আজ ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বাল্যবিবাহ এবং ভালোবাসা-সুলেখা আক্তার শান্তা

রোহিতের দাদি অন্তিম সময়ে এক ইচ্ছা জানালেন। মৃত্যুর আগে তিনি নাতবউ এর মুখ দেখে যেতে চান। রোহিতের বয়স তখন অল্প, স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। মায়ের ইচ্ছা বলে কথা। রোহিতের পিতা বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন। শুরু হলো পাত্রী খোঁজার পালা। দেশে এ জিনিসটার অভাব নাই। আর কিছু পাওয়া না গেলেও সাদৃশ্য কিম্বা বৈসাদৃশ্য যাই হোক বিয়ের পাত্রী পাওয়া যায়। বাল্যবিবাহের সুফল কুফল নিয়ে কে মাথা ঘামাতে চায়। ফুট ফুটে এক সুন্দর মেয়ে এলিজাকে রোহিতের বউ করে আনা হলো। তখন মেয়েটি সবে পঞ্চম শ্রেণীর বেড়া পার হয়েছে। বিয়ের পর ‌যথারিতি এলিজার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় এবং রোহিতের পড়ালেখা চলতে থাকে। বছর ঘুরতেই তাদের একটা বাচ্চাও হয়। বাচ্চার নাম রাখা হয় মাহিম। অল্প বয়সে বিয়ে এবং বাচ্চা হওয়ায় এলিজার শরীর ভেঙ্গে পড়ে। চেহারায় কমে আসে সতেজতা। শরীরও তেমন একটা ভালো যায়না। দুর্বলতা বোধ করে। এসব ব্যাপার নিয়ে রোহিতের খুব একটা মাথা ব্যথা না থাকলেও রোহিতের বাবা-মার শিরোপীড়া কম না। তাদের কথা সুদর্শন যুবক রোহিতের সঙ্গে হতশ্রী এলিজা একেবারে বেমানান। মা বলে, আমার এত সুন্দর ছেলেটা তার হবে একটা সুন্দর বউ। ঘর ঝলমল করবে বউয়ের সৌন্দর্যে। রোহিত বাবা মাকে বুঝ দেয় কিন্তু তারা বুঝ মানতে চায় না। ইশারা ইঙ্গিতে তাদের কথা শোভা হীন এ বউ রাখা যাবে না।

কোনভাবে একে বিদায় করতে হবে। রোহিত প্রতিবাদ করে, আমি কিন্তু করতে চাই নাই তোমরাই বিয়া করাইছো আবার তোমরাই সংসার ভাঙতে চাচ্ছ। মা রাবেয়া পুত্রের কথা খণ্ডন করতে চেষ্টা করে। বাবা বিয়ে ভাঙতে চাই কী সাধে, আমার এত সুন্দর ছেলেটার ভগ্নদশা বউ। লোকে কী বলে? রোহিত বলে, সংসারের সব কাজ তো ওর উপর দিয়া রাখছো। তার উপর ছেলে মানুষ করা। এত কাজ করলে এমনই হয়। ওর তো কোন অবসর নাই, নিজের খেয়াল করে কখন। রাবেয়া ছেলেকে ধমক দেয়। তুই থাম, তোর এই ব্যাপারে নাক গলাইতে হইবো না। সবকিছু সামাল দিয়ে আমরা সংসার করি নাই? এলিজা এসব শুনে চুপ করে থাকে কোন কথা বলে না। কারণ প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে তার এসব শুনতে হয়। রোহিত ত্যক্ত বিরক্ত। একদিন মাকে বলে, ঠিক আছে তোমরা যা ভাল মনে করো তাই করো। তোমাদের সঙ্গে কথা বলা বৃথা। এলিজার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। প্রচন্ড ভূমিকম্পে দুলে উঠে তার পৃথিবী। একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকায় একবার শাশুড়ির মুখের দিকে। অসহায়ত্বের বেদনায় ছিন্নভিন্ন হতে থাকে তার সমস্ত চিত্ত অস্তিত্ব। সম্মুখে দেখতে পায়
উপায়হীন অসহায় ভবিষ্যৎ। দেখতে পায় বাপে বাড়িতে পরিত্যক্ত নারীর অঞ্জনার জীবন। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় এখন সে কী করবে। না করেছে লেখাপড়া না আছে কোন দক্ষতা। যা দিয়ে নিজের পায়ের নিচে এক ফোঁটা শক্ত মাটির সন্ধান করবে। কোথায় যাওয়ারও জায়গা নাই। নদীর ভাসা পাতার মতো সে যে পাতা ভাসতে ভাসতে একসময় ডুবে যায় অতল
গহবরে। ভাবে শাশুড়ি যে সিদ্ধান্ত নেয় সে মেনে নেবে। অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে রোহিতের বেশি খারাপ লাগে। ছেলেকে বুকে নিয়ে একবার ছেলের দিকে তাকায় আবার শূন্যে দৃষ্টি দেয়। একি খেলা শুরু হলো তার জীবন নিয়ে। প্রশান্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়, কোথাও শান্তি পায় না। রোহিত কলেজে যায়। পড়াশোনা শেষ করতে চায় সে। কলেজে রুবার সঙ্গে পরিচয় হলেও তেমন কথা হয় না। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দুই একটা কথা হয় মাত্র। সুদর্শন রোহিতের সুন্দর মুখটা কালো মেঘে যেন ঢাকা থাকে সারাক্ষণ। রুবা গভীরভাবে থাকে লক্ষ্য করে। একদিন রোহিত মন খারাপ করে বসে আছে। রুবা জানতে চায়, রোহিত তুমি এখানে মন খারাপ করে বসে আছো কেন? রোহিত প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চায়, না এমনি। রুবা আন্তরিক হতে চেষ্টা করে। আমরা একসাথে পড়ছি আমরা তো একে অপরের বন্ধু। কথা বলতে পারি নিজেদের ভালো লাগা নিয়ে সমস্যা নিয়ে। একে অপরের কথা যদি নাই জানলাম তাহলে বন্ধু হলাম কী করে। রোহিতের হৃদয় স্পর্শ করে। পাভেল মৃদুস্বরে বলে, আমার স্ত্রী জন্য ভীষণ খারাপ লাগে। তুমি বিয়ে করছ?  হ্যাঁ আমার একটি বাচ্চাও আছে।
ও আচ্ছা।
আমার স্ত্রীর মন মানসিকতা খুবই ভালো ও খুবই নম্র ভদ্র স্বভাবের মেয়ে। তাহলে সমস্যা কী? আমার মা ওকে রাখতে চায় না।
কেন?
ওর ছোটবেলার বিয়ে হয়েছে। সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে।‌ নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়ার সময় পায় না। তাই একটু শরীর ভেঙ্গে গেছে। আমার মায়ের আক্ষেপ, এখন তাঁর সুন্দর ছেলের জন্য সুন্দর বউ আনবে। এটা কোন কথা হলো? আমি মাকে বুঝাইতে পারি না। যুক্তি দিলে ও সে বুঝতে চায় না। এ তো দেখছি মহা মুশকিল। হ্যাঁ মুশকিলই তো। তুমি ভেঙ্গে পড়ো না দেখবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই যেন হয়। রোহিত বাসায় এলে মায়ের একই কথা। রোহিত মাকে বিরত করতে চেষ্টা করে। তুমি আমার মা। তুমি আর একটা হুকুম কর দেখো আমি পালন করে দেখাবো। কিন্তু এই কাজটা আমাকে দিয়ে করাইও না। কারো অধিকার বঞ্চিত করে কোন কিছু করা ভালো কাজ না। রাবেয়ারও একই জেদ শুনতেই হবে তাঁর কথা। এলিজা শাশুড়িকে বলে, মা আমাকে বিদায় করে আপনে ছেলের জন্য কাউকে না কাউকে আনবেন তাহলে আমি থাকলে দোষ কি? তোমার দোষ তুমি দেখতে সুন্দর না, আমার ছেলের জন্য বেমানান। সেই সুন্দর বউ আসলে কি আপনার খুব ভালো লাগবে? লাগুক না লাগুক সেটা আমার ব্যাপার তোমার এখানে নাক গলাতে হবে না। রোহিতের বাবা আলিমুদ্দিন তিনি নিজে কিছু বলেন না কিন্তু স্ত্রী কোথায় সায় দিয়ে যান। তিনি বলেন, তোমার শাশুড়ি যখন রাখতে চায় না তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও। এখানে থাইকা কী করবা? এলিজা যুক্তি দেখাতে চায়। আমার অধিকার আমার সন্তানের অধিকার বঞ্চিত করতে চান? আমি চলে গেলে আমার সন্তানের কী উপায় হইবো? তখন একটা কিছু হবে সেটা নিয়ে তোমাকে আগামভাবতে হবে না।

মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে রোহিত তার হতাশার কথা রুবার কাছে প্রায় বলতো। একান্ত আলাপচারিতায় একসময় তারা দুজন দুজনের আপন হয়ে যায়। একদিন রোহিত দেখে রুবা একটা ছোট ছেলে নিয়ে হাঁটছে। রোহিত কাছে এসে জিজ্ঞেস করবে এমন সময় ছেলেটি রুবাকে আম্মু বলে ডাকে। রোহিত জিজ্ঞেস করে, ছেলেটি কে? ও আমার বোনের ছেলে আমার
কাছে থাকতে বেশি পছন্দ করে। রোহিত বাচ্চাটিকে আদর করে চকলেট কিনে দেয়। রুবা একদিন রোহিতকে বিয়ের জন্য বলে। রোহিত অবাক হয়, বিয়ে? হ্যাঁ রোহিত আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলছি। তুমি জানো আমার বউ আছে বাচ্চা আছে। তোমার ফ্যামিলি তো তাকে চায় না। রোহিত তুমি তোমার বউকে ডিভোর্স দাও। না রুবা এটা আমি পারবো না। কেন পারবে না? দেখো এলিজা অনেক ভালো মেয়ে। আমি আর যাই করি ওকে ওর অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারব না। তাহলে আমাকে সতীনের ঘর করতে বলো! তোমার বউকে ডিভোর্স দাও। না আমি পারবো না। যার বউ আছে বাচ্চা আছে সেই ছেলেকে আমি বিয়ে করি কী করে! তাহলে বিয়ে করো না। আর আমি তো তোমাকে বিয়ে করতে‌ চাইনি। রোহিত তোমার সঙ্গে একসাথে চলতে চলতে তোমাকে ভালোবেসে ফেলছি। তুমি ছাড়া আমি কোন পথ দেখছি না। নিরুপায় রোহিত নমনীয় হয়। আচ্ছা তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারি কিন্তু আমি এলিজাকে ডিভোর্স দিতে পারব না। তুমি যদি আসতে চাও ওকে দেখেই আসো। আর না হয় বাদ দাও। একদিন রোহিত জানতে পারে রুবার বিয়ে হয়েছে। ‌সে যে বাচ্চা দেখেছে সেটা রুবারই ছেলে। রোহিত চমকে যায়! যে মেয়ে তাকে নিয়ে এত লেকচার দিল তার এই জীবনে এত কাহিনী। সে রুবার মুখোমুখি হয়, রুবা তুমি আমাকে নিয়ে এত কথা বললা আর তোমার জীবনে এটা কী? তুমি ম্যারিড এবং তোমার বাচ্চা আছে। তুমি নিজের সন্তানের পরিচয় দিলা তোমার বোনের বাচ্চা বলে! কিছু কিছু মানুষ আছে তারা পারেও বটে। তোমার বিয়ে হয়েছে বাচ্চা আছে এটা দোষের কিছু না। দোষনীয় সেটা গোপন করার চেষ্টা। এটাই বোধ হয় তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। রুবা রোহিকে পিছন দিকে ডাকে কিন্তু রোহিত রুবার ডাকে সাড়া দেয় না।

রোহিত বাড়িতে এসে মাকে বলে, মা তুমি যত কথাই বলো আমি এলিজাকে ছাড়তে পারবো না।‌ ওই আমার জীবনের যোগ্য সাথী। ছেলেকে যদি সুখি দেখতে চাও তাহলে আর এলিজাকে তাড়াতে চাইও না। আমার এই বউ বাচ্চা নিয়ে আমি সুখী। সুখী হতে সুন্দর চেহারা লাগেনা সুন্দর একটা মন হলেই হয়। সেই মন আমি এলিজার মধ্যে পেয়েছি। এলিজা রোহিতের দিকে তাকায়। কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা ঝরে পড়ে সে দৃষ্টিতে। মিষ্টি এক হাসির রেখা ফুটে উঠে ঠোঁটের কোণে। অপরূপ রূপের ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এলিজার অবয়ব। স্বর্গীয় সেই সৌন্দর্যে রোহিতের মন পরিতৃপ্তি আর প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। সে খুঁজে পায় জীবনের সার্থকতা।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ