আজ ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুখ দুঃখের জীবন-সুলেখা আক্তার শান্তা

মানুষ স্বপ্ন দেখে চায় সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হোক। যেমন ভাবনা স্বপ্ন দেখে সে সিনেমার নায়িকা হবে। স্বপ্ন পূরণ করতে একদিন সে বরিশাল থেকে ঢাকা আসে। কোথায় গেলে কাকে ধরলে মনোবাসনা পূরণ হবে সেই লক্ষ্যে চলে। মরিয়া হয়ে ওঠে সে। ভাবনা ভাগ্যক্রমে সেই সুযোগ পেয়েও যায়। স্বপ্ন পূরণ হয় তাঁর নায়িকা হবার। তবে প্রধান নায়িকা নয় ছবির সাইড নায়িকা। তাতেই সন্তুষ্ট সে। ছবির প্রধান নায়িকা হওয়ার প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষা তাড়িত করে তাকে। যতটুক এসেছে নিজের যোগ্যতা আর গুণের কারণে আসতে পেরেছে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অবহেলার বদলে সে একটা মর্যাদাপূর্ণ স্থান তৈরি করে নিতে পারে। ভাগ্য তার সহায় হয়। ভাবনা অধিকাংশ সময় সকলের সঙ্গে ইংলিশে কথা বলেন, ইংরেজি বলার চটপটে দক্ষতা নিয়ে সামনে পেছনে অনেকেই সমালোচনা করে। সে সেসবের প্রতি উত্তর দেয় বিনয়ের সঙ্গে। সুন্দরী শিক্ষিতা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের ভাবনাকে অনেকেই আগ্রহ করে ছবিতে কাস্ট করে। ভাবনা চলচ্চিত্রপাড়ায় বেশ সরগরম ফেলে দেয়। বেশ কিছু ছবি তাঁর হাতে আসে। ছবিতে স্টার হওয়ার বিষয়টা সে অনুধাবন করে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিজের অবস্থান নিয়ে সে সন্তুষ্ট থাকে। ভাবনা ভালো একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেয়। দেশে থাকে ভাই আসিফ এবং ভাবি দোলা তারা ভাবনার কাছে থাকতে চায়। দোলা বলে, ননদের এত ভালো অবস্থা তাহলে আমরা কেন দেশে পড়ে থাকবো। ভাবনা ভাই ভাবিকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ভাবনা বাসার সমস্ত দায়-দায়িত্ব ভাই ভাবির উপর ছেড়ে দেয়। চিন্তা শুধু তাঁর ফিল্মের ক্যারিয়ার নিয়ে।
দিন দিন ভাবনার হাতে ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আয়। রীতিমতো টাকার মালিক হয়ে যায় সে। সে ঢাকা শহর দুটি জমি কিনে। কাজে ব্যাস্ততায় ভালোই চলছিল তাঁর জীবন। নিজের দিকে তাকাবার একটু সময় হয়। ভাবনা বিয়ে করে ইফরানকে। স্বামী-স্ত্রী যেমন হওয়া উচিৎ তাঁদের দু’জনার তেমন মিলছিল না। ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে বিষয়টি। ভাবনার ছবির জন্য বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। ইফরানের তা ভাল লাগে না। ইফরান ভাবেন অফিস থেকে এসে স্ত্রীকে কাছে পাইনা। স্ত্রীর প্রতি অভিমান জমতে থাকে তার। একসময় ইরফান ভাবনাকে বলেন, তুমি ছবির করা বন্ধ করে দাও। স্বামী-স্ত্রী যেমন সম্পর্ক থাকা উচিত আমাদের মধ্যে তেমনটা নেই। তুমি আর ছবি করতে পারবে না!
ভাবনা অবাক হয়ে কি বলেন, আমি সবকিছু ছাড়তে পারলেও ছবি ছাড়তে পারব না!
আমার চেয়ে তোমার কাছে ছবি বড় হলো?
তুমি আমার কাছে বড় কিন্তু আমি ফিল্ম ছাড়তে পারবো না।
তাহলে আমাদের দু’জনের পথ দুটি দুই দিকে হাওয়াই ভালো।
ভাবনার স্বামীর কথায় অভিমান করে বলেন, তুমি যেমন মনে করো। যার কাছে আমার ক্যারিয়ার শখ ইচ্ছার মূল্য নেই তার সঙ্গে জীবন আটকে পথ চলার দরকার নেই।
ভাবনা সকালে উঠে ইফরানকে বলেন, শুটিং জন্য আমার বেশ কিছুদিন কক্সবাজার থাকতে হবে।
গম্ভীর মুখে ইরফান বলেন যাও। আমিও অফিস থেকে বাসায় ফিরব কিনা জানি না। তোমার যেভাবে চলতে ভালো লাগে তুমি সেভাবে চলো। ইফরান অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসে না। ভাবনাও তাঁর শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। স্বামী-স্ত্রীর দৈনন্দিন কথাবার্তা হয় না।
ভাবনা শুটিং স্পট থেকে জানতে পারে ইফরান বাসায় ফিরে না। ভাবনা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যাইহোক তার জন্য বাসা ছেড়ে যেতে হবে! ইফরান ভাবনাকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। ভাবনাও মনের ক্ষোভে ডিভোর্স লেটারে সই করে দেয়। এক পথ হলো দু’জনের দুই পথ।
ভাবনার ভাই আসিফের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে তুহিন মেয়ে আনিকা। ভাই ভাবির ছেলে মেয়েকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসেন ভাবনা। তাদের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে সে খুব তৎপর। ভাতিজা ভাতিজী তাঁর জান প্রাণ। নিজ সন্তানের মতো তাদের লালন পালন করেন। পরিচিত অপরিচিত অনেকে ভাবে এই সন্তান ভাবনার। সন্তানদের ব্যাপারে ভাবনাকে জিজ্ঞেস করলে সে হাসি দিয়ে বলেন, হ্যাঁ এরা আমার সন্তান! ভাবনার এমন স্বপ্রণোদিত স্বীকারোক্তি বিরম্বনা সৃষ্টি করে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ভাবনাকে নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। ভাবনা দুই সন্তানের মা। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে আছে। বেশ শোরগোল পড়ে যায়। মিডিয়া ফলাও করে সে সংবাদ প্রচার করে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভাবনার ছেলে মেয়ে নিয়ে নিউজ হয়। গুজবের প্রতিবাদ করে না সে। ভাবনার ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখে দাঁড়ায়। তাতে তাঁর মনে কোনো দুঃখ নেই। কারও সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো দেখা, আদর, স্নেহে লালন পালন করা তাতে আমার ক্যারিয়ার যদি ক্ষতি হয় হোক, মানুষের মুখ তো আর আটকিয়ে রাখা যাবে না! ক্যারিয়ারে ধ্বংস নামায় ভাবনার প্রাণচঞ্চল প্রচারণা স্তিমিত হয়ে যায়।
এলাকায় একটি ছেলে মুহিত ভাবনাকে বড় বোনের মতো জানে। আপা বলে ডাকে। ভাবনাও আবেগপ্রবণ মানুষ, ভাইয়ের ডাকে সাড়া দেন। ভাবনা বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে আসলেন এটা ওটা নামিয়ে দেয়। ভাবনার প্রয়োজনীয় অনেক কাজ করে দেয়। ভাবনার জমিজমাও দেখাশোনা করে। শুটিং স্পটে ভাবনাকে গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে যায়। এভাবে মুহিত ভাবনার বেশ বিশ্বস্ত হয়ে পড়ে। কাছের মানুষের পরিণত হয়। একদিন বাসায় কেউ ছিল না। স্বামী ছেলে মেয়ে নিয়ে দোলা তার বাবার বাড়ি বেড়াতে যায়। ভাবনাও শুটিংয়ের কাজে বাইরে। মুহিত এই সুযোগে বাসার আসবারপত্র, স্বর্ণ অলংকার, সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাসা থেকে নিয়ে যায়। ভাবনা ফিরলে অভিনয়ের ভঙ্গিতে মুহিত হাজির হয়ে বলে, বাসায় ডাকাতি হয়েছে! ভাবনা মুহিতের কথা বিশ্বাস করে। বাসার ডাকাতি হওয়ার কারণে ভাবনা পুলিশকে জানায়। পুলিশ তদন্তে সত্য ঘটনা উন্মোচন করে। পুলিশ মুহিতের দিকে তাকিয়ে জানায়, আপনার ভাই হয়ে আপনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই আপনার বাসার ডাকাতি করেছে! ভাবনা বিশ্বাস করতে পারছিল না। বোন বলে ভাই হয়ে বোনের বাসায় ডাকাতি করতে পারে! তখনই মুহিত ভাবনার পা জড়িয়ে ধরে। আপা আমাকে মাফ করে দেন।
ভাবনা বলেন, তুই এই ঘটনা ঘটিয়ে উল্টো থানা পুলিশ করতে সহযোগিতা করলি। তুইতো অভিনয়কেও হার মানিয়ে দিলি!
আপা আমার ভুল হয়েছে মাফ করে দেন। আমি আর এমন ভুল করবো না বলে কান্নাকাটি করে। তাতে ভাবনার মন নরম হয়। ক্ষমা করে দেন ভাবনা মুহিতকে।
ভাবনা দুটি প্লটে দুটি ছয়তলা বাড়ি করেন। তাতে ভাই ভাবির বাড়ির উপর দৃষ্টি পড়ে। তারা দু’জনেই ভাবনার বাড়ির অংশ চায়। তাদের যুক্তি দীর্ঘদিন তারা সংসার আগলে রেখেছে। তারা এখন সম্পত্তির অংশীদার হবে। যে ভাই দিনের পর দিন কোনো কাজকর্ম না করে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বোনের ঘাড়ের উপর বসে খায়েছে। বোনের টাকা-পয়সা বাড়ি-গাড়ি দেখে তারা লোভ সামলাতে পারেনা। বলে, তোমার দুটি বাড়ি একটি বাড়ি আমার নামে লিখে দাও।
ভাবনার উত্তর আমি বাড়ি কেন তোর নামে লিখে দেব? আর তোরা তো এখানে ভালো আছিস কোন কিছুতে তোদের কমতি রাখিনি।
আসিফ রাগান্বিত ভাবে বলে, ভালো থাকলেই কি সবকিছু হয়ে যায়? নিজের নামে আমার কিছুই নেই যা আছে তোমার নামে। তোমার এই সম্পত্তি আমাকে পাগল করে দিয়েছে!
আমার সম্পত্তি তো আমার নামেই থাকবে। তোর যদি ইচ্ছা হয় নিজে কর্ম করে নিজের নামে কিছু করে নে।
দোলা গজ গজ করে ওঠে। আপনার বাসায় থাকছি এমনিতো থাকিনেই কাজ করছি তার বিনিময়ে খেয়েছি পড়েছি।
নির্বোধের সঙ্গে আমি কিবা বলবো। তোমার স্বামী যদি উপার্জন করতো নিজের বাসা হলে সেখানে কাজকর্ম করতে হত না? কাজের লোক থাকার পরও যেটুকু কাজ তুমি করেছ সেটা কাজের মধ্যে পড়ে না। আরাম-আয়েশেই এখানে জীবনযাপন করেছ।
আমার ছেলে মেয়ে আছে তাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে বাবা মা হয়ে সন্তানের জন্য দায়িত্ব কর্তব্য তো আছে।
তুহিন আর আনিকাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। সে ভাবনা আমার।
তুহিনের জন্য চাকরি ঠিক করে দেন আর আনিকাকে পড়াশোনার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দেন। ভাবনা ভাই ভাবির জন্য যতই দায়িত্ব পালন করুক না কেন তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। ভাই ভাবির দাবি তারপরও ভাবনার উপর থেকেই যায়। ভাই আসিফ ভাবি দোলা তাদের দু’জনেরই দাবি একটি বাড়ি তাদের নামে লিখে দিতে হবে। উপার্জনের উৎস যদি নারী হয় বসে খাওয়া মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে।
ভাবনা ভাই ভাবিকে বলেন, তোমাদের একটি কথা কেন আমি বুঝিতে পারিনা আমার তো কেউ নেই যা আছে তাতো তোমাদের নিয়েই। যত কথাই বলো আমি কোন কিছুই কারো নামে লিখে দিব না। তুহিন আর আনিকা মা-বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। আনিকা ফোনে করে ফুপুকে বলে, আমার বাবা-মা দীর্ঘদিন তোমার কাছে থাকছে কিছু হলেও তো তারা তোমার কাছে হকদার। এখন তারা যেটা বলে তুমি মেনে নাও। ভাবনা বলেন, আমার কিবা বলার আছে সবার একমত। আমার শুধু ভিন্নমত। যে যাই বলুক আমি আমার সিদ্ধান্তেই থাকবো।
ভাবনার বয়স হয়েছে সবকিছুর মাঝে ও নিজেকে তাঁর নিঃসঙ্গ মনে হয়। এলাকার প্রতিবেশীদের সাথে ভাবনার খুব ভালো সম্পর্ক। এক প্রতিবেশী বয়স হয়েছে জেনেও অর্থ-সম্পদ দেখে ভাবনার চেয়ে কম বয়সী ছেলে আরজু রহমান আর জাহেদা রহমান ছেলে নাহিদের সঙ্গে ভাবনার বিয়ে ঠিক করেন। ভাবনাও বিয়েতে মত দেন। নাহিদের সঙ্গে ভাবনার বিয়ের সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই অবধারিত কাণ্ডটি ঘটে। নাহিদের বাবা-মা ভাবনাকে ছেলের নামে বাড়ি লিখে দিতে বলেন।
ভাবনা শ্বশুর শাশুড়িকে বলেন, কেন আমি বাড়ি লিখে দেব?
আমার ছেলে তোমার স্বামী তার জন্য লিখে দিবে!
না আমি তা করবো না।
ভাবনার শ্বশুর শাশুড়ি দু’জন একসঙ্গে বলে উঠে, তাহলে আমাদের ছেলে তোমার সঙ্গে সংসার করবে না।
বিয়ের সাপ্তাহ না যেতে যাদের এমন কথা তেমন সংসার আমিও করতে চাই না।
ঠিক আছে আমাদের ছেলেকে আমরা নিয়ে যাই।
যাদের কাছে বিয়ে একটা খেলনা সেখানে আমি কি বলবো যান আপনার ছেলেকে নিয়ে।
এবার শুরু হয় নতুন পর্ব। নাহিদ ও ভাবনার ভাই আর ভাবি এক সঙ্গে মিলে ভাবনাকে কিভাবে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যায় সেই চেষ্টা করতে থাকে। ভাবনার নামে এলাকায় মিথ্যা অপবাদ দেয়। পর পুরুষ নিয়ে বাড়িতে রাত কাটায়। বিভিন্ন জায়গায় পুরুষ নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সন্ত্রাসী দিয়ে ভাবনার কাছে চাঁদা চাওয়ায়। ছোট ছোট বকাটে ছেলে দিয়ে ভাবনার বাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙ্গায়। শুটিং থেকে বাসায় ফিরলে গাড়ি রাখতেই ভাবনার গাড়িতে এটা সেটা ছুঁড়ে মারে। এদের যন্ত্রনায় ভাবনা অতিষ্ঠ হয়ে যায় বাধ্য হয়ে তাঁর মামলা করতে হয়। এতেও শেষ রক্ষা হয় না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের হুমকি তাঁকে তাড়া করতে থাকে। ভাবনার ভাবনা আপন মানুষের জন্য আজ তাঁর জীবন বিতৃষ্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপন কেন পর হয়? কেন জীবনের সুখ কেড়ে নেয়? না হয় তারা সুখী। না হতে দেয় কাউকে সুখী। আইন নৈতিকতা সব দৃষ্টিতে অবান্তর হলেও এমন দাবির পেষনে নিষ্পেষিত হচ্ছে অনেক পরিবার। সম্পদ সম্পত্তির বিষে বিষময় করে তোলে শান্তির জীবন।
লেখক সুলেখা আক্তার শান্তা’র-সুখ দুঃখের জীবন

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ