আজ ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

তবুও তুমি ভালো থেকো-সুলেখা আক্তার শান্তা

ডেস্ক: সংসারের বড় ছেলে ফয়সাল। পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়। মা আবিদা ছেলের কথা চিন্তা করে‌ বলেন, বাবা সংসারে দায়িত্ব পালন তো আর কম করলি না। দুই বোনের বিয়ে দিলি আর আছে এক বোন, এক ভাই, ওদের নিয়ে ভাবিস না। এবার নিজের কথা ভাব। বিয়ে-শাদী কর। মায়ের কথায় ফয়সাল বলে, না মা টিনা আর রবিনের একটা কিছু করার পরে, তারপরে নিজের কথা চিন্তা করা যাবে। ওরা পড়ালেখা করছে করুক। আল্লাহ ভরসা। তিনি ওদের দেখবেন। তুই ঘর সংসারী হ। ফয়সাল কোন কথা বলে না। আবিদা ভাবেন, ছেলে সহজে বিয়ের মত দিবে না যা করার নিজেরই করতে হবে। সে ছেলের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে। ফয়সালকে মেয়ে দেখতে নেওয়া যায় না। নানা অজুহাত, ছোট দুই ভাই, বোনের বিয়ের দায়িত্ব শেষ করে তবে সে বিয়ে করবে। আর না হয় কোথা থেকে কোন মেয়ে এসে কি অবস্থা করে তা তো বলা যায় না। মা অধৈর্য হয়ে বলেন, এটা কোন কথা হলো? সব মেয়ে একরকম হয়না ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে আছে। বিবেক বিবেচনা আছে। সেও কোন পরিবারের সন্তান তার পরিবারে লোকজন আছে। তুই এতো চিন্তা করে নিজের সময় নষ্ট করিস না। পরিবারের সবার চাপের কাছে ফয়সাল আর বিয়ার দ্বিমত করতে পারে না। তবে
ফয়সালের বিয়ের জন্য সুন্দর একটি পাত্রী পায়। পাত্রীর পরিবার ছেলে বয়স একটু বেশি হওয়ায় অমত করছিল। যখন জানলো ছেলে খুব ভালো ও দায়িত্ববান তখন পাত্রীর বাবা-মা মেয়ে বিয়েতে মত দিলেন।
ফয়সালের স্ত্রী শিলা একরোখা যা বলে তা করে ছাড়ে। শ্বশুর বাড়ি এসেই স্বামীর প্রতি উপদেশ, এটা বলা যাবে না, ওটা করা যাবে না। স্ত্রীর কথার বাইরে যাওয়া যাবেনা। ফয়সাল চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। স্ত্রী যা বলে তা শোনে কিন্তু কোনো প্রতি উত্তর করে না। যেন শান্তি বজায় রাখার উত্তম উপায়।

ছোট ভাই রবিনের অনেক দিনের শখ একটা বাইকে। ফয়সাল বরাবরই বলে এসেছে পড়াশোনা শেষ করো তারপরে বাইক দেব। পড়াশোনা সময় এটা বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। ছোট ভাই রবিনের পড়ালেখা শেষ করে। ফয়সালকে কখনো কোন প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিতে হয় না। তার মনে আছে ছোট ভাই রবিনের অনেক দিনের আশা মোটরসাইকেল। সে ছোট ভাইকে নিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দেয়। বিস্ময় আনন্দে রবিন বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে। এতে পরিবারের সবাই খুশি হলোও খুশি হয় না ফয়সালের স্ত্রী শিলা। স্বামীকে বলে, তোমার টাকা পয়সা খুব বেশি না? যে টাকার তাপ তুমি সামলাতে পারছ না। তাই ছোট ভাইকে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছো! ফয়সাল সহজ করতে চেষ্টা করে, আরে টাকা পয়সা তেমন কই? ছোট ভাইয়ের অনেক দিনের একটা আবদার ছিল তাই দিলাম। দাবি তো আমারও আছে স্বামীর প্রতি। আমার গলা, হাতের স্বর্ণের সেট কিনতে হবে। তুমি দুষ্টামি করছো না? কারণ এগুলো তো সবই তোমার আছে। কেন আমাকে তোমার কি দুষ্টুমির পাত্রী মনে হয়? আমার কথা তোমার যেমনই মনে হোক, আমি যা বলছি সেগুলো করো না
হয় আমি কি করি সেটা শুধু চেয়ে দেখতে পারবে। স্ত্রীর এমন কথায় ফয়সাল চমকে যায়। ভাবে শিলার মেন্টালিটি এমন একে নিয়ে তো পথ চলা খুবই দুষ্কর হবে! স্ত্রীকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। শুনো শিলা কোন কিছু পাল্লা দিয়ে হয় না। তোমার লাগলে তুমি বলতে পারো। তুমি আমার ভাই, বোনের সাথে কোন কিছুতে পাল্লা দিলে এটা কেমন ব্যাপার হয়? এ কখনোই আমার ভালো লাগবে না।

দুই বোন মিতু আর সেলিনা বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। খাওয়া দাওয়া শেষে পরিবারের সবাই একত্রে গল্প করতে বসেছে। সবাই সেখানে উপস্থিত থাকলেও শিলা তার রুমে। একসঙ্গে আড্ডায় হাসাহাসিতে সবাই মেতে ওঠে। হাসাহাসির শব্দ শুনে শিলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দুপুরে খাওয়ার পরে একটু শুয়েছি। গল্প গুজবের শব্দে ঘুমানো গেল না। সে উঠে এসে বলে, এখানে এত হাসাহাসি কিসের? মিতু আর সেলিনা বলে, ভাবি তুমিও এসো না। সদ্য ঘুম ভাঙ্গায় মেজাজ তখন তার সপ্তমে। আমি আসব তোমাদের আড্ডায়! জংলিদের মতো জংলিপনা করার আমার কোন ইচ্ছা নেই। মিতু আর সেলিনা আস্তে আস্তে দু'জনে বলাবলি করে, আমাদের পরিবার যেরকম ভাবী সেরকম না। শিলা বলে ওঠে, দু'জনে কি বিড়বিড়
করছো? নিশ্চয় আমাকে নিয়ে কিছু বলছো? বিয়ে হলে মেয়েদের বাপের বাড়ি আর স্বামীর বাড়ির পার্থক্য বুঝতে হয়। বাবার বাড়ি বেশি আসতে হয়না। আবিদা এবার উত্তর না দিয়ে পাললেন না। কি বললে তুমি? আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমার মেয়েরা আমার কাছে আসবে। এটা কেউ নিষেধ করতে পারবে না। এতই যদি মেয়েদের কাছে রাখতে ইচ্ছে করে যেটার বিয়ে হয় নাই সেটাকে বিয়ে না দিয়ে কাছে রেখে দেন। ভাবীর এমন ঠেস মারা কথা শুনে রবিন বলে। ভাবী আমি পুরুষ মানুষ আমি চাইনা মহিলাদের কোন ব্যাপারে নাক গলাতে। রবিনের কথা শেষ করতে না দিয়ে শিলা বলে ওঠে, কি তুমি আমাকে মহিলা বললা? মহিলাকে মহিলা বলছি তাতে দোষের কি হয়েছে? আমি এখনো মহিলা হইনি, তরুণী আমি। বিতর্ক এখানেই শেষ হয় না। ফয়সাল অফিস থেকে আসলে শিলা শার্ট, প্যান্টের পকেট হাত দেয়। কি হয়েছে তুমি এসব কি করছো? টাকা পয়সা কি আছে না আছে দেখতে হবে না? সে তুমি আমাকে বললেই পারো। রুমে ঢুকতে না
ঢুকতেই তুমি আমার শার্ট প্যান্টের পকেট তল্লাশি শুরু করছো।

আবিদা বউয়ের এমন আচরণে চিন্তায় পড়ে যায়। ভাবে এ থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় আছে। বাচ্চাকাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বউয়ের কাছে গিয়ে বৌমা তোমাকে একটা কথা বলি, একটা বাচ্চা নাও দেখবা তোমার ভালো লাগবে। বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বইবে। নাতি নাতনির মুখ দেখব আমারও আনন্দের সীমা থাকবেনা। এত তাড়াতাড়ি আমাকে বাচ্চা নিতে বলেন? আমি ঘুরবো ফিরব, টাকা পয়সা জমাবো তারপর যদি ভাবা যায়। তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিলে আমার শরীর নষ্ট হয়ে যাবে না। এসব কি বলো বৌমা? তোমার মাথা ঠিক আছে? আমার মাথা ঠিক আছে কি নাই সেটা আপনাকে দেখতে হবে না। আর বাচ্চা সেটা তো দত্তক নেওয়া যেতে পারে। বৌমা তোমার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে। আবিদা মন খারাপ করে বউয়ের রুম থেকে বের হয়। ফয়সাল জমি কিনছে। সেখানে বাড়ি করবে। শিলা তা নিয়ে ভাবে। বাড়ি করতে হলে টাকার প্রয়োজন। টাকা তো জমাতে হবে। সে স্বামীকে নিয়ে আলাদা থাকবে। পরিবারের সঙ্গে থাকলে রাজ্যের খরচ আর দুনিয়ার ঝামেলা। পরিবার টানলে সামনে এগোনো যাবে না। যেটা এযাবৎ তার স্বামী করে এসেছে। শিলা স্বামীক বলে, সংসারের ঘানি টেনে নিজের জীবনটা তো শেষ করলে আমাকেও সেই ঘানিতে জুড়ে দিতে চাও? আমরা আলাদা হব। ফয়সাল আশ্চর্য হয়ে বলে, আলাদা হব মানে?
পুরো গুষ্টির খরচ তোমাকে একা বহন করতে হচ্ছে। আর কে করবে?
কেন আর কেউ নাই?

আছে কিনা না আছে তুমি চোখে দেখো না? আর আলাদা হওয়ার কথাটা একবারও মুখে আনবা না। কেন, তুমি আলাদা হতে চাও না? না আমি চাই না। আমি আমার পরিবারকে আলাদা করব না। আমার ভাই আছে, বোন টিনার বিয়ে দিতে হবে। তুমি পরিবারের এত কিছু করার অপেক্ষায় আছো?
এ আমার দায়িত্ব। শিলা মনে মনে বলে, দাঁড়াও তোমার বোনের বিয়ে দেওয়াচ্ছি। টিনার বিয়ের প্রস্তাব এলেই এটা ওটা বলে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। সুযোগ পেলে সামনাসামনি বলতেও ছাড়েনা। কালো, মুটকি, কোন কাজ জানে না, ঝগড়ুটে, পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলে।

এমন সব কথা শুনে বিয়ের ঘর আর এগোতে সাহস করে না। আবিদা বুঝে উঠতে পারেনা মেয়ের বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়েও কেন বিয়ে ভেঙে যায়। একবার টিনার বিয়ের সব ঠিকঠাক। কিন্তু ছেলেপক্ষের দাবি পূরণ করতে হবে। আবিদা ভাবে এক এক করে তো কম বিয়ে ভেঙ্গে গেল না। এবার ছেলে পক্ষের চাওয়া থাকলেও সেটা পূরণ করেই মেয়ের বিয়ে দেবে। সে চাওয়া পূর্ণ করার একজনেই আছে তার ছেলে ফয়সাল। ফয়সাল বোনের সমস্ত খরচ দিতে চাইলেও শিলা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে টিনার বিয়ের দেনা পাওনা নিয়ে পারিবারিক বিরোধে, দাবি পূরণ করতে না পারায় এবারও বিয়ে ভেঙ্গে যায়। টিনা কান্নাকাটি করে, নিজেকে সে অপয়া মনে করে। এই মুখ আর কাউকে দেখাবো না। সে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যেতে চায়। সবাই তাকে বুঝায়। তার কথা, ‌আমার বিয়ে না হোক তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু বিয়ে বারবার ভেঙ্গে যায় এটার জন্য কথা শুনতে হয় এটা আমি সহ্য করতে পারছি না। আবিদা মেয়েকে বুঝান, লোকের কথায় কান দিয়ে হবে? কেউ কি আমাদের খাওয়া পড়া দিবে? দেখিস, আল্লাহর রহমতে তোর অনেক ভালো বিয়ে হবে। যা দেখে মানুষ
অবাক হবে। যারা তোকে খোটা মেরে কথা বলে এদের মুখে চুনকালি পড়বে।

ফয়সাল নিত্যদিনের সাংসারিক অশান্তিতে বীতশ্রদ্ধ। স্ত্রীর কথা না মেনে পারলেন না। শিলা সংসারে নানা বিষয় নিয়ে অশান্তি করে। ফয়সাল ভাবে মা, ভাই, বোনের খাওয়া পড়া যাই জুটুক না কেন তাও তো তারা একটু শান্তিতে থাকতে পারবে। আলাদা হয়ে যায় স্ত্রীকে নিয়ে ফয়সাল। কিন্তু মা, ভাই, বোনকে রেখে ফয়সালের মনে শান্তি নাই। সব সময় এই অশান্তির যন্ত্রনা সে বয়ে বেড়ায়। কেউ সুখী না হলেও এ ব্যাপারে সুখি হয়েছে শিলা। টিনার বিয়ে হয়েছে অনেক ভালো জায়গায়। স্বামী পাবেলের বাড়ি গাড়ি সহায় সম্পদে কোন অংশে কম নাই।‌ এদিকে রবিনও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, তার খুব ভালো চলছে। আবিদার এদিকে সবকিছু ভালো থাকলেও তাঁর মনে স্বস্তি নেই বড় ছেলে ফয়সালের কথা ভেবে। এমন একটা বউ কপালে জুটলো ছেলেটার জীবনটা তার শেষ হয়ে গেল। ফয়সাল বাড়ি করেছে। সে বাড়িতে মা, ভাই, বোনের কারো যাওয়া হয়নি। শিলা চায় না সেই বাড়িতে ফয়সালের পরিবারে লোকজন কেউ আসুক। সে হিংসায় জ্বলে, শিলার অনেক ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। ফয়সাল বলে, এতেও তোমার হিংসা! শিলা বলে, তোমার পরিবারের খারাপ অবস্থা
থাকবে সবসময় আর আমি মাথা উঁচু করে কথা বলব। আমি মানুষ দেখছি তোমার মতো মানুষ দেখি নাই! তোমার যে চিন্তা ধারা। ফয়সালের একটি মেয়ে হয়েছে, তাতে সে খুবই খুশি। শিলা বাচ্চা রেখে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দেয়। বিভিন্ন ক্লাব পার্টিতে যায়। ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত থাকে। কোন বারণ শোনে না শিলা। একদিন ফয়সাল অফিসে ছিল কাজের মেয়ে ফোন করে বলে, খালু তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন। জেবা খাট থেকে পড়ে মাথা ফেটে গেছে। ফয়সাল তাড়াতাড়ি এসে মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার কাছ থেকে এসে একটা চিঠি লিখে রাখে। তোমার বাড়ি গাড়ি সবই থাকলো শুধু আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে আমার মায়ের কাছে চলে গেলাম। আর যদি নিজেকে ঠিক করতে পারো আমার মায়ের কাছে চলে এসো। যদি না পারো তুমি তোমার বাড়ি, গাড়ি, পার্টি হইহুল্লোড় নিয়ে থেকো। তবুও তুমি ভালো থেকো।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ