আজ ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুখের গৃহকোণ-সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক

বড় কষ্ট হয় যখন সাদিয়ার মুখের দিকে তাকাই। সারাদিন না খেয়ে আছে। ওর মুখে আমি কোন খাবার দিতে পারিনি। আমি তখন শান্তি পাই যখন ওর মুখে খাবার দিতে পারি। বউয়ের মুখে এ কথা শুনে মনির চেঁচিয়ে ওঠে। এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগেনা, ব্যথায় আমার বুক ফেটে থেকে উঠে। পঙ্গু পা নিয়ে পারিনা কাজ করতে। কেউ আমাকে এই অবস্থায় কাজও দেয় না।
তুমি উত্তেজিত হইও না। যা নসিবে লেখা আছে তাতো হবেই।
বাবা মনির তোরে দেখে আমার বড় আফসোস হয়। আমার পয়সা কড়ির অভাব নেই। তারপরও মনে আমার সুখ নেই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা বলে আনজুমারা।
চাচি আপনার আবার কি হলো?
বাবা ছেলে-মেয়ে, টাকা-পয়সা, সবই আমার ভরপুর। তারপরও ঘর আমার শূন্য। ছেলে-মেয়ে সব থাকে প্রবাসে। তাদের মুখখানা আমি দেখতে পাইনা। একা একা থাকি বাসায়। বাবা তোকে একটা কথা বলতে চাই। তুই তোর ছোটবোন সাদিয়াকে যদি আমাকে দিতি তাহলে আমার জন্য ভালো হতো।
চাচি এ আপনি কি বলেন! আমি গরিব হতে পারি। খাবার না জোটাতে পারি। তাই বলে, নিজের বোনকে দিব অন্যের কাছে! না চাচি না এ আমি পারব না।
বাবা তোর বোন তোরেই থাকবে। পানি কাটলে কোনদিন দুই ভাগ হয়! তেমনি তোর আর তোর বোনের সম্পর্ক আলাদা হবে না। আমার বয়স হয়েছে একা থাকি। সাদিয়া ছোট মানুষ চোখের সামনে হাঁটাচলা করলে আমার ভালো লাগবে। বাবা তুই আর না বলিস না। আমি তোকে একটা দোকান করে দেই তা দিয়ে তুই আয় রোজগার করে খা। মনিরা আশ্চর্য হয়ে বলে, চাচি এসব আপনি কি বলছেন? আমার বোনকে দিয়ে আপনার কাছ থেকে টাকা নিব। বাবা রাগ করিস না, তোকে আমি টাকা সেই হিসেবে দিচ্ছি না। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। ছেলে-মেয়েরও অবস্থা অনেক ভালো তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়েছে। আমার যে টাকা পয়সা আছে এটা তাদের দরকার হয়না। মনিরের স্ত্রী মাহি মলিন মুখে পাশে বসে কথা শুনছে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে, তোমার অবস্থা খারাপ দেখে তাই হয়তো চাচির মায়া হয়েছে। উনি মনে হয় ভাবছেন দোকান করে দিলে তুমি হয়তো নড়েচড়ে খেতে পারবে। কথার মধ্যে সাদিয়া দৌড়ে এসে ভাই মনিরের গলা জড়িয়ে ধরে। মনির বলে, চাচি দেখেন আমার বোনের কান্ড, আমাকে ছাড়া সাদিয়া কিছু বোঝেনা। সাদিয়াকে দিয়া, আমি কিভাবে থাকবো।
আনজুমারা বলে, যখন মন চাইবে তখন তোর বোনকে দেখে আসিস। মনির ভাবে, আমিতো বোনের খাওয়া-পড়া দিতে পারিনা, চাচির কাছে থাকলে বোনটা অন্ততপক্ষে ভালো থাকবে। চাচি আপনি আমাদের গুরুজন, আপনি যা বলেন তাই হবে। আনজুমারা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে, মনির বাবা এই টাকা দিয়ে তুই একটা দোকান দিস। চাচি আমার টাকা লাগবে না। আপনি সাদিয়াকে লালন-পালন করে একটা ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েন।
আচ্ছা বাবা। সাদিয়ার পড়া-লেখা, বিয়ে-শাদী ওর সমস্ত কিছুর ভার আজ থেকে আমার উপর। এসব নিয়ে ভাবিস না। বাবা, এই টাকাগুলি রাখ। এটা কোন বিনিময় নয় ভালোবেসে দিলাম। সসংকোচে মনির টাকাগুলি গ্রহণ করে। বউ মাহিকে বলে, সাদিয়ার জামা কাপড় গুছিয়ে দিতে।
আনজুমারা বলে, জামা কাপড় দিতে হবে না। সাদিয়া যে কাপড় পড়ে আছে তাতেই হবে। আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে নতুন কাপড়-চোপড় কিনে দেবো। মাহি সাদিয়াকে ধরে কান্নাকাটি করে। বোনের জন্য কান্নায় মনিরের গলা বুজে আসে। মনের গভীরে নিরব আর্তনাদে বলে ওঠে, হায়রে অভাব আপনকে পর করে দেয়। সামান্য ভাত-কাপড়ের জন্য রক্তের সম্পর্ক দূরে ঠেলে দেয়। আনজুমারা ঢাকায় চলে আসে সাদিয়াকে নিয়ে। শৈশব কলরবে ছোটাছুটিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বাসার পরিবেশ। আনজুমারার নিরব একাকীত্বের অবসান হয়। ভালো লাগে তাঁর। বিত্ত প্রাচুর্যের মাঝে সাদিয়ার মন থেকে বিগত জীবনের স্মৃতি ক্রমশ ম্লান হতে থাকে। বাড়ি, ভাই-ভাবির কথা প্রায় যেন ভুলে গেছে সে!
এদিকে মনিরের দিনকাল ভালোই কাটছে। আনজুমারার দেওয়া টাকার দোকানটা বেশ ভালো চলছে। দোকানের আয়-রোজগার ভালো। বউকে নিয়ে তার দিন এখন ভালোই কাটাছে। সুখে থাকলেও বোন সাদিয়ার কথা তার খুব মনে পড়ে। রাতে ঘুমাতে গিয়ে বোনের কথা মনে পড়ে খুব কাঁদে। স্বামীর কান্নায় মাহি বলে, তুমি কাঁদো কেন? তা আমি বুঝি। সাদিয়ার কথা মনে করে প্রতিরাতেই তুমি কাঁদো। আমি বলিকি তুমি সাদিয়াকে একবার দেখে আসো।
যাব যে আমি তো ঠিকানা জানিনা!

বছর তিনেক পর আনজুমারা সাদিয়াকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আসে। মনিরকে বলে, দেখ কাকে নিয়ে এসেছি চিনতে পারিস কিনা। মনিরের চোখে বিস্ময়! বড় বড় চোখ করে বলে, ওমা আমার বোনকে তো চেনাই যায় না। মনির আদর করে বোনকে কাছে নেয়। সাদিয়া নাক মুখ কুঁচকে বলে ওঠে, এই তুমি আমাকে ধরছ কেন? ইস গায়ে কি গন্ধ!
হ্যাঁ বোন। কাজ করে এসেছি, তাই গা থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। আনজুমারাকে মা ডাকে সাদিয়া। সাদিয়া রাগ করে বলে, মা তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন? আমি এখানে থাকবো না, আমি ঢাকায় যাব।
মাহি বলে, বোন তুই এসব কি বলিস? এটা তোর বাড়ি। তোর জন্য তোর ভাই কত কান্নাকাটি করে আর তুই আমাদের ভুলে গেছিস!
সাদিয়া উত্তেজিত হয়ে, মা তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনির আর মাহি দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়। দু’জনেই ভাবে সাদিয়া কেমন বদলে গেছে। মাহি সাদিয়ার জন্য অনেক কিছু আয়োজন করে। সাদিয়া যে সকল জিনিস পছন্দ করে পিঠা-পায়েস মাহি তার সকল কিছুই আয়োজন করে। কিন্তু সাদিয়া কিছুই মুখে দেয় না। এতে মনির আর মাহি কষ্ট নেয় না। ভাবে সাদিয়া ছোট মানুষ তাই এমন করছে। গ্রামের পরিবেশ ভালো লাগেনা সাদিয়ার, সে খুব উতলা হয়ে পড়ে তাকে নিয়ে তার মা কখন ঢাকায় ফিরবে। সাদিয়ার এমন অস্থিরতায় আনজুমারা সাদিয়াকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।
আনজুমারা বলে সাদিয়াকে, তোর ভাই তোকে কত আদর করে আর তু্ই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায় না! তাতে সাদিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে, মা আমি তোমার পরিচয় পরিচিত হতে চাই। আমি চাইনা ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
আনজুমারা মেয়েকে বলে, মা তুই আমার পরিচয় বড় হবি। তারপরও তো মনির তোর মায়ের পেটের ভাই। এই বন্ধন কি চাইলেই ছিন্ন করা যায়? তাছাড়াও তো তোর ভাই-ভাবি তোকে অনেক ভালোবাসে।
মা আমি ওদের ভালোবাসা চাইনা। আমি তোমার ভালোবাসা চাই।
আমি তোমাকেই ভালোবাসি। আনজুমারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সন্তানরা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। কি জানি তাদের মায়ের কথা মনে পড়ে কিনা।
মা এত সন্তান সন্তান করোনা তো! আমিই তোমার সন্তান। আমার সামনে যখন তুমি তাদের কথা বলো, তখন আমার হিংসা হয়।
আনজুমারা হেসে বলে, ওদের কথাতো মনে পড়ে আমি যে মা। আমি তোকেও ভালোবাসি।
ভালোবাসো, তারা তো তোমার সামনে নেই, আমি তো তোমার চোখের সামনে থাকি। আর সারা জীবন তোমার সন্তান হয়ে থাকতে চাই। আনজুমারা সাদিয়াকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে।

লেখক-সুলেখা আক্তার শান্তা

সাদিয়া এমন পরিবেশে বড় হয়েছে তার মন-মানসিকতায় ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। মনির যে সাদিয়ার ভাই, আজ তা সাদিয়ার কাছে বেমানান। সাদিয়া তার ভাইকে কিছুতেই মানতে চায় না। তার ভাবনা সে পড়ালেখা জানা মেয়ে। কোথায় কে পড়ে আছে এই নিয়ে সে ভাবতে চায় না। তার স্বপ্ন চিন্তা চেতনা আকাঙ্ক্ষা অন্যরকম।
একরাতে সাদিয়ার আর আনজুমারা ঘুমিয়ে আছে। গভীর রাতে কর্কশ কন্ঠের শব্দে সাদিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। আতঙ্কিত সাদিয়া দেখতে পায় কয়েকজন ডাকাত অস্ত্র হাতে তার মাকে ঘিরে রেখেছে। আনজুমারাকে ডাকাতের লোকজন বলে, দ্রুত আমাদের কাছে সব বের করে দে। নয় জানে মেরে ফেলবো। আনজুমারা যেখানে যা ছিল সবকিছু ডাকাতের হাতে তুলে দিলেও তাঁর জীবন রক্ষা পায় না। ডাকাতের দল সবকিছু নেওয় পরও আনজুমারাকে গুলি করে মেরে ফেলে। আনজুমারা মৃত্যুতে সাদিয়া মা বলে চিৎকার করে ওঠে! ডাকাত দলের সর্দারের চোখ পড়ে সাদিয়ার দিকে। ওরে সুন্দরী, তুমি তো বেশ সুন্দর। একথা শুনে সাদিয়ার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। ডাকাত সর্দার সাদিয়ার হাত ধরে বলে, তোমাকে কিছু বলব না। আমার বেশ ভাল লেগেছে তোমাকে। সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার জীবনসঙ্গী বানাবো তোমাকে। সাদিয়া কেঁদে বলে আমাকে ছেড়ে দাও।
না সুন্দরী, তোমাকে ছাড়া যাবে না। তোমাকে আমার রানী করে রাখবো। ডাকাতের দৃষ্টি পরেছে যখন তখন কি আর সাদিয়া রক্ষা পায়। সাদিয়াকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। সাদিয়াকে নিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখে। সাদিয়া কোনভাবেই সেখান থেকে বের হতে পারে না। সাদিয়া যতই কাকুতি মিনতি করে, তাতে কোন কাজ হয়না। ডাকাত সর্দার রঞ্জু বলে, তুমি যতই কান্নাকাটি করো না কেন? আমার কাছ থেকে তুমি ছাড়া পাবে না। তুমি কোন কিছু না ভেবে আমার কথায় রাজি হয়ে যাও। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
সাদিয়া বলে, তোর মত ডাকাতকে বিয়ে করবো আমি! রঞ্জু ডাকাত হলোও সাদিয়ার সঙ্গে কোনো জোর জবরদস্তি করেনা। সাদিয়ার কথায় রাগ হতো না। তার একটাই সাদিয়ার কাছ থেকে চাওয়া, সে সাদিয়াকে তার জীবনসঙ্গী করতে চায়।
সাদিয়া ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, আমি তোকে বিয়ে করবো? আমার চোখের সামনে আমার মাকে মেরে ফেলছিস। আমি ডাকাত, ডাকাতেরা ডাকাতি করতে হলে, তখন তার মনুষ্যত্ববোধ থাকেনা! তোমাকেও আমি মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে মারি নেই, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। আর এখান থেকেই তোমার পালানোর কোন ব্যবস্থা নেই। আমি চাইলেই তোমাকে ধর্ষণ করে ছেড়ে দিতে পারতাম, কিন্তু আমি তা করিনি। সাদিয়া ভেবে দেখে আসলে ডাকাতরা এমনই হয়। আর এখান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। রঞ্জু আর সাদিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ে হলেও সাদিয়া আত্ম দংশনে জর্জরিত হতে থাকে। ভাবে একজন ডাকাত তার স্বামী। তখন তার সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়। তার মধ্যে সাদিয়ার গর্ভে আসে বাচ্চা। সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই বাচ্চাকে কি পরিচয় মানুষ করবে। অনুভব করতে থাকে একজন ডাকাতের সন্তান হওয়ার মর্মযাতনা। যার জীবনে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে সেই বোঝে এর নিদারুণ যন্ত্রণা। সাদিয়ার সন্তান দুনিয়ার মুখ দেখে। সাদিয়া নিজের জীবন নিয়ে যতটা না ভাবে সন্তান নিয়ে তার চিন্তা ততোধিক বেড়ে যায়! সে সুযোগ খুঁজে কিভাবে এখান থেকে বের হওয়া যায়। অবশেষে সাদিয়া সুযোগ পেয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে সে আর সময় নষ্ট না করে। সন্তান নিয়ে সে বেড়িয়ে পড়ে। সে ভাবতে থাকে কোথায় যাবে। তার মা জীবিত নেই! কোথায় আশ্রয় নেবে সন্তান নিয়ে কূলকিনারা করতে পারে না। তখন মনে পড়ে যায় ভাইয়ের কথা। সে দ্রুত রওনা দেয় ভাইয়ের কাছে। বাড়িতে পৌঁছে ভাই-ভাবির হাত-পা ধরে মাফ চায়। ভাই-ভাবি তোমরা আমাকে মাফ করে দাও। একদিন আমি তোমাদের প্রতি অন্যায় করেছি। তোমরা আমার পরম আপনজন অথচ তোমাদের পর করে রেখেছিলাম। আমার গরিমা আমাকে অন্ধ করে ফেলেছিল। সেই জন্য আজ আমার এমন অধঃপতন। মনির এত বছর পর বোনকে পেয়ে মহাখুশি। বোন তুই এসব কি বলছিস? মাহিরও একই কথা। আমরা তোকে ফিরে পেয়েছি আর কিছু চাইনা। সাদিয়া ভাই-ভাবির কাছে সমস্ত কথা খুলে বলে।
মনির বোনের সমস্ত কথা শুনে বলে, বোন তুই আমার কাছে থাকবি। আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছে। আল্লাহর রহমতে তোকে আর তোর সন্তানকে পালনে আমার কোনো সমস্যা হবে না। সাদিয়া বলে, যে ভাইকে পঙ্গু বলে অবজ্ঞা করেছি। অবশেষে সেই ভাইয়ের কাছে আমি আশ্রয় পেয়েছি। মেয়েকে নিয়ে এটাই আমার আপন ঠিকানা। এখানে সুখের নেই শেষ। পৃথিবী এভাবেই টিকে আছে আপনের বন্ধন সুখের গৃহকোণ।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ