্যকে আচরণবিধি মানতে বাধ্য করতে না পারে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ জন সংসদ সদস্য, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি দল, বিরোধী দল সবাইকে কীভাবে সামাল দেবে? সরকারি লোকজন যদি সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কমিশনকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু কুমিল্লায় কমিশন সেই দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইভিএমের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আরেকটু বলা দরকার। আমরা দেখেছি, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তুমুল উত্তেজনার মধ্যে আরফানুল হক রিফাতকে ৩৪৩ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর মনিরুল হক সাক্কু দাবি করেন, তাঁকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইভিএমে ফল পুনর্গণনার সুযোগ না থাকায় তাঁর অভিযোগ সত্য, নাকি মিথ্যা- প্রমাণ করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ ইভিএমের নির্ভরশীলতা নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। এই দুর্বলতার কারণেই ভারতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি অর্থাৎ পেপারট্রেইল সংযুক্ত করতে বাধ্য হয়। আমরা মনে করি, ভিভিপিএটি-বিহীন ইভিএমের ব্যবহার থেকে আমাদের নির্বাচন কমিশনের সরে আসা আবশ্যক।
এ বর্তমান অবস্থা ভালো কোনো ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবহ নয়। ইভিএমের দুর্বলতা, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিরোধী দলগুলোর আস্থার ঘাটতি এবং আইনকানুন প্রয়োগে সক্ষমতার অভাবের কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, তা নিয়ে অনেকের মনে যে সন্দেহ দানা বাঁধছে, তা আমাদের জন্য এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে। নির্বাচনের সময় যদি সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ আচরণ না করে; রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত সরকারি দল যদি সদাচরণ না করে এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ যদি যথার্থ নজরদারি করতে না পারে, তাহলে গ্রহণযোগ্য আগামী নির্বাচনের আশা দুরাশাই থেকে যাবে। আমাদের সবার অনুধাবন করা দরকার, ২০১৪ কিংবা ‘১৮ সালের নির্বাচনের মতো আরেকটি নির্বাচন দেশকে ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করতে পারে, যা কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)