আজ ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বর্ণহীন বন্ধন-সুলেখা আক্তার শান্তা

 

ছেলেটা কোথায় গেলো। মনটা আমার ছেলের জন্য ছটফট করছে। আবির একটু চোখের আড়াল হলে বুকটা আমার
কেপে উঠে। মনে আমি শান্তি পাই না। না আবির তো আসেনা। অস্থিরতায় নাহিদা এদিক ওদিক পায়চারি করে। পথের
দিকে তাকিয়ে থাকে। দুশ্চিন্তায় কি করবে ভেবে পায় না সে।
ফুপু তুমি এত অস্থির হচ্ছ কেন?
বাবা, আবির বাড়ি থেকে সেই কখন বাহির হইছে এখনো আসছে না!
ফুপু তুমি আবির ভাইকে নিয়ে বেশি চিন্তা করো। তোমার আরও ভাইদের ছেলে-মেয়ে আছে তাদের নিয়ে তো এতো
ভাবো না। তোমার মুখে শুধু একই কথা আবির আর আবির।
একথা বলিস কেন? তোর আমার কেউ পর?
পর নাহলে, দেখিতো তুমি সবসময় আবির ভাইয়ের ব্যাপারে বেশি বেশি করো। খাইলো কিনা, পরলো কিনা, কোথায়
গেলো, কই তোমার অন্য ভাতিজা ভাস্তির জন্য তো তেমন করোনা!
আবিরের কথা শুধু ভাবব কেন সবাইকে নিয়েই ভাবি। তুই আছিস তোর হিসাব নিকাশ নিয়া। কথার মাঝেই আবিরের
আগমন ঘটে।
ওই দেখো তোমার আদরের গুণধর ছেলে আসছে।
নাহিদা কাছে গিয়া জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে বাবা কই গেছিলি?
সারাদিন তোমার আঁচলের নিচে থাকতে হবে? ফুপু তুমি এত অস্থির কেন?
বাবা জানিস তো? তোকে না দেখে থাকতে পারি না।
আহ থাম তো, আমাকে আমার স্বাধীনতা চলতে দাও। তোমার এই ভাব লক্ষ্য নয় মানুষ অস্থির হয়ে যায়।
বাবা তুই আয় খেয়ে নে। আজ আমার অফিস বন্ধ থাকায় তোর জন্য কত কি রান্না করেছি। আমি তোকে নিজের হাতে
খাইয়ে দিব।
আমি ছোট নয়, আমি এখন বি এ পড়ি। আমার নিজেরটা নিজেকে করতে দাও।
বুঝেছি ছেলে আমার বড় হয়েছে। এরি মাঝে, নাহিদার মেজ ভাইয়ের বউ ফাল্গুনী বকবক শুরু করে। আরে দেখবো না
দেখবো বড় ভাইয়ের ছেলেকে বুকে তুলে নিয়েছে। আর যেন তার কোন ভাইয়ের সন্তান নাই। একাই আছে আবির।
শেষ বয়সে কিরকম দেখে তা দেখবো, যদি বেঁচে থাকি।
নাহিদা বলে, তোমার কথায় এত তেজ কেন? আমি তোমার ছেলে-মেয়েকে কম ভালোবাসি?
সারাদিন তো দেখি আবিরকে নিয়ে তার যত ভাবনা। যে আবিরকে নিয়ে এত আলোচনা সমালোচনা শুনতে হয়
নাহিদাকে। সে ফুপুর দিকে আবিরের কোনো লক্ষণ নেই। নাহিদার বিয়ে হয়েছিল বড় পরিবারে। অকালে স্বামী মারা
যাওয়ার পর বড় ভাইয়ের ছেলে আবিরকে বুকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বসবাস করতে থাকে। নারী জীবনের বঞ্চিত
মাতৃ আকাঙ্ক্ষা আবিরের মাঝে পূর্ণতা খুঁজে। আবিরের মুখে মা ডাক শুনতে বড় ইচ্ছা করে। রাজ্যের সংকোচ এবং
সংস্কার সে পথে বাধা হয়ে থাকে। কেউ বিয়ের কথা বললে নাহিদা বিয়েতে রাজি হয় না। তার জীবন চলার ভরসা
চাকরি আর স্বামীর বাড়ি অর্থ-সম্পদ। স্বামী অর্থ-সম্পদ ভালোই রেখে গেছেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর প্রাপ্য
টাকা যা পেনশন পাবে তাই দিয়ে আবিরের ভবিষ্যৎ জন্য কিছু একটা করে যেতে পারলে মনে শান্তি পাব সে।
আবিরের পড়ালেখা শেষ হয়। সে বলে, ফুপু আমার কিছু একটা করা দরকার।
বাবা তুই কি করতে চাস?
আমি বিদেশ যেতে চাই।
তুই বিদেশ যাবি! আমি তোকে ছাড়া থাকবো কিভাবে? তুই তো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা।

ফুপু কোন কিছু করার আগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ো নাতো। নাদিয়া হাসি দিয়ে, বাবা তোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হোক তাই
আমি চাই।
তাহলে তুমি টাকা পয়সা জোগাড় করো।
নাহিদা ভাই মাজেদের কাছে যায়। আবির বিদেশ যেতে চায়। কি করি বলতো। ছেলের আমার বয়স অল্প।
বুবু তুমি বয়স অল্প অল্প করোনা তো। এখন বোঝার মত তার বয়স হয়েছে। শিক্ষিত ছেলে নিজের দেশে কিছু একটা
করুক। কোন কিছু করার আগে ভেবে চিন্তে করতে বলো।
আমিও চাই ও দেশে একটা কিছু করুক। আবিদ কারো কথা মানতে চায় না। তার একটাই কথা সে বিদেশে যাবে।
নাহিদা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে। আবির বলে, ফুপু তোমার রিটায়েটের টাকা দিয়ে আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দাও।
নাহিদা আবিরের কথাই রাখে। আবিরকে বিদেশে পাঠানো বন্দোবস্ত করে। সকল কিছু ঠিকঠাক হয়। নাহিদার বুক
ফেটে যায়। মনের ব্যথা গোপন করে আবিরকে উপদেশ দেয়। বাবা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। নিজের শরীরের
প্রতি খেয়াল রাখিস। যার স্নেহ ভালোবাসার মানুষ হয়ে বিদেশযাত্রার আয়োজনও হলো সেই ফুপুর জন্য তেমন
প্রতিক্রিয়া নেই আবিরের। বিদেশ যাওয়ার মুহূর্তে নাহিদার কাঁন্নার শুরু সেই কান্নাতে দিন কাটে তার। নাহিদা ছেলের
ফোনের অপেক্ষা করে। কিন্তু তার কাছে আবিরে ফোন আসে না। আবিরের ফোন আসে তার মায়ের কাছে। নাহিদা
জিজ্ঞেস করে আবিরের মা ললিতার কাছে, ভাবি আবিরের ফোন আসে?
ললিতা বলে, না ফোন আসে না। সে যে ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে তা নাহিদা শুনেছে। নাহিদা বুঝতে দেয়না
ফোনে মা ছেলের কথোপকথন সে শুনেছে। আবিরের সাথে কথা বলার জন্য সে অসহায়ের মত অপেক্ষা করতে থাকে।
সে ভাবে, যাকে এত ভালবাসি সে কেন আমাকে এভাবে দূরে রাখে।
একান্তে কেঁদে কেঁদে বলে, আবির বাবা তুই আমার কাছে ফোন কর, তোর মুখের কথা শুনতে আমার বড় ইচ্ছা করে।
তোর জন্য আমার বুকের মাঝে উথাল পাথাল করে। বাবা তোকে তো ভালোবাসায় আমি কোনো কমতি রাখি নাই।
তাহলে কেন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলিস না। মাজেদ বোনের কষ্ট দেখে। আবিরের মা ললিতাকে বলে, তোমার ছেলে
এ কি শুরু করছে। যে ফুপু বুক আগলে ওকে লালন পালন করল। সে ফুপুর কোন খোঁজ রাখে না!
ললিতা বলে, ছোট মিয়া তুমি আমাকে এত কথা বলছ কেন? তোমার ভাতিজাকে তুমি জিজ্ঞেস করো? তোমার বোন
লালন-পালন করছে বলে তুমি খোঁটা মারলা?
অমানুষ, ওকে সামনে পেলে ওর দুই গালে দু’ইটা থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞেস করতাম!
ছোট মিয়া আমার ছেলেকে ভাত-কাপড়ের অভাবে তোমার বোনের কাছে দেইনি। তোমার বোনের কোন সন্তান নাই
সেজন্যেই সে আমার ছেলেকে পেলেছে। আমার সন্তান দিয়ে আমি সন্তানের হাহাকারে ভুগেছি। নিজের সন্তান পর হয়ে
যাওয়ার আতঙ্কে দিন পার করেছি।
এসব কথা নাহিদার জন্য কোন সান্ত্বনা বাণী নয়। ভাই-ভাবি তোমরা থামতো। তোমরা শুধু বলো, আবির যেন
আমার সাথে কথা বলে। আমি ওর কাছে আর কিছু চাই না। সন্তানের জন্য নাহিদার হৃদয়ে মর্মযাতনা দেখে সবাই দুঃখ
প্রকাশ করে। সকলের অভিমত, আবিরের এটা ঠিক হচ্ছে না। গর্ভে না ধরুক মায়ের মতোই বড় করেছে ছেলেটাকে।
অন্যায় করা হচ্ছে। শত হোক ফুপু তো তারই রক্ত। নাহিদা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর্তনাদ করে বলে, আমার মনে হয়
আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি তার জন্য তুই আমার সাথে কথা বলিস না। আবিরের কথা ভেবে ভেবে এভাবেই নাহিদার
দিন কাটে বিলাপে প্রলাপে।
ছয় মাস পর আবির বিদেশের পাঠ চুকিয়ে একেবারে দেশে ফিরে আসে। বিদেশ তার আর ভালো লাগেনা। আবির
আসার কথা শুনে নাহিদা আবিরের কাছে ছুটে যায়। আবিরকে পেয়ে নাহিদা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। নাহিদার চোখে মুখে
পানি দিলে জ্ঞান ফিরে। লোকজন বলাবলি করে, ফুপুর অভিশাপে মনে হয় আবির বিদেশ থাকতে পারে নাই।
বেঈমানের ফল আল্লাহ দেখাইছে। আবির ফুপুকে বলে, ফুপু তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমার সঙ্গে অন্যায়
করেছি।
বাবা সন্তান কখনো বাবা-মার কাছে অন্যায় করে না। সন্তান পাহাড় পরিমাণ অন্যায় করলেও বাবা-মার দৃষ্টিতে সেটা
অন্যায় মনে হয় না।

ফুপু কিছুটা শান্ত হলে আসলে আবির বলে। আমি তো বিদেশ থেকে একেবারে শূন্য হাতে দেশে ফিরেছি। চলার মত খরচ
পাতি আমার কাছে কিছু নাই।
তুই এ নিয়ে ভাবিস না। তোর ফুপু বেঁচে আছে। আবির ফুপুকে জড়িয়ে ধরে, জানি তো আমার ফুপু আমাকে অনেক
ভালোবাসে। অন্ধ পুত্রস্নেহের ঢেউ উথাল পাথাল করে মাতৃহৃদয়। পুঞ্জিভূত সব অভিমান মুহূর্তে গলে পানি হয়ে যায়।
তুহিন বলে, ফুপু যে আবির তোমাকে এত কাঁদালো। তাকে পেয়ে সব ভুলে গেলে?
নাহিদা ক্ষমার দৃষ্টি সারিত করে। বাবা সন্তানের উপরে রাগ করা যায় না।
থাক তুমি যদি ব্যথা সামলাতে পারো তাতে কারো ক্ষতি নেই। নাহিদা একটা তৃপ্তির হাসি দেয়।
আবির কোথা থেকে ঘুরে এসে। বলে। ফুপু আমার ব্যবসার জন্য টাকা লাগবে।
বাবা হাতের টাকা তো শেষ। এক আছে জমি।
তাহলে ফুপু আমি ব্যবসা করবো না?
ব্যবসা করবিনা এটা আমি বলি নাই। মা ললিতা ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা করে না। আবিরের বেলা
যত দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয় নাহিদার। নাহিদা স্বামীর বাড়ি বিক্রি করে আবিরকে টাকা দেয়। আবির ব্যবসা
শুরু করে ঢাকায়। সে ঢাকায় থাকে। নাহিদার জীবন কাটে একাকিত্বে আবিরের প্রতীক্ষায়।
আবিরের বিয়ের কথা কিছুদিন হলো নাহিদার মাথায় ঘুরছিল। নাহিদা একদিন ফোন করে সে কথা জানায়। ফুপুকে
চাঙ্গা রাখতে আবির এককথায় রাজি হয়ে যায়। নাহিদাকে মেয়ে দেখতে বলে। নাহিদার খুশিতে ধরেনা। আমার ছেলে
বিয়ে করবে। সে মেয়ে দেখা শুরু করে। পাত্রীর সন্ধানও পেয়ে যায়। পাত্রী দেখতে সুশ্রী বংশও ভালো। আবির ঢাকায়,
ব্যবসার ব্যস্ততার কারণে আসতে পারে না। মেয়ে দেখা হয় মোবাইলের ভিডিও কলে। পাত্র-পাত্রী দু’জন দু’জনার পছন্দ
হয়। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। নাহিদা ছেলে আর বউয়ের জন্য কেনাকাটা করে। বিয়ের দিন তারিখ ঘনিয়ে
আসে। কিন্তু আবির বাড়ি আসে না। আবির বলে, আমি বিয়ে দিন বাড়ি আসব। এখন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত তাই বাড়ি
আসতে পারছিনা। বিয়ের দিন এসে যায়, সবাই আবিরের আসার অপেক্ষা করতে থাকে। সময় গড়িয়ে যায় নাহিদা
অস্থির হয়ে পড়ে। ফোনেও আবিরকে পাওয়া যায় না। ফোন বন্ধ। মেয়ে বাড়ি থেকে নাহিদাকে বলে, আপনারা বরকে
নিয়ে আসছেন না কেন? নাহিদা তার উত্তরে বলে, আপনারা একটু অপেক্ষা করেন বরকে নিয়ে আসবো। অনেক চেষ্টার
পর নাহিদা আবিরের ফোন খোলা পায়। নাহিদা ফোনে দেয় আবিরকে। ওপাশ থেকে মেয়ে কন্ঠ ভেসে আসে। নাহিদা
জানতে চায় কে তুমি? উত্তর আসে আমি আবিরের স্ত্রী। নাম বলে ফাইজা।
তুমি আবিরের স্ত্রী? আবিরকে দাও। আবির তার ফুপুর সঙ্গে কথা বলে।
নাহিদা জানতে চায়। এই মেয়ে যা বললো, তা কি সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। আমি বিয়ে করেছি ফাইজাকে।
তুমি যদি একাই বিয়ে করবি তাহলে আমাকে মেয়ে দেখতে বললি কেন?
আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি। ফুপু আমাকে মাফ করে দাও।
মাফ? হ্যাঁ তোকে তো মাফ করবোই! আসলে কারো প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা না থাকলে জোর করে কিছু করা যায়না।
তোকে আমি ভালোবাসা দিয়েই গেছি। তুই আমাকে উপহার দিলি যন্ত্রণা। তাও তুই আমাকে কিছু একটা উপহার
দিয়েছিস। এই উপহার বহাল রাখিস আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত। আমি তো তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। হয়তো
তোকে তোর মত করে ভালবাসতে পারিনি। তাহলে শ্রদ্ধা বোধ থাকতো আমার জন্য। তবুও বলি তুই ভাল থাক। তোর
সুখ কামনা করি। সুখময় হোক তোর জীবন। জানা যায় এরপর নাহিদা বাঁচেনি বেশিদিন। মৃত্যুর আগে আবিরের
মুখটা একবার দেখতে চেয়েছিল তাও হয়নি।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ