আজ ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আরাধ্য সুখ-সুলেখা আক্তার শান্তা

ডেস্ক: মেয়েকে বিয়ে দিবেন অনেক স্বপ্ন কবির আহমেদের। সৎ পাত্রের খোঁজ করছেন। ভালো পাত্র পাওয়া দুষ্কর। তারপরও অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন। এক পরিচিত জনের মাধ্যমে একটা ভালো ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়। পরিচিত ব্যক্তিটি খুব উৎসাহ নিয়ে পাত্রের গুনাগুন বর্ণনা করতে থাকেন। কবির আহমেদ ধৈর্য ধরে পাত্রের খুঁটিনাটি বিবরণ শুনেন। পরিশেষে একটি কথায় তিনি ধাক্কা খেয়ে যান।

ছেলেটির পায়ে একটু সমস্যা আছে। সামান্য খুড়িয়ে হাঁটে। তাতে চলাফেরার কোন অসুবিধা হয় না। পরিচিত লোকটি সরল প্রকৃতির। তার দৃষ্টিতে পাত্রের মহৎ গুণাবলীর কাছে ওই সামান্য ত্রুটি কিছুই না। সে মহা উৎসাহে পাত্রের গুনাগুন বর্ণনা করতে থাকেন।

অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে। ওইটুকু সমস্যা থাকলে কী হবে ছেলেটা খুব নীতিবান এবং সৎ চরিত্রের। পড়ালেখায় ভালো দেখতে শুনতে চমৎকার। দিব্যি চলাফেরা করছে, কাজকর্ম করছে। পরিচিত লোকটির তথ্য নানা বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমে যাচাই করেন কবির আহমেদ। অনুসন্ধানে পাত্রের প্রশংসা জনক সব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিশ্চিত হন। একসময় কবির আহমেদ বুঝতে পারেন ছেলেটির স্বভাব চরিত্র আসলেই ভালো। শুধু ওই একটি ত্রুটি ম্লান করে রেখেছে ছেলেটিকে।

তবু তিনি স্থির করেন এ পাত্রের কথা মেয়ের কাছে বলবেন না। তবে ছেলের যে পরিচয় পেয়েছেন তাতে তিনি সন্তুষ্ট।

একদিন মিতুর বিয়ের কথা উঠতে কথাটা বলেই ফেলেন কবির আহমেদ। মিতুর মা প্রবল আপত্তি জানায়। মিতুর এক কথা হাজার ভালো হোক এমন ছেলেকে সে বিয়ে করবে না। অর্থবিত্ত না থাক কিন্তু শারীরিক ত্রুটির কোন ছেলেকে বিয়ে করবে না। বাবাকে জানায় একটি ছেলেকে সে ভালোবাসে। বিয়ে করলে তাকেই করবে।

কবির আহমেদ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আমি বাবা হয়ে তোমার কোন অমঙ্গল চাই না। ছেলেটির ব্যাপারে আমি নিজে সব খবর জেনে নিশ্চিত হয়েছি। মানুষের ওইটুকু ত্রুটি কোন বিষয় নয়। মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্বে। বাবা যা বলে সে কথা তোমার শোনা উচিত। ওইসব ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না। কঠিন বাস্তবতায় চালাতে যোগ্য সঙ্গী দরকার। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় কম। এই পাত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করছি। আমি কথাবার্তা ফাইনাল করব। মিতু ভার্সিটিতে গিয়ে আবিরের সঙ্গে দেখা করে।

বাবা বিয়ে ঠিক করেছে। তুমি একটা কিছু করো।

আবিরের হৃদয় কেঁপে ওঠে। ভালোবাসার মানুষের বিয়ে ঠিক হয়েছে সে এখন কী করবে! রাস্তা একটাই বিয়ে করে বিয়ে ঠেকানো। সে নিজের পড়ালেখার খরচ চালায় টিউশনি করে। নিজের পায়ের নিচে মাটি নেই। তার উপর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় কী করে। ব্যাচেলর জীবন বহন করাই কষ্টকর তার উপর বউয়ের ভরণপোষণ! সে সমাধানের কোন কুল কিনারা দেখে না।

মিতু তুমি তো জানো আমার পরিবারের আমাকে পড়ালেখা করানোর সামর্থ্য ছিল না। আমার নিজের উদ্যোগেই আমার পড়ালেখা চলছে। এখন আমি যদি বিয়ে করি তোমাকে খাওয়াবো কী?

আমি বাতাস খেয়ে থাকবো তবু তুমি আমাকে বিয়ে করো।

সবকিছু ঝোঁকের মাথায় করলে হয় না। তোমাকে হারাতে হবে এটা আমার জন্য অনেক কষ্টের। তার চেয়ে তোমার বাবা যা বলে তুমি তাই মেনে নাও।

যখন আমাকে ভালোবাসে ছিলে তখন এটা মনে ছিল না। তোমার পায়ের নিচে মাটি নেই এখন মনে হচ্ছে। ভালোবাসি তোমাকে আর বিয়ে করবো আর একজনকে।

মিতু তুমি চুপ কর শুনতে ভালো লাগছে না।

আমারও বলতে ভালো লাগছে না।

আমার হৃদয় কেমন ঝড় বইছে বোঝো? মিতু তোমাকে হারিয়ে আমি কোনদিনও সুখী হব না। গরিবের জীবন সবকিছু হারাতে হারাতে শেষ হয়।

আবির গরিব হওয়া দোষের কিছু না। ভাগ্যে যা আছে তা হবে। তবে ভাগ্যের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা বোকামি। পৃথিবীর অনেক ভাগ্যবান মানুষ গরীব ছিল। গরীব হলেও চেষ্টা থাকতে হয়। কোন কিছুর উদ্যোগ নিতে সাহস থাকতে হয়। তোমার কি সেই সাহস আছে?

সাহসে কি পেট চলে? যার হাত-পা সব বাঁধা তার সাহস থাকলেও কিছু হয় না।

আবির তোমাকে হারালে আমার জীবনটাই মিথ্যা হয়ে যাবে। আমি মরণ ছাড়া কোন গতি দেখছি না।

মিতু এভাবে বলো না। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে চলতে গেলে পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। সব ভালোবাসায় মিলন হয় না। তোমার আমার মিলন এ জনমে না হলে নিশ্চয়ই পরজনমে হবে।

তোমার আমার মিলনে এ জনমে বাধা দিল কে? আমরা চাইলেই তো বিয়ে করতে পারি। কিন্তু তুমি কথার মায়া জালে নিজেকে আড়াল করছো। আবির তুমি ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারছি না।

তোমাকে হারালে আমার কি ভালো লাগবে?

তার মানে তুমি চাও আমি আমার বাবার কথা মেনে নেই।

আমি চাইনা তুমি তোমার বাবার কথা মেনে নাও কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করছে।

পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে তুমি বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে চাইছো!

বিয়ে করলে আমি তোমাকে নিয়ে রাখবো কোথায়? তোমাকে রাখার জায়গা নেই আমার। হয়তো একদিন হবে সেদিন আর তোমাকে পাবো না।

আবির আমি চলি তুমি ভালো থাকো।

তুমি ভালো থাকো।

মিতু বাসায় এসে বাবাকে তার সিদ্ধান্ত জানায়।

বাবা তুমি যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে আমি তাকেই বিয়ে করবো।

মেয়ে রাজি হওয়ায় কবির আহমেদ খুশি হন। মেয়ে বাস্তবতা বুঝেছে। তিনি বিয়ের আয়োজন করেন। রুবেলের সঙ্গে মিতুর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হলোও মিতু কিছুতেই স্বামীকে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। রুবেলের স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে তাকে দাহ করে। সমস্ত সত্তা দখল করে আছে রুবেলের ভালোবাসা। নারীর মন একবার দখল হয়ে গেলে কঠিন হয় সে দখলদারিত্ব মুক্ত করা। মিতু জানে এসব ঠুনকো অনুভূতি মূল্যহীন তবু মনকে বোঝাতে পারে না। রুবেল সচেতন। স্ত্রীর দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিষয়টি হয়তো আঁচ করতে পারে। সে অপেক্ষা করে। যেদিন তার স্ত্রী ভালোবেসে তাকে কাছে টানবে সেদিন যাবে তার কাছে। এক বাড়িতে এক ছাদের নিচে চলতে থাকে দুজনার দ্বৈত জীবন। ধীরে ধীরে এক রুমে অবস্থান দুই রুমে গড়ায়। এক সঙ্গের খাওয়া-দাওয়া এক সময় আগে পরে হয়ে যায়। মিতুর স্বামীর অনেক ধৈর্য। সে নিরবে স্ত্রীর উদাসীনতা প্রত্যক্ষ করে। স্বামীর অধিকার পায়না বলে কোন অভিযোগ করে না। বরং লক্ষ্য রাখে মিতুর কখন কী দরকার। বলার আগেই হাজির করে সেসব।

একসময় মিতুর চেতনা জাগ্রত হয়। বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে এসব কী করছে সে। একটা মানুষ নিষ্ঠার সঙ্গে তার সব অসমীচীনতা নিরবে মেনে চলেছে। কখনো হাজির হয়নি স্বামীর পরাক্রম নিয়ে যা সে ন্যায্যত করতে পারে। মিতু ভাবে স্বামী তার দায়িত্ব কর্তব্য নীরবে পালন করে চলেছে। খাওয়া পরা সহ সামান্যতম জিনিসের কোন অভাব রাখেনি। চোখের পলকে তার সমস্ত প্রয়োজন পূরণ হচ্ছে। তার অতীত এখন স্বপ্ন। জীবন চলে বাস্তবতায় স্বপ্ন নিয়ে নয়। সে নির্বোধের মত স্বপ্ন আঁকড়ে পড়ে আছে। নিজের জীবনের সঙ্গে আরেকটা জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। আত্মপীড়নে দগ্ধ হতে থাকে সে। নিজের উপর রাগ হয় এতদিন কোথায় ছিল তার বিবেকবোধ। তার নির্লিপ্ততা প্রতিমুহূর্তে অধিকার বঞ্চিত করছে স্বামীকে। রুবেল খুব ভালো মানুষ। শুধু ভালো মানুষ নয় মহৎ অন্তরের মানুষ। অভিযোগ করা তো দূরের বিষয় এত দিন কারো কাছে বলেনি কোন কথা।

মিতু রুবেলকে নিয়ে আরো ভাবে। রুবেল দেখতে সুদর্শন। মিতুর কাছে রুবেলের মহৎ গুণ গুলো বড় হতে থাকে। সামান্য ওই শারীরিক ত্রুটি ছাপিয়ে অসামান্য হয়ে উঠে তার মানস পটে। রুবেলের ভালো মানুষী মিতুকে ক্রমেই কাছে টানতে থাকে। সে যাকে বিয়ে করতে চাইনি তার মহত্বে বিস্মিত হয়। সে রুবেলের কাছে গিয়ে বলে, আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি আমার স্বামী হলেও স্বামীর অধিকার তোমাকে দেইনি। তুমি আমার স্বামী। জন্ম জন্মান্তরের স্বামী। আমার আপনজন। তোমাকে আমি ভালোবাসি। রুবেল এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল। গভীর আবেগে স্ত্রীকে বুকে টেনে নেয়। দু’জনেই খুব খুশি। সংসারে ঝড়ে পড়ে আলোর ঝর্ণাধারা। বছর ঘুরতেই তাদের ছেলে হয়। ছেলে তুহিনকে নিয়ে তাদের আলোক উজ্জ্বল সংসার হয় আরো আলোকিত। মিতু মনের সব দ্বিধা মুছে ফেলে স্বামী সংসারে মাঝে আরাধ্য সুখ খুঁজে পায়।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ